চন্দননগরে ফরাসি শাসন থেকে মুক্তির ৭৫তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে একটি বিশেষ উদ্যোগের সূচনা হয়েছে। এই ঐতিহাসিক মুহূর্তে চন্দননগর কলেজের উদ্যোগে হেরিটেজ রিসার্চ সেন্টারের পথচলা শুরু হয়েছে, যার লক্ষ্য এই শহরের সমৃদ্ধ ইতিহাস ও সংস্কৃতি সংরক্ষণ করা। মঙ্গলবার চন্দননগর কলেজ অডিটোরিয়ামে আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে এই কেন্দ্রের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। এই উপলক্ষে চন্দননগরের মেয়র রাম চক্রবর্তী ও ডেপুটি মেয়র মুন্না আগরওয়াল উপস্থিত ছিলেন এবং তারা এই প্রকল্পের জন্য পূর্ণ সমর্থনের আশ্বাস দিয়েছেন। এই কেন্দ্র চন্দননগরের ঐতিহ্যকে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার পাশাপাশি গবেষণার মাধ্যমে এর গৌরবময় অতীতকে আরও গভীরভাবে অনুসন্ধান করবে।
ঘটনার বিস্তারিত বিবরণে প্রকাশ, এই হেরিটেজ রিসার্চ সেন্টারটি চন্দননগর কলেজের একটি দীর্ঘদিনের স্বপ্নের ফল। এর যাত্রা শুরু হয়েছিল ২০২২ সালের ১৮ এপ্রিল, আন্তর্জাতিক হেরিটেজ দিবসে, যখন চন্দননগরের মেয়রের উপস্থিতিতে কলেজের ঐতিহ্য অধ্যয়ন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়। পরে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যনির্বাহী সমিতি এই প্রস্তাবকে স্বীকৃতি দেয়। কলেজের অধ্যক্ষ দেবাশিষ সরকার জানিয়েছেন, গত তিন বছর ধরে হেরিটেজ সংরক্ষণ নিয়ে গবেষণা চলছিল, কিন্তু তা কেবল কলেজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। এবার এই রিসার্চ সেন্টারকে সকলের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে। এই উদ্যোগে চন্দননগর কলেজ প্রাক্তনী অ্যাসোসিয়েশনও যুক্ত হয়েছে। ফলে এটি এখন যৌথ প্রচেষ্টায় পরিচালিত হবে, যার মূল উদ্দেশ্য চন্দননগরের সাধারণ মানুষকে এই গবেষণার সঙ্গে সংযুক্ত করা এবং সমাজের মধ্যে ঐতিহ্যচর্চাকে ছড়িয়ে দেওয়া।
চন্দননগরের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে আরও জানতে গেলে দেখা যায়, এই শহরটি একসময় ফরাসি উপনিবেশ ছিল। ১৯৫০ সালের ২ মে চন্দননগর ফরাসি শাসন থেকে মুক্তি পায় এবং ভারতের সঙ্গে একীভূত হয়। এই ৭৫ বছর পূর্তির প্রাক্কালে হেরিটেজ রিসার্চ সেন্টার প্রতিষ্ঠা একটি প্রতীকী অঙ্গীকার। ফরাসি আমলে এখানে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিল, যা পরে উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হয়। এই কলেজের ইতিহাসে বিপ্লবীদের অবদানও উল্লেখযোগ্য। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় অনেক বিপ্লবী এখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন। উদাহরণস্বরূপ, আলিপুর বোমা মামলায় অভিযুক্ত অরবিন্দ ঘোষ এবং চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের সঙ্গে যুক্ত গনেশ ঘোষ ও অনন্ত সিংহের মতো বিপ্লবীরা চন্দননগরে আত্মগোপন করেছিলেন। ফরাসি শাসনের কারণে ব্রিটিশ পুলিশ এখানে সহজে প্রবেশ করতে পারত না, যা এটিকে বিপ্লবীদের জন্য নিরাপদ আশ্রয় করে তুলেছিল।
এই প্রসঙ্গে আরও গভীরতা যোগ করতে গেলে, চন্দননগরের নামের উৎস নিয়েও আলোচনা করা যায়। কেউ কেউ বলেন, এটি এসেছে চন্দন গাছের প্রাচুর্য থেকে, আবার কেউ মনে করেন শহরের অর্ধচন্দ্রাকৃতি আকারের কারণে এই নাম। ফরাসি আমলে এখানে বাণিজ্যের জন্য গুদামঘর তৈরি হয়েছিল। ১৭৫৭ সালে ব্রিটিশদের সঙ্গে ফরাসিদের যুদ্ধে চন্দননগর লুণ্ঠিত হয়, যার অর্থ পলাশীর যুদ্ধে ব্যবহৃত হয়েছিল। এই ঘটনা ভারতের ইতিহাসে একটি টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে বিবেচিত হয়। এছাড়া, চন্দননগরে জগদ্ধাত্রী পুজোর ঐতিহ্যও বিখ্যাত, যা তিনশো বছরের পুরনো। এই সব ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ করাই রিসার্চ সেন্টারের লক্ষ্য।
সহজ ভাষায় বলতে গেলে, এই রিসার্চ সেন্টার চন্দননগরের পুরনো দিনের গল্পগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে চায়। এটি শুধু বইয়ে বা কাগজে লেখা থাকবে না, বরং মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া হবে। কলেজের হেরিটেজ ভবনে একটি সংগ্রহশালাও গড়ে তোলা হয়েছে, যেখানে বিপ্লবীদের স্মৃতি রক্ষিত আছে। এটি দেশি-বিদেশি পর্যটকদেরও আকর্ষণ করছে। ইতিমধ্যে দুটি বই প্রকাশিত হয়েছে—‘কলেজ ডুপ্লেক্স টু চন্দননগর কলেজ’ এবং ‘চন্দননগর: এ সিটি অফ হেরিটেজ’। এই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আরও তিনটি বই প্রকাশিত হয়, যা চন্দননগরের মেয়র ও ডেপুটি মেয়রের হাতে তুলে দেওয়া হয়।
সব মিলিয়ে, এই হেরিটেজ রিসার্চ সেন্টার চন্দননগরের অতীতকে বর্তমানের সঙ্গে জুড়ে দেওয়ার একটি সেতু। এটি শুধু গবেষণার জায়গা নয়, বরং একটি জীবন্ত ঐতিহ্যের প্রতীক। ফরাসি শাসনমুক্তির ৭৫ বছর পর এই উদ্যোগ শহরের গৌরবময় ইতিহাসকে নতুন করে আলোকিত করবে বলে আশা করা যায়।