Dangerous effects of sugar on health: আমরা প্রায় সবাই মিষ্টি খাবারের প্রতি দুর্বল – কেক, চকোলেট, মিষ্টান্ন থেকে শুরু করে কোমল পানীয় পর্যন্ত। কিন্তু এই মিষ্টি স্বাদের পিছনে লুকিয়ে আছে অনেক স্বাস্থ্য ঝুঁকি যা সম্পর্কে আমরা সচেতন নই। গবেষণায় দেখা গেছে, বেশি পরিমাণে চিনি সেবন হৃদরোগ থেকে শুরু করে ক্যান্সার পর্যন্ত বিভিন্ন জটিল রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। আমেরিকান প্রতি ১০ জনের মধ্যে ১ জন তাদের দৈনিক ক্যালোরির এক-চতুর্থাংশ বা তার বেশি অতিরিক্ত চিনি থেকে পান, যা স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। আসুন জেনে নেই চিনির সেই ভয়ঙ্কর ৫টি ক্ষতি, যা সাধারণত ডাক্তাররা আমাদের বিস্তারিত বলেন না।
হৃদরোগের ঝুঁকি বৃদ্ধি
অতিরিক্ত চিনি সেবন হৃদরোগের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়ে দেয়। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের একটি দীর্ঘমেয়াদী গবেষণায় দেখা গেছে, যারা তাদের দৈনিক ক্যালোরির ১৭% থেকে ২১% অতিরিক্ত চিনি থেকে পান, তাদের হৃদরোগে মৃত্যুর ঝুঁকি ৩৮% বেশি, তুলনায় যারা মাত্র ৮% ক্যালোরি চিনি থেকে গ্রহণ করেন।
চিনি কীভাবে হৃদয়কে ক্ষতিগ্রস্ত করে:
-
রক্তে অতিরিক্ত ইনসুলিন ধমনীর দেয়ালে প্রদাহ সৃষ্টি করে, যা কালক্রমে ধমনী পুরু ও কঠিন করে তোলে
-
দীর্ঘকালীন প্রদাহ হৃদরোগের প্রধান কারণগুলির একটি
-
উচ্চ রক্তচাপ সৃষ্টি করে, যা হৃদরোগের প্রধান ঝুঁকির কারণ
-
রক্তে ট্রাইগ্লিসারাইড বাড়ায়, যা সরাসরি হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়
একটি বিস্তৃত অধ্যয়নে দেখা গেছে, প্রতি সপ্তাহে আটটির বেশি চিনিযুক্ত পানীয় সেবন স্ট্রোকের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়ে দেয়6। মূলত, যত বেশি চিনি গ্রহণ, তত বেশি হৃদরোগের ঝুঁকি।
ডায়াবেটিস এবং মেটাবলিক সিন্ড্রোম
অতিরিক্ত চিনি সেবন সরাসরি ডায়াবেটিস সৃষ্টি না করলেও, এটি টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়ে দেয়। চিনিযুক্ত পানীয় বা প্রক্রিয়াজাত খাবার থেকে অতিরিক্ত ক্যালোরি গ্রহণ ওজন বৃদ্ধি ঘটায়, যা ডায়াবেটিসের প্রধান ঝুঁকির কারণ।
চিনি এবং ডায়াবেটিসের সম্পর্ক:
-
দীর্ঘ সময় ধরে অতিরিক্ত চিনি গ্রহণ ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স সৃষ্টি করে
-
পাঁচ বছরের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যারা নিয়মিত চিনিযুক্ত পানীয় এবং ১০০% ফলের জুস পান করেন, তাদের টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বেশি
-
চিনি শরীরে গ্লুকোজ মাত্রা বাড়ায়, যা অগ্ন্যাশয় থেকে অতিরিক্ত ইনসুলিন নিঃসরণের কারণ হয়
-
শরীর ক্রমশ ইনসুলিনের প্রতি কম সংবেদনশীল হয়ে পড়ে, যা ডায়াবেটিসের দিকে নিয়ে যায়
একটি ১২ আউন্স (৪৭৩ মিলি) সোডা ক্যানে প্রায় ৩৯ গ্রাম চিনি থাকে, যা দৈনিক সুপারিশকৃত চিনির প্রায় পুরো পরিমাণের কাছাকাছি।
ক্যান্সারের ঝুঁকি বৃদ্ধি
অতিরিক্ত চিনি সেবনের সাথে বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সারের একটি চমকপ্রদ সম্পর্ক রয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, চিনিযুক্ত খাবার শরীরে প্রদাহ ও ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স সৃষ্টি করে, যা ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।
