ভারত সরকার দেশের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় প্রতিরক্ষা চুক্তি অনুমোদন করেছে। ক্যাবিনেট কমিটি অন সিকিউরিটি (সিসিএস) ৬২,৭০০ কোটি টাকা মূল্যের ১৫৬টি স্বদেশীয় লাইট কমব্যাট হেলিকপ্টার (এলসিএইচ) ‘প্রচণ্ড’ ক্রয়ের এই ঐতিহাসিক প্রস্তাব গতকাল (২৮ মার্চ, ২০২৫) তাদের বৈঠকে অনুমোদন করেছে। এই হেলিকপ্টারগুলো ভারতীয় সেনাবাহিনী এবং বিমান বাহিনীর জন্য হিন্দুস্তান এরোনটিক্স লিমিটেড (এইচএএল) থেকে সংগ্রহ করা হবে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন সিসিএস-এর অনুমোদনের পর প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এইচএএল-এর সাথে ১৫৬টি ‘প্রচণ্ড’ হেলিকপ্টার এবং এর সংশ্লিষ্ট সরঞ্জাম ও প্রশিক্ষণের জন্য দুটি পৃথক চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এই চুক্তির অধীনে ৯০টি হেলিকপ্টার ভারতীয় সেনাবাহিনীকে এবং ৬৬টি ভারতীয় বিমান বাহিনীকে সরবরাহ করা হবে। এই হেলিকপ্টারগুলো মূলত চীন ও পাকিস্তান সীমান্তে উচ্চ উচ্চতার যুদ্ধ পরিচালনার জন্য ব্যবহৃত হবে।
সূত্র অনুযায়ী, এই সরবরাহ ২০২৭-২৮ সাল থেকে শুরু হবে এবং পরবর্তী পাঁচ বছর ধরে চলবে। প্রতি বছর প্রায় ৩০টি হেলিকপ্টার উৎপাদন করা হবে। হেলিকপ্টারগুলো কর্ণাটকের বেঙ্গালুরু এবং তুমকুরে অবস্থিত এইচএএল-এর প্ল্যান্টে তৈরি করা হবে।
‘প্রচণ্ড’ হেলিকপ্টারগুলো বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য কারণ এগুলো বিশ্বের একমাত্র আক্রমণাত্মক হেলিকপ্টার যা ৫,০০০ মিটার (১৬,৪০০ ফুট) উচ্চতায় অবতরণ ও উড্ডয়ন করতে সক্ষম। এই বৈশিষ্ট্য এগুলোকে সিয়াচেন হিমবাহ এবং পূর্ব লাদাখের মতো উচ্চ উচ্চতার এলাকায় অপারেশন চালানোর জন্য আদর্শ করে তোলে। এছাড়া, এই হেলিকপ্টারগুলো একই সাথে এয়ার-টু-গ্রাউন্ড এবং এয়ার-টু-এয়ার মিসাইল উভয় নিক্ষেপ করতে সক্ষম।
প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিং এই চুক্তি অনুমোদনের জন্য প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, “প্রচণ্ড একটি শক্তিশালী যন্ত্র। এই সিদ্ধান্ত ভারতের যুদ্ধ ক্ষমতা এবং প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে আত্মনির্ভরতার জন্য একটি বড় উৎসাহ হিসেবে চিহ্নিত হবে।”।
এই হেলিকপ্টারগুলো ভারতীয় প্রযুক্তিতে নির্মিত এবং বর্তমানে এর মূল্যের ৪৫% উপাদান দেশীয়। চুক্তির অধীনে এই ১৫৬টি হেলিকপ্টার উৎপাদনের সময় দেশীয় উপাদানের পরিমাণ ৬৫% ছাড়িয়ে যাওয়ার লক্ষ্য রয়েছে। এতে প্রায় ২৫০টি দেশীয় কোম্পানি, বিশেষ করে সূক্ষ্ম, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ জড়িত থাকবে এবং ৮,৫০০-এরও বেশি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।
‘প্রচণ্ড’ হেলিকপ্টারের উন্নয়নের ধারণাটি ১৯৯৯ সালের কারগিল যুদ্ধের সময় উদ্ভূত হয়েছিল। তখন ভারতীয় বিমান বাহিনীর এমন একটি হেলিকপ্টারের প্রয়োজন ছিল যা ১৫,০০০ থেকে ১৮,০০০ ফুট উচ্চতায় কার্যকরভাবে অপারেশন চালাতে পারে। ‘শক্তি’ ইঞ্জিন দ্বারা চালিত এই হেলিকপ্টারগুলো ২১,৫০০ ফুট পর্যন্ত উড়তে পারে এবং মিসাইল নিক্ষেপ করতে সক্ষম।
গতই অক্টোবর ২০২২-এ প্রথম লটের ১৫টি এলসিএইচ ভারতীয় বিমান বাহিনীতে যোধপুরে আনুষ্ঠানিকভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। বর্তমান ১৫৬টি হেলিকপ্টারের অর্ডারটি এইচএএল-এর জন্য এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় অর্ডার।
এছাড়া, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় মার্কিন কোম্পানি মেট্রিয়া ম্যানেজমেন্টের সাথে একটি KC-135 মিড-এয়ার রিফুয়েলিং বিমান ভাড়া নেওয়ার চুক্তিও স্বাক্ষর করেছে। এই বিমানটি আগামী ছয় মাসের মধ্যে ভারতে আসবে এবং ভারতীয় বিমান বাহিনী ও নৌবাহিনীর পাইলটদের প্রশিক্ষণ প্রদান করবে।
২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় মোট ১৯৩টি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে, যার মোট মূল্য ২.০৯ লক্ষ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এটি এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ এবং আগের রেকর্ডের প্রায় দ্বিগুণ। এই চুক্তিগুলোর মধ্যে ১৭৭টি (৯২%) দেশীয় শিল্পের সাথে স্বাক্ষরিত হয়েছে, যার মূল্য প্রায় ১.৭ লক্ষ কোটি টাকা (৮১%)।
উল্লেখ্য, ৫.৮ টন ওজনের ‘প্রচণ্ড’ হেলিকপ্টারে রয়েছে টারেট গান, রকেট ফায়ারিং সিস্টেম, এয়ার-টু-এয়ার মিসাইল এবং স্টেলথ ক্ষমতা। এর লাইটওয়েট আর্মার প্যানেল, সেল্ফ-সিলিং ফুয়েল ট্যাঙ্ক, ক্ষতি-সহনশীল মেইন রোটর ব্লেড, বুলেটপ্রুফ উইন্ডশিল্ড এবং কম ফ্রন্টাল রাডার ক্রস-সেকশন সহ ‘এনহ্যান্সড সারভাইভ্যাবিলিটি’ বৈশিষ্ট্য রয়েছে।
এই ঐতিহাসিক চুক্তি প্রমাণ করে যে ভারত প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে আত্মনির্ভরতার দিকে দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে এবং দেশের প্রতিরক্ষা সক্ষমতা উন্নয়নে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।