দিল্লি এবং উত্তর ভারতের শহরগুলো যখন বিষাক্ত বায়ু দূষণে হাঁসফাঁস করছে, ঠিক তখনই ভারতের কিছু শহর তাদের স্বচ্ছ এবং শুদ্ধ বায়ুর জন্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাচ্ছে । ২০২৫ সালের বর্তমান তথ্য অনুযায়ী, গ্যাংটক, আইজল, শিলং, থাঞ্জাভুর এবং চামরাজনগর ভারতের সবচেয়ে কম এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (AQI) সহ শহর হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে । সেন্ট্রাল পলিউশন কন্ট্রোল বোর্ড (CPCB) এর সর্বশেষ পর্যবেক্ষণ অনুসারে, এই শহরগুলোর AQI ১৩ থেকে ৫০ এর মধ্যে রয়েছে, যা ‘ভালো’ এবং ‘সন্তোষজনক’ বিভাগে পড়ে ।
ভারতে বায়ু দূষণের বর্তমান পরিস্থিতি
২০২৫ সালের এয়ার কোয়ালিটি লাইফ ইনডেক্স (AQLI) রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতের সমগ্র জনসংখ্যা এমন এলাকায় বাস করে যেখানে বার্ষিক গড় পার্টিকুলেট ম্যাটার (PM2.5) দূষণ স্তর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) নির্ধারিত ৫ μg/m³ সীমা অতিক্রম করেছে । উত্তর ভারতের সমভূমি অঞ্চল সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত, যেখানে প্রায় ৫৪৪.৪ মিলিয়ন মানুষ অস্বাস্থ্যকর বায়ুতে শ্বাস নিচ্ছে । হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে যে দীর্ঘমেয়াদী বায়ু দূষণের কারণে ভারতে বছরে প্রায় ১.৫ মিলিয়ন মৃত্যু ঘটছে ।
ভারতের সবচেয়ে পরিষ্কার বায়ুর শহরগুলো
১. গ্যাংটক, সিকিম (AQI: ৩৪)
সিকিমের রাজধানী গ্যাংটক বর্তমানে ভারতের সবচেয়ে পরিষ্কার বায়ুর শহর হিসেবে প্রথম স্থানে রয়েছে । ২০২৫ সালের ১ ডিসেম্বরের রিয়েল-টাইম ডেটা অনুযায়ী, শহরটির AQI মাত্র ৩৪, যা ‘ভালো’ বিভাগে পড়ে । শহরটির PM2.5 মাত্র ৬ μg/m³ এবং PM10 মাত্র ৯ μg/m³, যা WHO-এর নির্দেশিকার অনেক নিচে ।
গ্যাংটক তার পরিষ্কার বায়ুর জন্য হিমালয়ের প্রাকৃতিক ভূগোলের সুবিধা পায়। শহরটি ঘন বনাঞ্চলে ঘেরা এবং যানবাহন নিয়ন্ত্রণে কঠোর নীতি অনুসরণ করে । সিকিম সরকার পরিবেশ রক্ষায় জৈব কৃষি এবং প্লাস্টিক নিষিদ্ধকরণ সহ বিভিন্ন পরিবেশবান্ধব উদ্যোগ গ্রহণ করেছে ।
গুগল ম্যাপসে এয়ার কোয়ালিটি চেক করুন মাত্র ৩০ সেকেন্ডে! আপনার ফুসফুসকে বাঁচান এই সহজ ট্রিক দিয়ে
২. আইজল, মিজোরাম (AQI: ২৯-৩২)
মিজোরামের রাজধানী আইজল ভারতের অন্যতম পরিচ্ছন্ন বায়ুর শহর হিসেবে স্বীকৃত । ২০২৪ সালের নভেম্বরে, শহরটি ২৯ AQI রেকর্ড করেছে, যা সমগ্র ভারতে সর্বনিম্ন । এমনকি ২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে আইজল PM2.5 স্তরে ভারতের সবচেয়ে পরিষ্কার শহর হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিল, মাত্র ১৩.৮ μg/m³ সহ ।
