Haunted Places in Kolkata: কলকাতা শুধু সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যের শহর নয়, এর অন্ধকার দিকও রয়েছে। শহরের মনোরম সৌন্দর্যের আড়ালে লুকিয়ে আছে এমন কিছু রহস্যময় স্থান, যেগুলি শিহরণ জাগাতে যথেষ্ট। আজকের এই ব্লগে আমরা এমনই ৫টি ভয়ঙ্কর জায়গা নিয়ে আলোচনা করব, যেগুলি বহু বছর ধরে ভূতুড়ে ঘটনার সাক্ষী হয়ে আছে। এসব জায়গা কলকাতার ঐতিহাসিক মূল্য বহন করে, কিন্তু সেইসাথে অলৌকিক ঘটনার জন্যও বিখ্যাত। চলুন জেনে নেই সেই রহস্যময় স্থানগুলির কথা, যেগুলি আপনাকে শিহরিত করবে।
জাতীয় গ্রন্থাগার – একটি অদৃশ্য কক্ষের রহস্য
কলকাতার জাতীয় গ্রন্থাগার শুধুমাত্র বইয়ের সংগ্রহশালা নয়, এটি ভারতের অন্যতম ভূতুড়ে স্থান হিসেবেও পরিচিত। ২৫০ বছরের পুরনো এই ভবনটি ব্রিটিশ আমলে গভর্নর জেনারেলের বাসভবন হিসেবে ব্যবহৃত হত। ২০১০ সালে ভবনের সংস্কারের সময় একটি রহস্যময় ঘটনা ঘটে – সেখানে একটি গোপন কক্ষ আবিষ্কার হয়, যার কোনো প্রবেশপথ নেই। দুই শতাব্দী ধরে অস্পৃষ্ট থাকা এই কক্ষটি নিয়ে প্রত্নতাত্ত্বিকরা কোনো ধারণা দিতে পারেননি – এটি হয়তো একটি নির্যাতন কক্ষ, বা কোনো হতভাগ্য ব্যক্তির সমাধি, অথবা কোনো ধন-সম্পদ লুকিয়ে রাখার জায়গা।
লেডি মেটকাফ, এক সময়কার গভর্নর জেনারেলের স্ত্রী, যিনি পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে খুব কড়া ছিলেন, তার আত্মা নাকি এখনও গ্রন্থাগারের বইয়ের তাকগুলির মধ্যে ঘুরে বেড়ায়, পুরনো বই ও তাকগুলি থেকে ধুলো পরিষ্কার করে। অনেক সময় নিরব অবস্থায় পায়ের শব্দ, দেয়ালে ছায়া এবং পাঠকরা অনুভব করেন যেন কেউ তাদের ঘাড়ের উপর দিয়ে শ্বাস ফেলছে। বিশেষ করে যদি কোনো বই যথাস্থানে না রাখা হয়, তখন এই অনুভূতি আরও তীব্র হয়।
আরেকটি ভয়ানক গল্প হল ২০০ বছর পরে, একটি পূর্ণিমার রাতে, বীরবাহাদুর নামে এক চৌকিদার গ্রন্থাগারের পশ্চিম লনে ডিউটি করছিলেন। তিনি একটি পালকি দেখতে পান যা মাঠ পার হয়ে যায়। পালকির ভিতরে একজন সাদা যুবক শায়িত ছিল, যার হাত থেকে রক্ত ঝরছিল, পুরো লনে রক্তের দাগ রেখে যাচ্ছিল।
National Library এর পুরনো ইতিহাস ও অদ্ভুত ঘটনা এটিকে কলকাতার সবচেয়ে রহস্যময় স্থানগুলির একটি করে তুলেছে।
রয়্যাল ক্যালকাটা টার্ফ ক্লাব – সাদা ঘোড়ার প্রেত
১৮৪৭ সালে ব্রিটিশ আমলে প্রতিষ্ঠিত রয়্যাল ক্যালকাটা টার্ফ ক্লাব শুধু ঘোড়দৌড়ের জন্য বিখ্যাত নয়, এর অলৌকিক ইতিহাসের জন্যও জনপ্রিয়। শনিবারের কুয়াশাচ্ছন্ন সকালে, অনেকে একটি সাদা ঘোড়ার প্রেতকে দেখতে পান, যা এখনও দৌড়ের ট্র্যাকে ছুটে বেড়াচ্ছে।
