কলকাতা ও দিল্লিতে CIA-এর গোপন ঘাঁটি: গোপনীয়তার পর্দা উন্মোচিত!

কলকাতা এবং নয়াদিল্লিতে আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থা CIA-এর গোপন ঘাঁটি ছিল বলে সম্প্রতি এক চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ পেয়েছে। এই তথ্য উঠে এসেছে ১৯৬৩ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির হত্যার সঙ্গে…

Srijita Chattopadhay

 

কলকাতা এবং নয়াদিল্লিতে আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থা CIA-এর গোপন ঘাঁটি ছিল বলে সম্প্রতি এক চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ পেয়েছে। এই তথ্য উঠে এসেছে ১৯৬৩ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির হত্যার সঙ্গে জড়িত নথিপত্র থেকে, যা সম্প্রতি মার্কিন ন্যাশনাল আর্কাইভস অ্যান্ড রেকর্ডস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (NARA) প্রকাশ করেছে। এই নথি অনুসারে, শুধু ভারত নয়, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, ইরান, দক্ষিণ কোরিয়া এবং জাপানের মতো দেশেও CIA-এর গোপন কার্যকলাপ চলত। এই ঘাঁটিগুলোকে “ব্ল্যাক সাইট” বলা হয়, যেখানে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ, জিজ্ঞাসাবাদ এবং অন্যান্য গোপন কাজ করা হতো। এই খবর ভারতের রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিষয়ক চিন্তাধারায় নতুন প্রশ্ন তুলেছে।

ঘটনার বিবরণ শুরু হয় যখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্দেশে এই গোপন নথিগুলো প্রকাশ করা হয়। ২০২৫ সালের ১৯ মার্চ হিন্দুস্তান টাইমস, দ্য উইক এবং বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের মতো নির্ভরযোগ্য সংবাদমাধ্যমে এই খবর প্রকাশিত হয়। নথি অনুসারে, CIA-এর নিউ ইয়র্ক শাখা ভারতের নয়াদিল্লি এবং কলকাতায় গোপন ঘাঁটি পরিচালনা করত। এই ঘাঁটিগুলোর উদ্দেশ্য ছিল গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করা, সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদ করা এবং সম্ভবত গোপন অভিযান পরিচালনা করা। শুধু ভারত নয়, পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডি, শ্রীলঙ্কার কলম্বো, ইরানের তেহরান, দক্ষিণ কোরিয়ার সিউল এবং জাপানের টোকিওতেও এমন ঘাঁটি ছিল বলে জানা গেছে। এই তথ্য প্রকাশের পর রাশিয়ার সমর্থিত সংবাদমাধ্যম RT একটি টুইটে বিশ্বব্যাপী এই গোপন ঘাঁটির তালিকা শেয়ার করে, যা ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়।

এই গোপন ঘাঁটিগুলোর কার্যক্রম সম্পর্কে বিস্তারিত জানা গেলে বোঝা যায়, এগুলো শুধু তথ্য সংগ্রহের জন্যই নয়, বরং বড় ধরনের গোয়েন্দা অভিযানের জন্যও ব্যবহৃত হতো। “ব্ল্যাক সাইট” হিসেবে পরিচিত এই জায়গাগুলোতে সন্দেহভাজন সন্ত্রাসীদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হতো, যাদের অনেক সময় আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রেপ্তার বা বিচারের আওতায় আনা হতো না। ভারতের প্রেক্ষিতে, এই ঘাঁটিগুলো সম্ভবত শীতল যুদ্ধের সময় কমিউনিস্ট চীনের গতিবিধি নজরদারি করতে ব্যবহৃত হয়েছিল। ১৯৬০-এর দশকে ভারত ও চীনের মধ্যে উত্তেজনা বাড়ার সময় আমেরিকা ভারতের সঙ্গে গোয়েন্দা সহযোগিতা বাড়ায়। এই সময়ে CIA ভারতের ওড়িশার চারবাটিয়া এয়ারবেসে U-2 গুপ্তচর বিমানের জন্য জ্বালানি সরবরাহের অনুমতি পেয়েছিল, যা চীনের ওপর নজরদারি করতে ব্যবহৃত হতো।