আইজল তার পাহাড়ি ভূগোল এবং পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাতের কারণে প্রাকৃতিকভাবে দূষণমুক্ত থাকে। মিজোরাম রাজ্যে শিল্প কারখানার অনুপস্থিতি এবং জনসংখ্যার কম ঘনত্ব বায়ুর মান উন্নত রাখতে সাহায্য করে । শহরটির সবুজ আচ্ছাদন এবং পরিবেশ সংরক্ষণে স্থানীয় জনগণের সচেতনতা এর পরিচ্ছন্নতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে
৩. শিলং, মেঘালয় (AQI: ১৭-৫২)
মেঘালয়ের রাজধানী শিলং “পূর্বের স্কটল্যান্ড” নামে পরিচিত এবং এর বায়ুর মান অসাধারণ । সেন্ট্রাল পলিউশন কন্ট্রোল বোর্ড (CPCB) এর তথ্য অনুযায়ী, শিলং মাত্র ১৭ AQI রেকর্ড করেছে, যা থাঞ্জাভুরের সমান । ১ ডিসেম্বর ২০২৫ এর রিয়েল-টাইম ডেটা অনুসারে, শহরটির AQI ৫২ যা ‘মধ্যম’ বিভাগে পড়ে, কিন্তু PM2.5 মাত্র ১০ μg/m³ ।
শিলং তার উচ্চ উচ্চতা, পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত এবং ঘন বনাঞ্চলের কারণে প্রাকৃতিক বায়ু পরিশোধন ব্যবস্থা উপভোগ করে । শহরটিতে ভারী শিল্প না থাকায় এবং পর্যটন-ভিত্তিক অর্থনীতির কারণে দূষণ ন্যূনতম । মেঘালয়ের পরিবেশ নীতি বন সংরক্ষণ এবং টেকসই উন্নয়নের উপর জোর দেয় ।
৪. থাঞ্জাভুর ও আরিয়ালুর, তামিলনাড়ু (AQI: ১৩-৪৭)
তামিলনাড়ুর থাঞ্জাভুর এবং আরিয়ালুর শহর দুটি দক্ষিণ ভারতের সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন বায়ুর শহরগুলোর মধ্যে রয়েছে । সিপিসিবি-এর তথ্য অনুযায়ী, আরিয়ালুর ২০২৫ সালের নভেম্বরে মাত্র ১৩ AQI রেকর্ড করেছে, যা সমগ্র দেশের সর্বনিম্ন । থাঞ্জাভুর ১৭ AQI রেকর্ড করেছে এবং ৪৭ AQI স্তরেও থেকেছে ।
এই শহরগুলো কৃষি-ভিত্তিক অর্থনীতির উপর নির্ভরশীল, যেখানে ভারী শিল্প এবং যানবাহন দূষণ সীমিত । তামিলনাড়ু রাজ্যের দূষণ নিয়ন্ত্রণ বোর্ড কঠোর পরিবেশগত মান প্রয়োগ করে । উপকূলীয় বায়ু প্রবাহ এবং সবুজ আচ্ছাদন বায়ু পরিশোধনে সহায়তা করে ।
৫. চামরাজনগর ও বাগালকোট, কর্ণাটক (AQI: ৪৪-৫০)
কর্ণাটকের চামরাজনগর এবং বাগালকোট শহরদুটি ভারতের পরিষ্কার বায়ুর শহরগুলোর তালিকায় বারবার উপস্থিত হয় । ২০২৫ সালের তথ্য অনুযায়ী, ভারতের ‘ভালো’ বায়ু মানের ১৩টি শহরের মধ্যে ৭টি (৫৪%) কর্ণাটকে অবস্থিত । চামরাজনগর ৪৪-৫০ AQI রেকর্ড করেছে, যা ‘ভালো’ বিভাগে পড়ে ।
চামরাজনগর তার বনাঞ্চল আচ্ছাদন এবং ঘটপ্রভা নদীর নিকটবর্তী অবস্থানের কারণে পরিষ্কার বায়ু বজায় রাখে । কর্ণাটক সরকার দূষণ নিয়ন্ত্রণে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে এবং সবুজ শক্তি প্রকল্পে বিনিয়োগ করছে । এই শহরগুলোতে ছোট আকারের শিল্প এবং কম জনসংখ্যার ঘনত্ব দূষণ কম রাখতে সহায়তা করে ।
ভারতের শীর্ষ পরিচ্ছন্ন বায়ুর শহরগুলোর তুলনামূলক তালিকা
| শহর | রাজ্য | AQI স্তর | বায়ুর মান বিভাগ | PM2.5 (μg/m³) | বিশেষত্ব |
|---|---|---|---|---|---|
| গ্যাংটক | সিকিম | ৩৪ | ভালো | ৬ | হিমালয়ের পাদদেশে, জৈব রাজ্য |
| আইজল | মিজোরাম | ২৯-৩২ | ভালো | ১৩.৮ | পাহাড়ি ভূগোল, কম শিল্পায়ন |
| শিলং | মেঘালয় | ১৭-৫২ | ভালো-মধ্যম | ১০ | উচ্চ বৃষ্টিপাত, ঘন বনাঞ্চল |
| আরিয়ালুর | তামিলনাড়ু | ১৩ | ভালো | – | কৃষি-ভিত্তিক, কম জনসংখ্যা |
| চামরাজনগর | কর্ণাটক | ৪৪-৫০ | ভালো | – | বনাঞ্চল আচ্ছাদন, নদীর নিকটবর্তী |
পরিচ্ছন্ন বায়ুর স্বাস্থ্য সুবিধা
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, পরিচ্ছন্ন বায়ু শ্বাসপ্রশ্বাসের রোগ, হৃদরোগ এবং ফুসফুসের ক্যান্সারের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করে । AQLI রিপোর্ট অনুসারে, দিল্লি যদি WHO-এর সুপারিশ অনুযায়ী দূষণ কমায়, তাহলে বাসিন্দারা তাদের আয়ুষ্কালে ৮.২ বছর যোগ করতে পারবে । এমনকি ভারতের সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন এলাকায় বসবাসকারীরাও বায়ু আরও পরিশোধিত হলে ৯.৪ মাস বেশি বাঁচতে পারে ।
নিম্ন AQI সহ শহরগুলোতে বসবাসকারীরা শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা যেমন অ্যাজমা, ব্রঙ্কাইটিস এবং COPD থেকে কম ভোগেন । পরিচ্ছন্ন বায়ু মানসিক স্বাস্থ্য উন্নত করে এবং জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি করে । শিশুদের জন্য পরিচ্ছন্ন পরিবেশ তাদের শারীরিক এবং মানসিক বিকাশে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ।
কেন এই শহরগুলো পরিচ্ছন্ন বায়ু বজায় রাখে
ভৌগোলিক সুবিধা
এই শহরগুলোর বেশিরভাগই পাহাড়ি অঞ্চলে অবস্থিত, যেখানে প্রাকৃতিক বায়ু প্রবাহ দূষণকারী পদার্থ দূরে সরিয়ে দেয় । উচ্চ বৃষ্টিপাত এবং সবুজ আচ্ছাদন বায়ু পরিশোধনে প্রাকৃতিক ফিল্টার হিসেবে কাজ করে । উপকূলীয় এবং নদী-সংলগ্ন এলাকায় বায়ু সঞ্চালন ভালো হয়, যা দূষণ কমায় ।
সীমিত শিল্পায়ন
উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলোতে ভারী শিল্প এবং কারখানার অনুপস্থিতি বায়ু দূষণ উল্লেখযোগ্যভাবে কম রাখে । এই অঞ্চলগুলো পর্যটন এবং কৃষি-ভিত্তিক অর্থনীতির উপর নির্ভরশীল, যা পরিবেশবান্ধব । ছোট শহরগুলোতে যানবাহনের ঘনত্ব কম, যা নির্গমন হ্রাস করে ।
সরকারি উদ্যোগ