কিংবদন্তি অনুসারে, ১৯৩০-এর দশকে, জর্জ উইলিয়ামস নামক একজন ব্রিটিশ ঘোড়দৌড় প্রেমী, তার সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ ছিল – একটি সুন্দর সাদা ঘোড়া, যার নাম ছিল ‘প্রাইড’। দুর্ভাগ্যক্রমে, একদিন প্রাইডকে নিহত অবস্থায় পাওয়া যায়, তার মাথায় বুলেটের আঘাত ছিল। গল্প অনুযায়ী, উইলিয়ামস ঘোড়াটিকে হত্যা করেছিলেন কারণ সেটি আর রেস জিততে পারছিল না। কিছু লোক বলে যে, উইলিয়ামস মদ্যপ অবস্থায় যখন টাকা হারিয়েছিলেন, তখন হতাশায় ঘোড়াটিকে হত্যা করেছিলেন।
কিন্তু প্রাইডের জন্য সেটাই শেষ দৌড় ছিল না। স্থানীয় লোকেরা বলেন, পূর্ণিমার রাতে, একটি জ্বলজ্বলে সাদা ঘোড়া রেসকোর্সে ঘুরে বেড়ায়। স্থানীয়রা এই আত্মাকে “উইলিয়াম সাহেবের শাদা ঘোড়া” নামে চেনেন।
নিমতলা শ্মশানঘাট – আগোরিদের রহস্যময় কর্মকাণ্ড
নিমতলা শ্মশানঘাট কলকাতার অন্যতম প্রাচীন দাহ-স্থান, যা হিন্দুরা মৃত্যুর পরে দেহ দাহ করার জন্য ব্যবহার করেন। ১৮২৭ সালে নির্মিত এই শ্মশানঘাট, ভৌতিক ঘটনা ও আগোরিদের রহস্যময় কর্মকাণ্ডের জন্য বিখ্যাত।
রাতের বেলায় এখানে অদ্ভুত নীল আলো দেখা যায়, যা মৃতদের আত্মা হিসেবে পরিচিত এবং মনে করা হয় যে, এরা জীবিতদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছে। বিশেষ করে কালী পূজার রাতে, শ্মশান কালী নামক দেবীকে জাগ্রত করার জন্য আগোরিরা অনেক রহস্যময় আচার-অনুষ্ঠান পালন করেন।
স্থানীয়দের অনুসারে, আগোরিরা (যাদের নাম জোরে উচ্চারণ করা উচিত নয়) জ্বলন্ত চিতা থেকে অবশিষ্ট মাংস খেয়ে থাকেন এবং তাদের গুহ্য শক্তি জাগ্রত করতে ব্যবহার করেন। এটি একটি ভয়ঙ্কর জায়গা হয়ে উঠেছে, কারণ লোকেরা আগোরিদের কার্যকলাপকে ভুল বোঝে এবং খুব সহজেই ভয় পেয়ে যায়।
রাতে যারা শ্মশানে গিয়েছেন, তারা প্রায়ই শক্তির অদ্ভুত পরিবর্তন অনুভব করেছেন যা একটি চাপপূর্ণ পরিবেশের সাথে যুক্ত এবং বাতাসে অজানা ফিসফিসানি শোনা যায়।
হেস্টিংস হাউস (ভূত বাংলা) – এক ব্রিটিশ গভর্নরের আত্মা
হেস্টিংস হাউস, যা ‘ভূত বাংলা’ নামেও পরিচিত, একসময় গভর্নর-জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসের বাসভবন ছিল। বর্তমানে এটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে একটি মহিলা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে চালু রয়েছে, কিন্তু ভূতের আবির্ভাবের জন্য বিখ্যাত।
শিক্ষার্থীরা দাবি করেন যে, তারা হেস্টিংসকে নিজেকে ঘোড়ায় চড়ে হারিয়ে যাওয়া বা সন্ধানহীন নথিপত্র খুঁজতে দেখেছেন। পুরানো করিডোরগুলিতে পায়ের শব্দ, হঠাৎ করে তাপমাত্রা কমে যাওয়া এবং আলো জ্বলজ্বল করা শোনা যায়। ম্যানশনের ভয়ঙ্কর ইতিহাস এবং অব্যাখ্যাত ঘটনাগুলির কারণে শিক্ষার্থী ও কর্মচারীদের মধ্যে ব্যাপক ভয় রয়েছ।
প্রতিষ্ঠানের পুরনো করিডোরগুলি অস্বাভাবিক ও শিহরণজাগানো শব্দ সৃষ্টি করে, যা বর্তমান শিক্ষার্থীদের অস্বস্তি ও ভয়ের কারণ। যদিও এটি একটি সম্মানিত কলেজ, তবুও এর রহস্যময় ঘটনাগুলি এটিকে শহরের সবচেয়ে বিখ্যাত ভূতুড়ে স্থানগুলির মধ্যে একটি করে তুলেছে।
পুতুলবাড়ি – পুতুলের বাড়ি নাকি আতঙ্কের বাড়ি?
