ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় রচিত হল আজ। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ২০২৫ সালের ২৫ জুলাই একটানা ৪,০৭৮ দিন প্রধানমন্ত্রী পদে দায়িত্ব পালন করে প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ৪,০৭৭ দিনের নিরবচ্ছিন্ন মেয়াদের রেকর্ড ভেঙে দিয়েছেন। এই অর্জনের মাধ্যমে তিনি ভারতের দ্বিতীয় দীর্ঘতম একটানা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিজের নাম ইতিহাসে স্থায়ী করলেন। এখন তার সামনে রয়েছেন শুধুমাত্র স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু।
মোদীর এই ঐতিহাসিক সাফল্য তার রাজনৈতিক জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য মাইলফলক। ২০১৪ সালের ২৬ মে প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার পর থেকে তিনি একটানা এই গুরুদায়িত্ব পালন করে আসছেন। গত বছর ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের পর তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়ে তিনি আরও একটি বিরল কৃতিত্ব অর্জন করেছেন।
ইন্দিরা গান্ধী ১৯৬৬ সালের ২৪ জানুয়ারি থেকে ১৯৭৭ সালের ২৪ মার্চ পর্যন্ত টানা ৪,০৭৭ দিন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। নেহরুর কন্যা হিসেবে পরিচিত ইন্দিরা তার প্রথম মেয়াদে ১১ বছর ৫৯ দিন দায়িত্ব পালন করেছিলেন। পরবর্তীতে ১৯৮০ সালে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসে ১৯৮৪ সালে নিহত হওয়ার আগ পর্যন্ত আরও চার বছর দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
জওহরলাল নেহরুর রেকর্ড এখনও অটুট রয়েছে। ভারতের স্বাধীনতার পর ১৯৪৭ সালের ১৫ অগাস্ট থেকে ১৯৬৪ সালের ২৭ মে পর্যন্ত তিনি টানা ৬,১৩১ দিন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এই রেকর্ড ভাঙতে হলে মোদীকে আরও পাঁচ বছরের বেশি সময় প্রধানমন্ত্রী পদে থাকতে হবে। নেহরুর মোট মেয়াদ ছিল ১৬ বছর ২৮৬ দিন।
বর্তমানে মোদী তার তৃতীয় মেয়াদে দায়িত্ব পালন করছেন এবং মোট ১১ বছর ৬০ দিন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি ভারতের একমাত্র অ-কংগ্রেসি প্রধানমন্ত্রী যিনি দুটি পূর্ণ মেয়াদ সম্পন্ন করেছেন এবং তৃতীয়বার নির্বাচিত হয়েছেন। এই কৃতিত্ব শুধুমাত্র জওহরলাল নেহরুর সাথে তুলনীয়।
মোদীর রাজনৈতিক যাত্রা শুরু হয়েছিল গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে। ২০০১ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত তিনি গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। রাজ্য ও জাতীয় পর্যায়ে নির্বাচিত সরকারের প্রধান হিসেবে প্রায় ২৪ বছর কাটানোর অভিজ্ঞতা তার রয়েছে। এই দীর্ঘ অভিজ্ঞতা ভারতের আর কোনো প্রধানমন্ত্রীর নেই।
গুজরাতের বডনগর গ্রামে জন্মগ্রহণকারী মোদী স্বাধীন ভারতে জন্মগ্রহণকারী প্রথম ও একমাত্র প্রধানমন্ত্রী। তার পিতা একটি রেল স্টেশনে চা বিক্রি করতেন এবং ছোটবেলায় মোদীও পিতাকে সাহায্য করতেন। আরএসএস ও বিজেপির মাধ্যমে রাজনীতিতে প্রবেশ করে তিনি জনপ্রিয় নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন।
২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি একাই ২৭২টি আসন পেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। ২০১৯ সালে এই সংখ্যা বেড়ে ৩০৩ আসনে দাঁড়ায়। যদিও ২০২৪ সালের নির্বাচনে বিজেপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েছে, তবুও সবচেয়ে বড় দল হিসেবে এনডিএ জোটের সহায়তায় সরকার গঠন করেছে।
মোদী একমাত্র অ-কংগ্রেসি নেতা যিনি দুইবার লোকসভায় একক দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছেন। ১৯৭১ সালে ইন্দিরা গান্ধীর পর তিনিই প্রথম বর্তমান প্রধানমন্ত্রী যিনি পূর্ণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় ফিরে এসেছেন। এছাড়াও তিনি প্রথম অ-হিন্দিভাষী রাজ্য থেকে দীর্ঘতম সময় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বরত নেতা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, মোদীর এই সাফল্যের পেছনে রয়েছে তার জনপ্রিয়তা ও নেতৃত্বের দক্ষতা। তিনি ধারাবাহিকভাবে ছয়টি নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন – গুজরাতে তিনটি (২০০২, ২০০৭, ২০১২) এবং জাতীয় পর্যায়ে তিনটি (২০১৪, ২০১৯, ২০২৪)। এই ধারাবাহিক সাফল্য তার রাজনৈতিক দক্ষতার প্রমাণ।
বর্তমানে মোদী ব্রিটেন ও মালদ্বীপ সফরে রয়েছেন। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তিনি ভারতকে একটি প্রভাবশালী ও আত্মবিশ্বাসী শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করছেন। তার নেতৃত্বে ভারত বিশ্বমঞ্চে নতুন মর্যাদা পেয়েছে বলে অনেকেই মনে করেন।
ইন্দিরা গান্ধীর রেকর্ড ভাঙার মাধ্যমে মোদী প্রমাণ করেছেন যে অ-কংগ্রেসি নেতারাও দীর্ঘমেয়াদি শাসনের ক্ষমতা রাখেন। স্বাধীনতার পর থেকে ভারতের রাজনীতিতে কংগ্রেস দলের যে আধিপত্য ছিল, মোদীর সাফল্য সেই চিত্র পরিবর্তন করেছে। তিনি প্রমাণ করেছেন যে ব্যক্তিত্ব ও নেতৃত্বের গুণে একজন নেতা দীর্ঘকাল ক্ষমতায় থাকতে পারেন।
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মোদীর এই ঐতিহাসিক মাইলফলক ভারতীয় রাজনীতির ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। নেহরুর পর সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী নেতা হিসেবে তিনি ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছেন।