ভারতে প্রতিদিন যৌতুকের বলিতে কতজন নারীর মৃত্যু হয়? NCRB-র রিপোর্টে ভয়ানক তথ্য সামনে এলো

গ্রেটার নয়ডায় নিক্কি ভাটির নৃশংস হত্যার পর আবারও চোখে পড়ল ভারতের সমাজে যৌতুক প্রথার ভয়াবহ বাস্তবতা। জাতীয় অপরাধ রেকর্ড ব্যুরো (এনসিআরবি) এর তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রতিদিন গড়ে ২০ জন নারী যৌতুক-সংশ্লিষ্ট সহিংসতার…

Avatar

 

গ্রেটার নয়ডায় নিক্কি ভাটির নৃশংস হত্যার পর আবারও চোখে পড়ল ভারতের সমাজে যৌতুক প্রথার ভয়াবহ বাস্তবতা। জাতীয় অপরাধ রেকর্ড ব্যুরো (এনসিআরবি) এর তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রতিদিন গড়ে ২০ জন নারী যৌতুক-সংশ্লিষ্ট সহিংসতার কারণে প্রাণ হারান। এই রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১৭ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ৬ বছরে ভারতে যৌতুক নির্যাতনে প্রায় ৩৫ হাজার ৪৯৩ জন নারীর মৃত্যু হয়েছে।

২০২২ সালের সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, সে বছর দেশে ৬,৪৫০টি যৌতুকজনিত মৃত্যুর ঘটনা রেকর্ড করা হয়। আরও উদ্বেগজনক বিষয় হল, ধর্ষণ বা যৌন হয়রানির পর নারী হত্যার তুলনায় যৌতুক সংক্রান্ত মৃত্যু ২৫ গুণ বেশি। এ সংখ্যা দেখিয়ে দেয় যৌতুক এখনও দেশের অন্যতম প্রাণঘাতী সামাজিক ব্যাধি হয়ে রয়েছে।

গত সপ্তাহে উত্তরপ্রদেশের গ্রেটার নয়ডার সিরসা গ্রামে ২৮ বছর বয়সী নিক্কি ভাটিকে আগুনে পুড়িয়ে মারার ঘটনা সারা দেশে তোলপাড় সৃষ্টি করেছে। পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, নিক্কির স্বামী বিপিন ভাটি এবং তার পরিবার ৩৬ লাখ টাকা ও বিলাসবহুল গাড়ির দাবি করেছিল। এই দাবি পূরণ করতে না পারায় তারা নিক্কিকে নির্যাতন করে হত্যা করে।

এনসিআরবি-র পরিসংখ্যান অনুযায়ী, যৌতুকজনিত মৃত্যুর ক্ষেত্রে উত্তরপ্রদেশ দেশে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে। ২০২২ সালে উত্তরপ্রদেশে ২,১৩৮টি যৌতুক মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে, যা দেশের মোট ঘটনার প্রায় ৩০ শতাংশ। বিহার দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ১,০৫৭টি ঘটনা নিয়ে। মধ্যপ্রদেশে ৫১৮টি, পশ্চিমবঙ্গে ৪৭২টি এবং রাজস্থানে ৪৫১টি যৌতুক মৃত্যুর ঘটনা রেকর্ড হয়েছে।

দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলোতে তুলনামূলক কম ঘটনা ঘটলেও সংখ্যাটি একেবারে উপেক্ষণীয় নয়। কর্ণাটকে ১৬৫টি, তেলেঙ্গানায় ১৩৭টি, তামিলনাড়ুতে ২৯টি এবং কেরলে ১১টি যৌতুক মৃত্যুর ঘটনা রেকর্ড হয়েছে ২০২২ সালে।

এই পরিসংখ্যানগুলি কেবল রিপোর্ট হওয়া ঘটনার সংখ্যা। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি হতে পারে কারণ অধিকাংশ পরিবার সামাজিক চাপে পড়ে এসব ঘটনা লুকিয়ে রাখে। আইনে ১৯৬১ সাল থেকে যৌতুক প্রথা নিষিদ্ধ হলেও বাস্তবে এটি আজও ‘স্বাভাবিক প্রথা’ হিসেবে চলমান রয়েছে।

ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে উদ্বেগজনক পরিস্থিতি

যৌতুকের কারণে নারী হত্যার ঘটনাগুলোতে ন্যায়বিচার পাওয়ার হার অত্যন্ত হতাশাজনক। এনসিআরবি-র তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের শেষ নাগাদ ৬০,৫৭৭টি যৌতুক মৃত্যুর মামলা আদালতে বিচারাধীন ছিল, যার মধ্যে ৫৪,৪১৬টি মামলা আগের বছরগুলো থেকে ঝুলে আছে।

২০২২ সালে যেসব মামলার বিচার সম্পন্ন হয়েছিল, সেই ৩,৬৮৯টি মামলার মধ্যে মাত্র ৩৩ শতাংশ মামলায় দোষী সাব্যস্ত করা গেছে। নতুন ৬,১৬১টি মামলা বিচারের জন্য পাঠানো হলেও তার মধ্যে মাত্র ৯৯টি মামলায় এক বছরের মধ্যে দোষী সাব্যস্ত করা সম্ভব হয়েছে, যার হার মাত্র ২ শতাংশেরও কম। এটি ইঙ্গিত দেয় যে নিক্কি ভাটির মতো ঘটনায় দ্রুত বিচার পাওয়ার সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ।

রাজ্যভিত্তিক বিচার পরিস্থিতিও খুবই নিরাশাজনক। উত্তরপ্রদেশে ২০২২ সালে ২,২০০টি যৌতুক মৃত্যুর মামলা রিপোর্ট হলেও মাত্র ৩২০টি মামলায় দোষী সাব্যস্ত হয়েছে, যার হার মাত্র ১৪.৫ শতাংশ। বিহারে দোষী সাব্যস্তের হার ১১ শতাংশ, ঝাড়খণ্ডে ১৪.৪ শতাংশ এবং দিল্লিতে মাত্র ১১ শতাংশ।

নিক্কি ভাটি কেস: যৌতুক নির্যাতনের প্রতিচ্ছবি

গ্রেটার নয়ডার নিক্কি ভাটির মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড ভারতে যৌতুক নির্যাতনের ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেছে। নিক্কি ভাটি ২০১৬ সালে মাত্র ১৭ বছর বয়সে বিপিন ভাটির সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তার বোন কঞ্চনাও একই সময় বিপিনের বড় ভাই রোহিতকে বিয়ে করেন।

বিবাহের সময় নিক্কির পরিবার একটি স্কর্পিও গাড়ি, একটি মোটরসাইকেল এবং স্বর্ণালংকার উপহার দিয়েছিল। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে শ্বশুরবাড়ি থেকে অতিরিক্ত যৌতুকের দাবি অব্যাহত থাকে। সর্বশেষ তারা ৩৬ লাখ টাকা নগদ এবং একটি বিলাসবহুল গাড়ি দাবি করে।

২১ আগস্ট সন্ধ্যায় নিক্কি ভাটির স্বামী বিপিন এবং শাশুড়ি দয়া তাকে মারধর করে জ্বালানি ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। এই ভয়ানক ঘটনা নিক্কির বোন কঞ্চনা মোবাইলে ভিডিও করে সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়। গুরুতর পোড়ার জখমে নিক্কি দিল্লির সফদরজং হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথেই মৃত্যুবরণ করেন।

পুলিশ দ্রুত তদন্তে নেমে নিক্কির স্বামী বিপিন ভাটি (৩০), শ্বশুর সত্যবীর ভাটি (৫৫), শাশুড়ি দয়া ভাটি (৫৫) এবং ভাসুর রোহিত ভাটি (২৮) সহ সকল অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করেছে। তাদের বিরুদ্ধে ভারতীয় ন্যায় সংহিতার ১০৩ ধারা (হত্যা), ১১৫(২) ধারা (স্বেচ্ছায় আঘাত) এবং ৬১(২) ধারা (অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র) অনুযায়ী মামলা দায়ের করা হয়েছে।

যৌতুক প্রথার সামাজিক শিকড়

ভারতের সমাজে যৌতুক প্রথা এতটাই গভীরভাবে প্রোথিত যে একে এখনও অপরাধ হিসেবে দেখা হয় না। বরং এটি ‘প্রথা’ বা ‘রেওয়াজ’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। নারী অধিকার কর্মী যোগিতা ভায়ানার মতে, এখনও সমাজে খোলাখুলি যৌতুক দাবি করা হয়। তিনি জানান, নয়ডার একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে ফরচুনার এবং মার্সেডিজের মতো বিলাসবহুল গাড়ি যৌতুক হিসেবে দেওয়া হতে দেখেছেন।

গত শতকের গোড়া থেকে শুরু করে ১৯৫০-১৯৯৯ পর্যন্ত ৫০ বছরে ভারতে যৌতুক লেনদেনের মোট পরিমাণ ছিল ২৫০ বিলিয়ন ডলার। একবিংশ শতাব্দীতেও প্রায় ৯০ শতাংশ বিয়েতে যৌতুক দেওয়া হয় বলে জানা যায়। ২০১০ সালের একটি গবেষণা অনুযায়ী, ভারতের গ্রামাঞ্চলে ৯৫ শতাংশ বিয়েতে যৌতুক প্রদান করা হয়।

