অশ্লীল ও সফট পর্ন কনটেন্ট প্রচারের অভিযোগে কেন্দ্রীয় সরকার শুক্রবার (২৫ জুলাই ২০২৫) উল্লু, অল্ট বালাজি, ডেসিফ্লিক্স-সহ মোট ২৫টি ওটিটি প্ল্যাটফর্ম নিষিদ্ধ করেছে। তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রক এক বিজ্ঞপ্তিতে দেশের সমস্ত ইন্টারনেট পরিষেবা প্রদানকারী সংস্থাকে (আইএসপি) এই অ্যাপ ও ওয়েবসাইটগুলির জনসাধারণের প্রবেশাধিকার বন্ধ করে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে।
সূত্রের খবর অনুযায়ী, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রক আপত্তিকর বিজ্ঞাপনের ২৫টি লিঙ্ক শনাক্ত করেছে, যার মধ্যে পর্নোগ্রাফিক বিষয়বস্তু রয়েছে। ইলেকট্রনিক্স এবং তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রক (MeitY) একাধিক অভিযোগ এবং প্রতিবেদনের ভিত্তিতে এই ব্যবস্থা নিয়েছে। অভিযোগ করা হয়েছে যে, এই অ্যাপগুলি কোনও নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই ‘সফ্ট পর্ন কনটেন্ট’ দেখাত, যা সমাজের জন্য, বিশেষ করে অপ্রাপ্তবয়স্কদের জন্য ক্ষতিকর।
নিষিদ্ধ ওটিটি প্ল্যাটফর্মের তালিকায় রয়েছে অলট বালাজি, উল্লু, বিগ শটস অ্যাপ, দেশিফ্লিক্স, বুমেক্স, নাভারাসা লাইট, গুলাব অ্যাপ, কঙ্গন অ্যাপ, বুল অ্যাপ, জলওয়া অ্যাপ, ওয়াও এন্টারটেইনমেন্ট, লুক এন্টারটেইনমেন্ট, হিটপ্রাইম, ফেনেও, শোএক্স, সোল টকিজ, হটএক্স ভিআইপি, আড্ডা টিভি, হালচাল অ্যাপ, মুডএক্স, নিয়নএক্স ভিআইপি, ফুগি, মোজফ্লিক্স এবং ট্রাইফ্লিক্স।
মন্ত্রকের বিবৃতি অনুযায়ী, তথ্য প্রযুক্তি আইন ২০০০ এবং তথ্য প্রযুক্তি আইন বিধি (মধ্যস্থতাকারী বিধি, ডিজিটাল মিডিয়া এথিক্স কোড) ২০২১ অনুসারে বেআইনি তথ্য অপসারণ এবং অ্যাক্সেস নিষ্ক্রিয় করার জন্য মধ্যস্থতাকারীরা দায়ী। এই বিধিমালায় স্পষ্ট করেই বলা হয়েছে যে এই পদক্ষেপের লক্ষ্য হল যৌনতাপূর্ণ এবং ভারতীয় আইনি ও সাংস্কৃতিক মান লঙ্ঘনকারী বিষয়বস্তুর প্রচার রোধ করা।
প্রমাণিত হয়েছে যে এই সমস্ত অ্যাপগুলি বিভিন্ন আইন লঙ্ঘন করেছে। এর মধ্যে রয়েছে ভারতের তথ্য-প্রযুক্তি আইন ২০০০-এর ৬৷ ও ৬৷এ নং ধারা, ভারতীয় দণ্ডবিধির ২৯৪ নং ধারা এবং নারী অশ্লীল চিত্রায়ণ প্রতিরোধী আইন, ১৯৮৬। সরকারের তরফে স্পষ্টভাবে এই ওয়েবসাইট বা প্ল্যাটফর্মগুলিতে সাধারণ মানুষের অ্যাক্সেস নিষ্ক্রিয় বা অপসারণের নির্দেশ দিয়েছে।
দীর্ঘদিন ধরে উল্লু অ্যাপের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ জমা পড়েছিল। ২০১৮ সালে বিভু আগরওয়াল কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ULLU অ্যাপটি সাহসী ও বিতর্কিত কনটেন্টের জন্য দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। তবে সম্প্রতি এটি একাধিকবার অভিযুক্ত হয়েছে অশ্লীল ও অনৈতিক বিষয়বস্তুর কারণে। ‘হাউস অ্যারেস্ট’ নামক একটি অনুষ্ঠান যা আজাজ খান সঞ্চালনা করেছিলেন, কনটেন্টের ধরনে আপত্তি ওঠার পর স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়।
অনুরূপভাবে একতা কাপুরের ALTBalaji—যা পরবর্তীতে ALTT নামে পরিচিত হয়—প্রাপ্তবয়স্কদের থিম ভিত্তিক ওয়েব সিরিজ এবং যৌনতা-ঘনিষ্ঠ বিষয়বস্তুর জন্য বহুদিন ধরেই সমালোচিত। ২০২৪ সালে “গন্দি বাত” সিরিজের এক পর্বে নাবালিকাদের অনুপযুক্তভাবে চিত্রিত করার অভিযোগে একতা ও তার মা শোভা কাপুরের বিরুদ্ধে POCSO আইনে মামলা করা হয়।
এটি কিন্তু প্রথমবার নয় যে সরকার এই ধরনের কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে। গত বছর মার্চ মাসে, মন্ত্রণালয় অশ্লীল বিষয়বস্তু দেখানোর অভিযোগে ১৮টি ওটিটি প্ল্যাটফর্মের ১৯টি ওয়েবসাইট, ১০টি অ্যাপ এবং ৫৭টি সোশ্যাল মিডিয়া হ্যান্ডল নিষিদ্ধ করেছিল। সেই সময়ে নিষিদ্ধ ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলির মধ্যে ছিল ড্রিমস ফিল্মস, নিয়ন, এক্স ভিআইপি, মুডএক্স, বেশরামস, ভুভি, মোজফ্লিক্স, ইয়েসমা, হান্টার্স, হট শটস ভিআইপি, ফুগি, আনকাট আড্ডা, র্যাবিট, ট্রাই ফ্লিকস, এক্সট্রামুড, চিকুফ্লিক্স, এক্স প্রাইম, নুফ্লিক্স এবং প্রাইম প্লে।