সিকিম ভারতের প্রথম সম্পূর্ণ জৈব রাজ্য হিসেবে স্বীকৃত, যা রাসায়নিক সার এবং কীটনাশক ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে । কর্ণাটক সরকার CNG ব্যবহার এবং নির্গমন মান কঠোরভাবে প্রয়োগ করছে । তামিলনাড়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণে শক্তিশালী পরিবেশ আইন বাস্তবায়ন করেছে ।
দিল্লির বায়ু দূষণ: AQI ৪০০ ছাড়াল, কঠোর ব্যবস্থা নিল প্রশাসন
অন্যান্য উল্লেখযোগ্য পরিচ্ছন্ন বায়ুর শহর
পুনে মহারাষ্ট্রের অন্যতম বড় শহর হওয়া সত্ত্বেও ৫১ AQI বজায় রেখেছে, যা ‘সন্তোষজনক’ বিভাগে পড়ে । পুনে পশ্চিমঘাট পর্বতমালার কাছাকাছি অবস্থান এবং ভালো বায়ু সঞ্চালনের সুবিধা পায় । শহরটি সবুজ পরিবহন এবং টেকসই উন্নয়নে ক্রমবর্ধমান মনোনিবেশ করছে ।
মুম্বাই ৬০ AQI এবং নাশিক ৬৩ AQI সহ পরিচ্ছন্ন বায়ুর তালিকায় রয়েছে । আহমেদাবাদ ৬৪ AQI সহ একটি শিল্প শহর হওয়া সত্ত্বেও সন্তোষজনক বায়ু মান বজায় রাখে । গুয়াহাটি এবং নাগাঁও আসামের দুটি শহর যেগুলো নিয়মিত ‘ভালো’ বায়ু মানের বিভাগে থাকে ।
দূষিত শহরগুলোর সাথে তুলনা
যেখানে এই শহরগুলো পরিচ্ছন্ন বায়ু উপভোগ করছে, সেখানে দিল্লি, গাজিয়াবাদ এবং নয়ডা ‘অত্যন্ত খারাপ’ এবং ‘গুরুতর’ বায়ু মানের সম্মুখীন হচ্ছে । দিল্লির AQI নিয়মিত ৩০০-৪০০ এর উপরে থাকে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য গুরুতর হুমকি । হাপুর, চণ্ডীগড় এবং বাড্ডি উত্তর ভারতের শহরগুলো যেগুলো ভয়াবহ দূষণে ভুগছে ।
উত্তর ভারতের সমভূমিতে শীতকালে স্থবির বায়ু, পরাল পোড়ানো এবং যানবাহন নির্গমনের কারণে দূষণ চরম পর্যায়ে পৌঁছায় । জানুয়ারি ২০২৫-এ, ২৪০টি শহরের মধ্যে মাত্র ১০৫টি ভারতের জাতীয় পরিবেশ বায়ু মান মান (NAAQS) পূরণ করেছে । WHO-এর দৈনিক নিরাপদ নির্দেশিকা ১৫ μg/m³ পূরণকারী শহর ছিল মাত্র সাতটি।
ভারতের এই পাঁচটি শহর প্রমাণ করে যে টেকসই উন্নয়ন এবং পরিবেশ সংরক্ষণের মাধ্যমে পরিচ্ছন্ন বায়ু বজায় রাখা সম্ভব । গ্যাংটক, আইজল, শিলং, থাঞ্জাভুর এবং চামরাজনগর তাদের প্রাকৃতিক ভূগোল, সীমিত শিল্পায়ন এবং কার্যকর সরকারি নীতির সমন্বয়ে অসাধারণ বায়ু মান অর্জন করেছে । এই শহরগুলো শুধুমাত্র বসবাসের জন্য স্বাস্থ্যকর পরিবেশই প্রদান করে না, বরং অন্যান্য ভারতীয় শহরগুলোর জন্য অনুকরণীয় মডেলও উপস্থাপন করে । বায়ু দূষণ যখন জনস্বাস্থ্যের জন্য প্রধান হুমকি হয়ে উঠেছে, তখন এই শহরগুলোর অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে সারাদেশে পরিচ্ছন্ন বায়ু নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেওয়া জরুরি । সবুজ পরিবহন, বন সংরক্ষণ এবং শিল্প নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে প্রতিটি ভারতীয় শহর স্বাস্থ্যকর এবং বাসযোগ্য হয়ে উঠতে পারে ।