এমনকি শিক্ষিত ও কর্মজীবী নারীরাও যৌতুকের চাপ থেকে মুক্ত নন। রাজস্থানের যোধপুরে সরকারি স্কুলের শিক্ষিকা সঞ্জু বিষ্ণোই বিয়ের ১০ বছর পরও যৌতুকের জন্য নির্যাতনের শিকার হয়ে তিন বছরের কন্যাকে নিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। এ ঘটনা ঘটেছে নিক্কি ভাটির মৃত্যুর মাত্র একদিন পর।

আইনি কাঠামো এবং বাস্তবায়নের অন্তরায়

১৯৬১ সালের যৌতুক নিরোধ আইন অনুযায়ী যৌতুক গ্রহণ ও প্রদান উভয়ই দণ্ডনীয় অপরাধ। ভারতীয় দণ্ডবিধির ৪৯৮এ ধারা (বর্তমানে ভারতীয় ন্যায় সংহিতার ৮৫ ধারা) অনুযায়ী স্বামী বা শ্বশুরবাড়ির সদস্য কর্তৃক নারীর প্রতি নিষ্ঠুরতায় তিন বছরের কারাদণ্ড ও জরিমানার বিধান রয়েছে।

বিয়ের সাত বছরের মধ্যে যৌতুক নির্যাতনের কারণে নারীর মৃত্যু ঘটলে ভারতীয় ন্যায় সংহিতার ৮০ ধারা অনুযায়ী তা যৌতুক মৃত্যু হিসেবে গণ্য হয় এবং এর জন্য ন্যূনতম ৭ বছরের কারাদণ্ড বাধ্যতামূলক। কিন্তু বাস্তবে এই আইনের প্রয়োগ অত্যন্ত দুর্বল।

অনেক ক্ষেত্রে যৌতুককে ‘উপহার’ হিসেবে দেখানো হয় আদালতে, যা অপরাধীদের দায়মুক্তি নিশ্চিত করে। এছাড়া প্রমাণের অভাব, তদন্তে বিলম্ব, এবং পারিবারিক চাপের কারণে অনেক মামলায় ন্যায়বিচার পাওয়া সম্ভব হয় না। বেঙ্গালুরুতে ২০১৭-২০২২ সালের মধ্যে ৪৯৮এ ধারায় দায়ের করা ২,২০২টি মামলার মধ্যে মাত্র ২৪টি মামলায় দোষী সাব্যস্ত করা গেছে, যার হার মাত্র ১ শতাংশ।

সামাজিক মানসিকতার পরিবর্তন প্রয়োজন

যৌতুক প্রথা নির্মূলের জন্য শুধু আইনি পদক্ষেপ যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন সামাজিক মানসিকতার পরিবর্তন। মনোবিদ ডক্টর শ্বেতা শর্মার মতে, যৌতুক পুরুষতান্ত্রিক অধিকারের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। উচ্চ বেতনের চাকরিরত নারীকেও গৃহে আশ্রিত হিসেবে দেখা হয় এবং যৌতুক পুরুষের অধিকার হিসেবে গণ্য করা হয়।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, যৌতুক প্রথা শুধু অর্থনৈতিক বিষয় নয়, এটি পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতার ফসল। সমাজে মেয়েদের বোঝা হিসেবে দেখা এবং দ্রুত বিয়ে দিয়ে দায়মুক্ত হওয়ার প্রবণতা যৌতুক মৃত্যুকে নিত্যদিনের ঘটনায় পরিণত করেছে।

নিক্কি ভাটির মতো হাজারো নারীর মৃত্যু প্রতিদিন ভারতের সমাজে যৌতুকের কালো ছায়া মনে করিয়ে দেয়। এনসিআরবি-র ভয়ানক পরিসংখ্যান দেখায় যে, আইনি সংস্কার এবং কঠোর শাস্তির পাশাপাশি গভীর সামাজিক সংস্কার ছাড়া এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব নয়। প্রতিদিন ২০ জন নারীর প্রাণহানির এই ভয়াবহ বাস্তবতা পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজন সমগ্র সমাজের সম্মিলিত প্রচেষ্টা।

About Author
Avatar

আমাদের স্টাফ রিপোর্টারগণ সর্বদা নিষ্ঠার সাথে কাজ করে যাচ্ছেন যাতে আপনি বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের সর্বশেষ ও গুরুত্বপূর্ণ খবর পেতে পারেন। তাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও প্রতিশ্রুতি আমাদের ওয়েবসাইটকে একটি বিশ্বস্ত তথ্যের উৎস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।তারা নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ রিপোর্টিংয়ে বিশ্বাসী, দ্রুত পরিবর্তনশীল পরিস্থিতিতে তাৎক্ষণিক প্রতিবেদন তৈরিতে সক্ষম