ইতিহাসের পাতা উল্টালে দেখা যায়, ভারতের সঙ্গে CIA-এর সম্পর্ক শীতল যুদ্ধের সময় থেকেই গভীর। ১৯৪৯ সালে ভারতের গোয়েন্দা ব্যুরোর তৎকালীন পরিচালক টি জি সঞ্জীবি CIA-এর সঙ্গে সহযোগিতা শুরু করেন, মূলত চীনের কমিউনিস্ট শক্তির গতিবিধি নজরে রাখতে। ১৯৫৯ সালে দলাই লামার ভারতে পালিয়ে আসার পেছনেও CIA-এর ভূমিকা ছিল। এছাড়া ১৯৬২ সালের ভারত-চীন যুদ্ধের পর আমেরিকা ভারতকে গোয়েন্দা সহায়তা দেয়, যার মধ্যে চারবাটিয়ায় গোপন সামরিক ঘাঁটি স্থাপনও অন্তর্ভুক্ত ছিল। কলকাতা ও দিল্লির ঘাঁটিগুলো সম্ভবত এই সময়কারই অংশ ছিল, যা এতদিন গোপন রাখা হয়েছিল। এই তথ্যগুলো ২০১৩ সালে প্রকাশিত একটি PTI রিপোর্টেও উল্লেখ আছে, যা ভারতের CIA-এর সঙ্গে সম্পর্কের গভীরতা বোঝায়।

কিন্তু এই ঘাঁটিতে ঠিক কী কী কাজ হতো? সাধারণভাবে বলা যায়, এগুলোতে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ, নজরদারি এবং গোপন অভিযান পরিচালনা করা হতো। কলকাতার ভৌগোলিক অবস্থান তৎকালীন পূর্ব ভারত ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার গতিবিধি নজরে রাখার জন্য আদর্শ ছিল। অন্যদিকে, নয়াদিল্লি রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক তথ্য সংগ্রহের কেন্দ্র হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত। এই ঘাঁটিগুলোতে কি শুধু তথ্য সংগ্রহ হতো, নাকি আরও বড় কোনো পরিকল্পনা ছিল, তা এখনও পুরোপুরি পরিষ্কার নয়। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, শীতল যুদ্ধের সময় আমেরিকা ভারতকে কমিউনিস্ট প্রভাব থেকে দূরে রাখতে এই কৌশল অবলম্বন করেছিল।

এই প্রকাশের পর ভারতে রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়াও দেখা গেছে। উদাহরণস্বরূপ, সিপিআইএম-এর মতো দল সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গে আমেরিকার রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বৃদ্ধির আশঙ্কা প্রকাশ করেছে। পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের একটি দল এফবিআই-এর প্রশিক্ষণ নিয়ে ফিরেছে, যা এই আশঙ্কাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। তবে এই গোপন ঘাঁটিগুলো ১৯৬০-এর দশকের, এবং বর্তমানে এগুলোর অস্তিত্ব আছে কি না, তা নিয়ে কোনো স্পষ্ট প্রমাণ নেই।

সব মিলিয়ে, এই তথ্য ভারতের ইতিহাসে একটি নতুন অধ্যায় যোগ করেছে। CIA-এর এই গোপন কার্যক্রম শীতল যুদ্ধের সময়কার ভূ-রাজনৈতিক খেলার একটি অংশ ছিল। কলকাতা ও দিল্লির মতো শহরে এমন ঘাঁটির উপস্থিতি ভারতের গুরুত্ব এবং তৎকালীন বিশ্ব রাজনীতিতে এর ভূমিকার প্রমাণ দেয়। তবে এই ঘটনা আমাদের সামনে নতুন প্রশ্নও তুলেছে—আজও কি এমন কোনো গোপন কার্যক্রম চলছে? উত্তর খুঁজতে আরও গবেষণা ও তথ্যের অপেক্ষায় থাকতে হবে।

 

About Author
Srijita Chattopadhay

সৃজিতা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতক। তিনি একজন প্রতিশ্রুতিশীল লেখক এবং সাংবাদিক, যিনি তার লেখা দ্বারা বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির সমৃদ্ধি তুলে ধরতে সদা উদ্যমী। সৃজিতার লেখার ধারা মূলত সাহিত্য, সমাজ এবং সংস্কৃতির বিভিন্ন দিককে ঘিরে আবর্তিত হয়, যেখানে তিনি তার গভীর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা ও বিশ্লেষণী দক্ষতার পরিচয় দেন। তাঁর নিবন্ধ ও প্রতিবেদনগুলি পাঠকদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে, যা তার বস্তুনিষ্ঠতা ও সংবেদনশীলতার পরিচয় বহন করে। সৃজিতা তার কর্মজীবনে ক্রমাগত নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে বদ্ধপরিকর, যা তাকে বাংলা সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।