চিনি এবং ক্যান্সারের সম্পর্ক:
-
প্রতিদিন ২৫ গ্রাম বেশি ফ্রুক্টোজ গ্রহণ অগ্ন্যাশয়ের ক্যান্সারের ঝুঁকি ২২% পর্যন্ত বাড়ায়
-
উচ্চ চিনিযুক্ত খাবারের কারণে স্থূলতা বাড়ে, যা বিভিন্ন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়
-
সুক্রোজ বা টেবিল সুগার এবং মিষ্টি খাবার ও পানীয় অন্ননালীর ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়
-
শরীরে দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহ, যা চিনি দ্বারা সৃষ্ট হয়, ক্যান্সার কোষের বৃদ্ধিকে উৎসাহিত করে
বিভিন্ন অধ্যয়নে দেখা গেছে, যেসব গবেষণায় চিনিযুক্ত খাবার ও পানীয় নিয়ে করা হয়েছে, তার ৮টিতে ২৩% থেকে ২০০% পর্যন্ত ক্যান্সারের ঝুঁকি বৃদ্ধি পাওয়া গেছে।
মানসিক স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব
চিনি শুধু শারীরিক স্বাস্থ্যেই নয়, মানসিক স্বাস্থ্যের উপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এটি এমন একটি বিষয় যা ডাক্তাররা প্রায়ই রোগীদের বলেন না।
চিনি ও মানসিক স্বাস্থ্যের সম্পর্ক:
-
উচ্চ চিনিযুক্ত খাবার বিষণ্ণতা ও মেজাজের অসুস্থতার ঝুঁকি বাড়ায়
-
একটি ২০১৭ সালের গবেষণায় দেখা গেছে, পুরুষদের মধ্যে যারা প্রতিদিন ৬৭ গ্রাম বা তার বেশি চিনি গ্রহণ করেন, তাদের বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা ২৩% বেশি, তুলনায় যারা ৪০ গ্রামের কম গ্রহণ করেন
-
চিনি সেবনের এক ঘন্টা পরেই ক্লান্তি ও সতর্কতা কমে যায়
-
দীর্ঘকালীন চিনি সেবন ডোপামিন নিঃসরণ ব্যবস্থায় ব্যাঘাত সৃষ্টি করে, যা আনন্দ অনুভূতি নিয়ন্ত্রণ করে
-
চিনির কারণে শক্তির হঠাৎ পতন, মেজাজ পরিবর্তন এবং আসক্তিমূলক আচরণ দেখা দিতে পারে
উল্লেখযোগ্যভাবে, চিনি সেবনের ফলে জ্ঞানীয় অক্ষমতা, স্মৃতি সমস্যা, এবং উদ্বেগ-বিষণ্ণতার মতো আবেগজনিত ব্যাধিও দেখা দিতে পারে।
ত্বকের স্বাস্থ্য ও প্রাকৃতিক বয়স বৃদ্ধি
অতিরিক্ত চিনি আপনাকে দ্রুত বয়স্ক দেখাতে পারে, যা অনেক সৌন্দর্য বিশেষজ্ঞও প্রায়শই উল্লেখ করেন না।
চিনি কীভাবে ত্বকের বয়স বাড়ায়:
-
অতিরিক্ত চিনি রক্তে প্রোটিনের সাথে সংযুক্ত হয়ে “AGEs” (Advanced Glycation End products) নামক ক্ষতিকর অণু তৈরি করে
-
এই AGEs ত্বকের কোলাজেন ও ইলাস্টিন – যা ত্বককে টানটান ও যৌবনসুলভ রাখে – ক্ষতিগ্রস্ত করে
-
ফলস্বরূপ, ত্বকে বলিরেখা এবং ঝুলে পড়া ত্বক দেখা দেয়
-
দীর্ঘমেয়াদী প্রদাহ, যা চিনি দ্বারা সৃষ্ট হয়, ত্বকের কোষের স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করে
একটি ২০১৮ সালের চীনের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের উপর করা অধ্যয়নে দেখা গেছে, যারা সপ্তাহে সাত বার বা তার বেশি মিষ্টি পানীয় পান করেন, তাদের মাঝারি বা তীব্র অ্যাকনে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
অন্যান্য মারাত্মক স্বাস্থ্য সমস্যা
উপরের পাঁচটি প্রধান ক্ষতি ছাড়াও, চিনি আরও অনেক স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি করে যা অনেকেই জানেন না:
অস্থিসন্ধির ব্যথা:
-
গবেষণায় দেখা গেছে, অতিরিক্ত মিষ্টি খাবার সেবন শরীরে প্রদাহ সৃষ্টি করে অস্থিসন্ধির ব্যথা বাড়ায়
-
যারা বেশি চিনি খান বা পান করেন, তাদের রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস হওয়ার সম্ভাবনা বেশি
দাঁতের ক্ষয়:
-
চিনি মুখের ব্যাকটেরিয়াকে খাদ্য যোগায়, যা অ্যাসিড উৎপন্ন করে দাঁতের এনামেল ক্ষয় করে
-
যারা প্রায়ই চিনিযুক্ত খাবার খান, বিশেষ করে খাবারের মধ্যবর্তী সময়ে স্ন্যাকস বা মিষ্টি পানীয় হিসেবে, তাদের দাঁত ক্ষয়ের সম্ভাবনা বেশি
কিডনি রোগ:
-
ফ্রুক্টোজ রক্তে ইউরেট বাড়িয়ে কিডনি রোগের ঝুঁকি বাড়ায়
-
নিয়মিত উচ্চ রক্ত শর্করা কিডনির সূক্ষ্ম রক্তনালীগুলিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে
লিভারের ক্ষতি:
-
অতিরিক্ত চিনি ফ্যাটি লিভার রোগের কারণ হতে পারে
-
এটি লিভারের ফ্যাট জমা এবং লিভারের কোষ ক্ষতিগ্রস্ত করে
জ্ঞানীয় অবনতি:
-
উচ্চ-চিনিযুক্ত খাবার স্মৃতিশক্তি হ্রাস করে এবং ডিমেনশিয়া, আলঝেইমার রোগ, এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়
চিনি সেবন কমানোর উপায়
আপনার খাদ্যাভ্যাসে চিনি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য কিছু সহজ উপায় রয়েছে:
-
প্রক্রিয়াজাত খাবার এড়িয়ে চলুন: সম্পূর্ণ, অপ্রক্রিয়াজাত খাবার খাওয়ার দিকে মনোযোগ দিলে স্বাভাবিকভাবেই আপনার খাদ্যে চিনির পরিমাণ কমে যাবে
-
চিনিযুক্ত পানীয় সীমিত করুন: একটি সোডা ক্যানে প্রায় ৩৯ গ্রাম চিনি থাকে, তাই পরিবর্তে পানি বা চিনিমুক্ত বিকল্প বেছে নিন
-
লেবেল পড়ুন: খাবারের প্যাকেটে “added sugar” বা “যোগ করা চিনি” সম্পর্কে সচেতন থাকুন, এবং প্রতি সার্ভিংয়ে ১০ গ্রামের বেশি চিনি আছে এমন পণ্য এড়িয়ে চলুন
-
প্রাকৃতিক মিষ্টি বিকল্প ব্যবহার করুন: তাজা ফল, শুকনো ফল, বা মসলা যেমন দারুচিনি দিয়ে খাবারে প্রাকৃতিক মিষ্টতা যোগ করুন
-
ধীরে ধীরে কমান: হঠাৎ করে সব চিনি বাদ না দিয়ে, ধীরে ধীরে আপনার চিনির অভ্যাস কমানোর চেষ্টা করুন
চিনি আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য যে ভয়ঙ্কর ক্ষতি করতে পারে, তা অবশ্যই উপেক্ষা করার মতো নয়। হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, ক্যান্সার, মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা, এবং ত্বকের অকাল বার্ধক্য – এসব গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যার পিছনে চিনির ভূমিকা এখন বিজ্ঞানসম্মতভাবে প্রমাণিত।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রতিদিন ২৫ গ্রামের (প্রায় ৬ চা চামচ) কম চিনি গ্রহণের পরামর্শ দেয়, এবং চিনিযুক্ত পানীয় সপ্তাহে একটি সার্ভিংয়ের (প্রায় ২০০-৩৫৫ মিলি) কম সীমিত রাখার সুপারিশ করে। স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের জন্য খাদ্যে চিনির পরিমাণ সম্পর্কে সচেতন হওয়া এবং সেগুলি নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস অবলম্বন করে, চিনির পরিমাণ কমিয়ে, আমরা আমাদের জীবনের মান উন্নত করতে এবং দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্য সমস্যা এড়াতে পারি। মনে রাখবেন, ছোট পরিবর্তনও দীর্ঘমেয়াদে বড় প্রভাব ফেলতে পারে।