কেন্দ্রীয় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী অনুরাগ সিং ঠাকুর বারবার প্ল্যাটফর্মগুলির দায়িত্বের উপর জোর দিয়েছেন। তাঁর দাবি, সৃজনশীল অভিব্যক্তির আড়ালে অশ্লীলতা এবং নিজেদের দায়িত্বের অপব্যবহার করে কিছু প্রচার না করাই উচিত। ২০২৪ সালের ১২ মার্চ অশ্লীল কনটেন্ট দেখানোয়ে ১৮টি ওটিটি প্ল্যাটফর্ম বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন অনুরাগ ঠাকুর।
শুক্রবার এই প্ল্যাটফর্মগুলি ব্যান হওয়ার পর সরকারের প্রশংসা করেছেন শিবসেনা নেত্রী প্রিয়াঙ্কা চতুর্বেদী। বিষয়টি দুর্দান্ত হয়েছে বলেও জানান তিনি। এই বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য জানিয়ে তিনি নিজের X হ্যান্ডেলে লেখেন, “এটা দারুন খবর। বিশেষ করে উল্লু এবং অল্ট বালাজি – এই দুটি অ্যাপের কথা বলছিলাম, বিশেষ করে তাদের কনটেন্টের জন্য, যোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তির স্থায়ী কমিটিতে এটি উত্থাপন করেছিলাম।”
আইনি দিক থেকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ভারতীয় আইন অনুযায়ী আইটি আইনের ধারা ৬৷ এবং ৬৷এ অনুযায়ী, বৈদ্যুতিক মাধ্যমে কোনওভাবে অশ্লীল বা যৌন উত্তেজক কোনও কিছু দেখানো যায় না। একইভাবে ভারতীয় ন্যায় সংহিতার ধারা ২৯৪ অনুযায়ী গানের দৃশ্যে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গিও নিষিদ্ধ। আবার ১৯৮৬ সালের আইন অনুযায়ী, কোনও মাধ্যমেই নারীকে অশ্লীল ভাবে উপস্থাপন করা যায় না।
এই নিষেধাজ্ঞার আগে বেশ কিছু আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। চলতি বছরের এপ্রিলে সুপ্রিম কোর্ট ওটিটি এবং সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে যৌন উত্তেজক বিষয়বস্তু স্ট্রিমিংয়ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য একটি জনস্বার্থ মামলা দায়ের করা হয়েছিল। সেই মামলার পরিপ্রেক্ষিতে আদালতের তরফ থেকে কেন্দ্র এবং প্রধান ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলিকে নোটিশ জারি করা হয়েছিল।
নিষেধাজ্ঞা জারির প্রক্রিয়ায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় (MHA), নারী ও শিশু উন্নয়ন মন্ত্রণালয় (MWCD), ইলেকট্রনিক্স ও তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় (MeitY), আইন বিষয়ক বিভাগ (DoLA), FICCI এবং CII-এর মতো শিল্প সংস্থা এবং নারী অধিকার ও শিশু অধিকার বিষয়ক বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শের পর এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
পর্নোগ্রাফিক বিষয়বস্তু সহজে নাবালকদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার প্রবণতা চলছে বলেই এই নিষেধাজ্ঞা বলে জানা গিয়েছে। ডিজিটাল কনটেন্ট কোনওমতেই যেন যৌনগন্ধিসুলভ না হয় এবং শালীনতার মাত্রা ছাড়িয়ে না যায়, তা নিশ্চিত করতেই কড়া পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
মিডিয়া রিপোর্ট অনুসারে এই পদক্ষেপটি ডিজিটাল কনটেন্ট নিয়ন্ত্রণ প্রয়োগ এবং দেশে আইনের মান্যতা নিশ্চিত করতে সরকারের প্রতিশ্রুতির প্রতিফলন ঘটায়। এমআইবি টেলিযোগাযোগ বিভাগের পরিচালককে ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডারদের দ্বারা অনুমোদন আরও সহজতর করার অনুরোধ জানিয়েছে।
এই নিষেধাজ্ঞার মূল লক্ষ্য হল অশ্লীল সামগ্রীর সহজলভ্যতা রোধ করা, বিশেষ করে অপ্রাপ্তবয়স্কদের কাছে এবং ডিজিটাল সামগ্রী যাতে শালীনতা এবং আইনের সীমার মধ্যে থাকে তা নিশ্চিত করা। বিভিন্ন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলি যাতে শালীনতা বজায় রাখে এবং আইনের সীমার মধ্যে থাকে, সেটা নিশ্চিত করার জন্যই এই নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। অশ্লীল কনটেন্ট নিষিদ্ধকরণের এই সিদ্ধান্ত ভারতের ডিজিটাল মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।