ছুটির দিনগুলো যেন আনন্দময় ও কার্যকর হয় সেজন্য অনেকেই চিন্তিত থাকেন। বিশেষ করে শিক্ষার্থীরা দীর্ঘ ছুটিতে কীভাবে সময় কাটাবেন তা নিয়ে প্রায়শই দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়েন। তবে সঠিক পরিকল্পনা ও উদ্যোগ নিলে এই সময়টাকে অত্যন্ত ফলপ্রসূ ও আনন্দদায়ক করে তোলা সম্ভব।
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, ছুটির দিনগুলোতে সৃজনশীল ও শিক্ষামূলককার্যক্রমে অংশগ্রহণ করলে শিক্ষার্থীদের মানসিক বিকাশ ত্বরান্বিত হয়। একই সাথে পরিবারের সদস্যদের সাথে সময় কাটানো সম্পর্ক দৃঢ় করতে সাহায্য করে। তাই ছুটির দিনগুলোকে কীভাবে কাজে লাগানো যায় সে বিষয়ে কিছু পরামর্শ দেওয়া হলো:
১. নতুন ভাষা শেখা: অনলাইন কোর্স বা অ্যাপের মাধ্যমে নতুন কোনো ভাষা শেখা শুরু করা যেতে পারে। এতে করে ভবিষ্যতে কর্মক্ষেত্রে সুবিধা পাওয়া যাবে।
২. শখের চর্চা: যে কোনো শখ যেমন – বাগান করা, ছবি আঁকা, রান্না শেখা ইত্যাদি নিয়মিত চর্চা করা যেতে পারে।
৩. স্বেচ্ছাসেবা: স্থানীয় কোনো সেবামূলক সংস্থায় স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করা যেতে পারে। এতে সমাজের প্রতি দায়িত্ববোধ জাগ্রত হবে।
৪. পড়াশোনা: পরবর্তী সেমিস্টারের জন্য আগাম প্রস্তুতি নেওয়া যেতে পারে। এতে পড়াশোনার চাপ কমবে।
৫. ব্যায়াম: নিয়মিত ব্যায়াম বা যোগব্যায়াম করলে শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা বজায় থাকবে।
৬. ভ্রমণ: দেশের বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থান ভ্রমণ করা যেতে পারে। এতে জ্ঞান বৃদ্ধি পাবে।
৭. দক্ষতা অর্জন: যেকোনো নতুন দক্ষতা অর্জনের জন্য অনলাইন কোর্স করা যেতে পারে।
৮. বই পড়া: নিয়মিত বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলা যেতে পারে। এতে জ্ঞান ও কল্পনাশক্তি বাড়বে।
৯. ব্লগ লেখা: নিজের অভিজ্ঞতা নিয়ে ব্লগ লেখা শুরু করা যেতে পারে। এতে লেখার দক্ষতা বাড়বে।
১০. পরিবারের সাথে সময় কাটানো: পরিবারের সদস্যদের সাথে গল্প করা, খেলাধুলা করা ইত্যাদির মাধ্যমে বন্ধন দৃঢ় করা যায়।
১১. নতুন রেসিপি শেখা: বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্যকর খাবার তৈরি করা শেখা যেতে পারে।
১২. ফটোগ্রাফি: ফটোগ্রাফি শেখা ও চর্চা করা যেতে পারে। এতে সৃজনশীলতা বাড়বে।
১৩. সঙ্গীত চর্চা: কোনো বাদ্যযন্ত্র বাজানো শেখা বা গান গাওয়ার চর্চা করা যেতে পারে।
১৪. মেডিটেশন: নিয়মিত ধ্যান করলে মানসিক শান্তি বাড়বে ও একাগ্রতা বৃদ্ধি পাবে।
১৫. প্রকল্প তৈরি: নিজের পছন্দের কোনো বিষয়ে একটি প্রকল্প তৈরি করা যেতে পারে।
শিক্ষাবিদ ড. রফিকুল ইসলাম বলেন, “ছুটির সময়টাকে কাজে লাগানো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই সময়ে শিক্ষার্থীরা নিজেদের দক্ষতা বাড়াতে পারে, নতুন কিছু শিখতে পারে। একই সাথে মানসিকভাবে বিশ্রাম নিতে পারে। তবে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো সময়টাকে সুনির্দিষ্টভাবে পরিকল্পনা করা।
