গাড়ি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের একটি অপরিহার্য অংশ। এর সুষ্ঠু পরিচালনা ও দীর্ঘস্থায়িত্বের জন্য নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আসুন জেনে নেই সেই ১০টি মূল কাজ যা আপনার গাড়িকে সুস্থ ও নিরাপদ রাখবে।
ইঞ্জিন অয়েল পরীক্ষা ও পরিবর্তন:
ইঞ্জিন অয়েল হল আপনার গাড়ির রক্তের মতো। এটি ইঞ্জিনের যন্ত্রাংশগুলোকে স্নেহন করে, ঘর্ষণ কমায় এবং উষ্ণতা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। প্রতি 5,000 থেকে 7,500 কিলোমিটার অন্তর অয়েল পরিবর্তন করা উচিত। তবে, আধুনিক গাড়িতে এই সময়সীমা 10,000 কিলোমিটার পর্যন্ত বাড়ানো যেতে পারে। নিয়মিত অয়েল লেভেল চেক করুন এবং প্রয়োজনে টপ-আপ করুন। অয়েল পরিবর্তনের সময় ফিল্টারও অবশ্যই পরিবর্তন করুন।
টায়ার পরিচর্যা:
টায়ার আপনার গাড়ির একমাত্র অংশ যা রাস্তার সাথে সরাসরি সংযোগ রাখে। সঠিক এয়ার প্রেশার না থাকলে গাড়ির পারফরম্যান্স, ফুয়েল ইকোনমি এবং নিরাপত্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রতি মাসে অন্তত একবার টায়ার প্রেশার চেক করুন। ট্রেড ডেপথ কমপক্ষে 1.6 মিলিমিটার হওয়া উচিত। প্রতি 10,000 কিলোমিটার অন্তর টায়ার রোটেশন করুন এবং প্রতি 20,000 কিলোমিটারে ব্যালেন্সিং করান।
ব্রেক সিস্টেম পরীক্ষা:
ব্রেক সিস্টেম গাড়ির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা ব্যবস্থা। প্রতি 20,000 কিলোমিটার অন্তর ব্রেক প্যাড ও রোটর পরীক্ষা করুন। ব্রেক প্যাডের পুরুত্ব 3 মিলিমিটারের কম হলে পরিবর্তন করুন। ব্রেক ফ্লুইড লেভেল নিয়মিত চেক করুন এবং প্রতি দুই বছর অন্তর পরিবর্তন করুন। কারণ ব্রেক ফ্লুইড সময়ের সাথে আর্দ্রতা শোষণ করে যা ব্রেকিং কার্যক্ষমতা কমিয়ে দেয়।
ব্যাটারি রক্ষণাবেক্ষণ:
ব্যাটারি গাড়ির ইলেকট্রিকাল সিস্টেমের প্রাণকেন্দ্র। প্রতি মাসে ব্যাটারির টার্মিনাল পরিষ্কার করুন এবং কোনো ক্ষয় বা জং আছে কিনা দেখুন। যদি আপনার গাড়িতে ফ্লাডেড লেড-এসিড ব্যাটারি থাকে, তবে প্রতি তিন মাস অন্তর ওয়াটার লেভেল চেক করুন। আধুনিক মেইন্টেন্যান্স-ফ্রি ব্যাটারিতে এই প্রয়োজন নেই। সাধারণত 3-5 বছর পর ব্যাটারি পরিবর্তন করা উচিত।
এয়ার ফিল্টার পরিবর্তন:
ইঞ্জিন এয়ার ফিল্টার ধুলা ও অন্যান্য কণা থেকে ইঞ্জিনকে রক্ষা করে। একটি ময়লা ফিল্টার ফুয়েল ইকোনমি কমিয়ে দেয় এবং ইঞ্জিনের কার্যক্ষমতা হ্রাস করে। প্রতি 15,000 থেকে 30,000 কিলোমিটার অন্তর এটি পরিবর্তন করুন। ক্যাবিন এয়ার ফিল্টার যাত্রীদের জন্য বিশুদ্ধ বাতাস নিশ্চিত করে। এটি প্রতি 15,000 কিলোমিটার অন্তর বা বছরে একবার পরিবর্তন করা উচিত।
কুলিং সিস্টেম পর্যবেক্ষণ:
কুলিং সিস্টেম ইঞ্জিনের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। প্রতি সপ্তাহে কুলান্ট লেভেল চেক করুন এবং প্রয়োজনে টপ-আপ করুন। কুলান্ট প্রতি 30,000 কিলোমিটার বা দুই বছর অন্তর পরিবর্তন করুন। রেডিয়েটর পরিষ্কার রাখুন যাতে বাতাস প্রবাহ ঠিকমতো হয়। কুলিং সিস্টেমে কোনো লিক আছে কিনা নিয়মিত পরীক্ষা করুন।
ওয়াইপার ব্লেড ও ওয়াশার ফ্লুইড:
ভালো দৃশ্যমানতা নিরাপদ ড্রাইভিং-এর জন্য অপরিহার্য। ওয়াইপার ব্লেড প্রতি ছয় মাস অন্তর বা যখন রাবারে ফাটল দেখা যায় তখন পরিবর্তন করুন। ওয়াশার ফ্লুইড নিয়মিত টপ-আপ করুন এবং শীতকালে ফ্রিজিং পয়েন্ট কম থাকে এমন ফ্লুইড ব্যবহার করুন।
বেল্ট ও হোজ পরীক্ষা:
টাইমিং বেল্ট, সারপেন্টাইন বেল্ট, এবং বিভিন্ন হোজ নিয়মিত পরীক্ষা করুন। কোনো ফাটল, ক্ষয় বা লিক আছে কিনা দেখুন। টাইমিং বেল্ট সাধারণত 60,000 থেকে 100,000 কিলোমিটার অন্তর পরিবর্তন করা হয়। অন্যান্য বেল্ট ও হোজ প্রয়োজন অনুযায়ী পরিবর্তন করুন।
লাইট ও সিগনাল চেক:
প্রতি মাসে সব হেডলাইট, টেইললাইট, ব্রেক লাইট, টার্ন সিগনাল ঠিকমতো কাজ করছে কিনা চেক করুন। প্রয়োজনে বাল্ব পরিবর্তন করুন। হেডলাইট অ্যালাইনমেন্ট ঠিক আছে কিনা নিশ্চিত করুন। LED লাইট ব্যবহার করলে তা দীর্ঘস্থায়ী হবে এবং কম বিদ্যুৎ খরচ করবে।
নিয়মিত সার্ভিসিং:
গাড়ির ম্যানুয়াল অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ে সার্ভিস করান। সাধারণত প্রতি 10,000 কিলোমিটার অন্তর বা ছয় মাস পর পর সার্ভিস করা উচিত। পেশাদার মেকানিক দ্বারা গাড়ি পরীক্ষা করালে অনেক সমস্যা আগেই ধরা পড়ে যা দীর্ঘমেয়াদে খরচ কমায়।
এই দশটি কাজ নিয়মিত করলে আপনার গাড়ি দীর্ঘদিন নিরাপদে ও দক্ষতার সাথে চলবে। মনে রাখবেন, নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ শুধু খরচই কমায় না, এটি আপনার ও আপনার প্রিয়জনদের নিরাপত্তাও নিশ্চিত করে।