উত্তর কলকাতায় অবস্থিত পুতুলবাড়ি, যা ‘পুতুলের বাড়ি’ নামেও পরিচিত, একটি শতাব্দী প্রাচীন বাড়ি যা প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত অবস্থায় রয়েছে। ভবনের বাইরের দিকে অদ্ভুত ও ভয়ঙ্কর পুতুলের মূর্তি রয়েছে এবং গল্প অনুযায়ী, বাড়ির মালিকের মেয়ের পুতুলের প্রতি একটি পাগলামো ছিল।
পুতুলবাড়ির একটি করুণ ও ভয়ঙ্কর অতীত রয়েছে – এটি ব্রিটিশ আমলের একটি বাড়ি ছিল যেখানে জমিদারদের দ্বারা নিষ্পাপ মেয়েদের নির্যাতন করা হত7। যদিও কিছু লোক এখনও বাড়ির নীচতলায় বসবাস করেন, উপরের তলাগুলি অলৌকিক ঘটনার কারণে খালি এবং তালাবদ্ধ রাখা হয়েছে।
স্থানীয়রা দ্বিতীয় তলা থেকে মহিলাদের চিৎকার, কান্না, পায়ের শব্দ এবং অদৃশ্য লোকদের অলঙ্কার ও চুড়ির শব্দ শুনতে পান। বিশ্বাস করা হয় যে, নিষ্পাপ মহিলাদের সেই দুর্ভোগী আত্মারা এখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে, যা এটিকে কলকাতার সবচেয়ে ভূতুড়ে স্থানগুলির একটি করে তুলেছে।
ভবনের ভেঙে যাওয়া দেয়াল, অদ্ভুত ও ভয়ঙ্কর পুতুলের মূর্তি যা ছাদ থেকে বেরিয়ে আছে – এ সবকিছু মিলিয়ে Haunted Places in Kolkata তালিকায় পুতুলবাড়ি একটি অন্যতম স্থান।
কলকাতা, যা সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের জন্য পরিচিত, তার অন্ধকার দিকও রয়েছে, যা এই ঐতিহাসিক শহরকে আরও রহস্যময় করে তোলে। জাতীয় গ্রন্থাগারের রহস্যময় কক্ষ, রয়্যাল ক্যালকাটা টার্ফ ক্লাবের সাদা ঘোড়ার প্রেত, নিমতলা শ্মশানঘাটের আগোরিদের কর্মকাণ্ড, হেস্টিংস হাউসের ভূতুড়ে উপস্থিতি এবং পুতুলবাড়ির করুণ ইতিহাস – এই পাঁচটি স্থান haunted places in Kolkata তালিকায় শীর্ষস্থান দখল করেছে।
এই ভূতুড়ে স্থানগুলির গল্প শুধু আতঙ্ক ছড়ায় না, বরং কলকাতার সমৃদ্ধ ও জটিল ইতিহাসেরও প্রতিফলন ঘটায়। এই জায়গাগুলির প্রতিটি নিজের ইতিহাস ও লোককাহিনী নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, যা ব্রিটিশ শাসনকাল থেকে শুরু করে আধুনিক কাল পর্যন্ত বিস্তৃত।
কলকাতা ভ্রমণে এলে, আপনি যদি অ্যাডভেঞ্চার প্রেমী হন এবং অলৌকিক অনুভূতি অনুসন্ধান করতে চান, তাহলে এই পাঁচটি স্থান অবশ্যই আপনার ভ্রমণ তালিকায় রাখুন। তবে সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত, কারণ এই জায়গাগুলিতে ভয়ঙ্কর অতীত ও অলৌকিক উপস্থিতি নিয়ে অনেক গল্প প্রচলিত আছে।কলকাতার এই haunted spots শুধু ভয় নয়, এগুলি শহরের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিরও একটি অংশ। সুতরাং, আপনি যদি সাহসী হন এবং অলৌকিক অভিজ্ঞতা খুঁজছেন, তাহলে কলকাতার এই ভূতুড়ে স্থানগুলি আপনাকে অবশ্যই আকর্ষিত করবে!