বাংলাদেশ শিক্ষা বোর্ডের এক জরিপে দেখা গেছে, যেসব শিক্ষার্থী ছুটির সময় নিয়মিত পড়াশোনা ও অন্যান্য শিক্ষামূলক কাজে নিয়োজিত থাকে তাদের ৭৫% পরবর্তী পরীক্ষায় ভালো ফল করে। অন্যদিকে যারা শুধু বিনোদনমূলক কাজে সময় কাটায় তাদের মধ্যে এই হার মাত্র ৪০%।মনোবিজ্ঞানী ড. শামীমা আক্তার জানান, “ছুটির সময় শিক্ষার্থীদের মানসিক চাপ কমানোর পাশাপাশি নিজেদের দক্ষতা বৃদ্ধির দিকেও নজর দেওয়া উচিত। এতে করে তারা পরবর্তী সময়ে আরও ভালোভাবে পড়াশোনায় মনোনিবেশ করতে পারবে।”
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ছুটির সময় শিক্ষার্থীদের জন্য একটি সুনির্দিষ্ট রুটিন তৈরি করা উচিত। এতে করে তারা নিয়মানুবর্তিতা শিখবে এবং সময়ের সদ্ব্যবহার করতে পারবে। তবে সেই রুটিনে অবশ্যই বিশ্রাম ও বিনোদনের জন্যও সময় রাখতে হবে। পরিবার ও সমাজ বিশেষজ্ঞ ড. নাজমুল হক বলেন, “ছুটির সময় পরিবারের সদস্যদের সাথে সময় কাটানো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এতে করে পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় হয় এবং শিশু-কিশোরদের মানসিক বিকাশে সহায়তা করে।”তিনি আরও বলেন, “বর্তমান সময়ে অনেক শিশু-কিশোর স্মার্টফোন ও কম্পিউটার গেমে আসক্ত হয়ে পড়ছে। ছুটির সময় তাদেরকে এসব থেকে দূরে রেখে বাস্তব জগতের সাথে যুক্ত করা খুবই জরুরি।”
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, যেসব শিশু-কিশোর নিয়মিত শারীরিক কার্যকলাপে অংশ নেয় তাদের মধ্যে হতাশা ও উদ্বেগের প্রবণতা ৩০% কম। তাই ছুটির সময় নিয়মিত ব্যায়াম বা খেলাধুলার ব্যবস্থা করা উচিত।অনেক অভিভাবক মনে করেন ছুটির সময় শিক্ষার্থীদের শুধুমাত্র পড়াশোনায় ব্যস্ত রাখা উচিত। কিন্তু শিক্ষাবিদরা এর বিপক্ষে মত দেন। তাঁদের মতে, ছুটির সময় বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রমে অংশ নেওয়া উচিত যাতে সামগ্রিক বিকাশ ঘটে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, “আমরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্দেশনা দিয়েছি যাতে তারা ছুটির সময় শিক্ষার্থীদের জন্য বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি গ্রহণ করে। এর মধ্যে রয়েছে বিজ্ঞান মেলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, দক্ষতা উন্নয়ন কর্মশালা ইত্যাদি।”সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেক তরুণ-তরুণী ছুটির অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছেন। তাদের মধ্যে অনেকেই জানিয়েছেন যে তারা এই সময়টাকে নিজেদের দক্ষতা বাড়ানোর কাজে লাগিয়েছেন। কেউ কেউ আবার স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করে নিজেকে সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ করেছেন।
ছাত্র নেতা রাকিবুল হাসান বলেন, “ছুটির সময় আমরা অনেকেই মিলে একটি শিক্ষা ক্যাম্প আয়োজন করেছি যেখানে আমরা অসহায় শিশুদের বিনামূল্যে পড়াচ্ছি। এতে করে আমরা নিজেরাও শিখছি এবং সমাজের প্রতি দায়িত্ব পালন করছি।”বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ছুটির সময় শিক্ষার্থীদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো নিজেদের আগ্রহ ও প্রতিভা অনুযায়ী কাজ করা। এতে করে তারা নিজেদের সম্ভাবনা সম্পর্কে জানতে পারবে এবং ভবিষ্যৎ কর্মজীবনের জন্য প্রস্তুত হতে পারবে।