ভারতীয় বংশোদ্ভূত প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ ও দার্শনিক গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক ২০২৫ সালের হলবার্গ পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। মানবিকতা ও সমাজবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে অসাধারণ অবদানের জন্য এই সম্মানজনক পুরস্কার দেওয়া হয়, যাকে প্রায়ই হিউম্যানিটিজের ‘নোবেল পুরস্কার’ বলে অভিহিত করা হয়। আমেরিকার কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ৮৩ বছর বয়সী অধ্যাপকের হাতে এই পুরস্কার তুলে দেওয়া হবে আগামী ৫ জুন, নরওয়ের বার্গেন বিশ্ববিদ্যালয়ে। এই পুরস্কারের সঙ্গে তিনি পাবেন ৫,৪০,০০০ মার্কিন ডলার, যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় সাড়ে ছয় কোটি টাকার সমান।
ঘটনার বিবরণে যাওয়ার আগে জানা দরকার, গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক কে। ১৯৪২ সালে কলকাতায় জন্মগ্রহণ করা এই বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব বর্তমানে বিশ্বব্যাপী সমালোচনামূলক তত্ত্ব ও পোস্টকলোনিয়াল স্টাডিজের একজন পথিকৃৎ হিসেবে পরিচিত। তিনি হলবার্গ পুরস্কার পাওয়ার ঘোষণা পেয়েছেন ১৬ মার্চ, ২০২৫-এ, এবং এই সংবাদ ভারতীয় উপমহাদেশে ব্যাপক উচ্ছ্বাস সৃষ্টি করেছে। নরওয়ের শিক্ষা মন্ত্রণালয় এই পুরস্কার প্রদানের দায়িত্বে রয়েছে, এবং তাদের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, গায়ত্রীর কাজ “মানবিকতার গভীর উপলব্ধি এবং সমাজের প্রান্তিক মানুষদের কণ্ঠস্বর তুলে ধরার ক্ষেত্রে অতুলনীয়”। এই পুরস্কারের মাধ্যমে তার দীর্ঘদিনের গবেষণা ও শিক্ষাদানের প্রতি সম্মান জানানো হলো। আগামী জুনে একটি বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানে তাকে এই পুরস্কার দেওয়া হবে, যেখানে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিশিষ্ট ব্যক্তিরা উপস্থিত থাকবেন।
গায়ত্রীর জীবন ও কাজের গভীরে গেলে বোঝা যায়, কেন তিনি এই সম্মানের যোগ্য। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক শেষ করে তিনি আমেরিকায় পড়তে যান এবং কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তুলনামূলক সাহিত্যে ডক্টরেট অর্জন করেন। তার সবচেয়ে বিখ্যাত কাজ ‘ক্যান দ্য সাবঅলটার্ন স্পিক?’ নামক প্রবন্ধ, যেখানে তিনি উপনিবেশিত সমাজের নিম্নবর্গের মানুষদের কণ্ঠহীনতার প্রশ্ন তুলেছেন। এই লেখাটি পোস্টকলোনিয়াল তত্ত্বের একটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হয়। এছাড়া, ফরাসি দার্শনিক জ্যাক দেরিদার লেখা ‘অফ গ্রামাটোলজি’র ইংরেজি অনুবাদ করে তিনি বিশ্বব্যাপী খ্যাতি অর্জন করেন। তার এই কাজগুলো শুধু শিক্ষাবিদদের মধ্যেই নয়, সমাজের বিভিন্ন স্তরে প্রভাব ফেলেছে।
তার কৃতিত্বের আরেকটি দিক হলো শিক্ষার প্রতি তার নিষ্ঠা। গায়ত্রী বর্তমানে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত এবং সেখানে তিনি তুলনামূলক সাহিত্য ও সমাজবিজ্ঞান পড়ান। এছাড়াও, তিনি ভারতের গ্রামীণ এলাকায় শিক্ষার প্রসারে কাজ করেছেন। তার প্রতিষ্ঠিত স্কুলগুলোতে দরিদ্র শিশুদের শিক্ষার সুযোগ করে দেওয়া হয়, যা তার সমাজসেবার একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এই কাজের জন্য তিনি আগেও নানা পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন, যেমন—২০১২ সালে ভারত সরকারের পদ্মভূষণ এবং ২০১৩ সালে কিয়োটো পুরস্কার। তবে হলবার্গ পুরস্কার তার ক্যারিয়ারের একটি শীর্ষস্থানীয় স্বীকৃতি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
এই পুরস্কারের প্রাসঙ্গিকতা বোঝার জন্য হলবার্গ পুরস্কার সম্পর্কে একটু জানা দরকার। ২০০৩ সালে নরওয়ে সরকার এই পুরস্কার চালু করে, যা মানবিকতা, সমাজবিজ্ঞান, আইন এবং ধর্মতত্ত্বের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য দেওয়া হয়। প্রতি বছর একজন বা একাধিক ব্যক্তিকে এই পুরস্কার দেওয়া হয়, এবং এর আর্থিক মূল্য ও সম্মান নোবেল পুরস্কারের সমতুল্য বলে মনে করা হয়। গায়ত্রী এই পুরস্কার পাওয়া প্রথম ভারতীয় বংশোদ্ভূত নারী, যা ভারতের জন্যও গর্বের বিষয়। এর আগে এই পুরস্কার পেয়েছেন জার্মান দার্শনিক ইয়ুর্গেন হাবেরমাস (২০০৫) এবং ফরাসি নৃতত্ত্ববিদ লেভি-স্ত্রস (২০০৩)।
সহজ কথায় বলতে গেলে, গায়ত্রীর এই অর্জন শুধু তার ব্যক্তিগত সাফল্য নয়, বরং বিশ্বব্যাপী ভারতীয় নারীদের প্রতিনিধিত্ব। তার কাজ আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, শিক্ষা ও চিন্তার মাধ্যমে সমাজের প্রান্তিক মানুষদের জীবনেও পরিবর্তন আনা সম্ভব। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ইতিমধ্যে তাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন, এবং সামাজিক মাধ্যমে এই সংবাদ ছড়িয়ে পড়েছে। তার এই সাফল্য ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে।
শেষ কথা হিসেবে বলা যায়, গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাকের এই পুরস্কার জয় শুধু একটি পুরস্কার নয়, বরং মানবিকতার প্রতি তার অঙ্গীকারের স্বীকৃতি। তার লেখা, শিক্ষা ও সমাজসেবার মাধ্যমে তিনি বিশ্বকে নতুনভাবে চিনতে শিখিয়েছেন। এই গৌরবময় মুহূর্তে ভারতীয় হিসেবে আমরা সবাই গর্বিত, এবং তার ভবিষ্যৎ কাজের জন্য শুভকামনা রইল।