Farakka Barrage history and impact: গঙ্গা নদীর বুকে দাঁড়িয়ে থাকা ফারাক্কা বাঁধ ২১ এপ্রিল, ২০২৫ তারিখে পঞ্চাশ বছর পূর্ণ করেছে। পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলায় অবস্থিত এই বাঁধটি ১৯৭৫ সালের একই দিনে কার্যকর হয়েছিল। কলকাতা বন্দরকে বাঁচানোর লক্ষ্যে নির্মিত এই বাঁধ পঞ্চাশ বছর পর আজ নানা প্রশ্নের মুখোমুখি। বিশেষজ্ঞরা প্রশ্ন তুলেছেন – এই বাঁধ কি তার প্রতিশ্রুত সুফল দিতে পেরেছে? নাকি এটি পরিবেশ ও মানুষের জীবনে আরও বেশি ক্ষতি করেছে? পঞ্চাশ বছর পূর্ণ করার এই মাইলফলকে, ফারাক্কা বাঁধের ভবিষ্যৎ নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন – টিকতে পারে আর কতদিন?
ফারাক্কা বাঁধের ইতিহাস ও নির্মাণ কাজ
ফারাক্কা বাঁধের নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছিল ১৯৬১-৬২ সালে এবং সম্পূর্ণ হয়েছিল ১৯৭০ সালে। তবে এটি আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হয় ২১ এপ্রিল, ১৯৭৫ সালে। প্রায় ১২ বছর সময় লেগেছিল এই বিশাল প্রকল্প সম্পূর্ণ করতে। তৎকালীন সময়ে প্রকল্পের মোট ব্যয় হয়েছিল প্রায় ১৩০ কোটি টাকা, যা আজকের মূল্যে কয়েক হাজার কোটি টাকার সমান।
বাঁধের কারিগরি বৈশিষ্ট্য
ফারাক্কা বাঁধটি বিশালাকার। এর দৈর্ঘ্য প্রায় ২.৬২ কিলোমিটার এবং এতে ১০৯টি বে রয়েছে। বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে মাত্র ১৬.৫ কিলোমিটার দূরে গঙ্গা নদীর ওপর নির্মিত এই বাঁধ পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার ফারাক্কা শহরের কাছে অবস্থিত। ফারাক্কা প্রকল্পে তিনটি মূল অংশ রয়েছে:
- ফারাক্কা বাঁধ: ২.৬২ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য, ১০৯টি বে, সর্বনিম্ন বেড লেভেল ১০.৩০ মিটার
- ফিডার ক্যানাল: ৩৮.৩ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য, পরিকল্পিত প্রবাহ ৪০,০০০ কিউসেক
- জঙ্গীপুর বাঁধ: ২১২.৭০ মিটার দৈর্ঘ্য, ১৫টি বে
ফারাক্কা বাঁধের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য
ফারাক্কা বাঁধের মূল উদ্দেশ্য ছিল হুগলী নদীতে পানির প্রবাহ বাড়ানো। এর ফলে:
- কলকাতা বন্দরের নাব্যতা রক্ষা করা
- হুগলী নদীতে পলি জমা রোধ করা
- নৌ-চলাচল উন্নত করা
- বন্যা নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করা
ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে গঙ্গা নদী থেকে প্রায় ৪০,০০০ কিউসেক পানি ফিডার ক্যানালের মাধ্যমে হুগলী নদীতে প্রবাহিত করার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। এর ফলে কলকাতা বন্দরের চারপাশে পলি জমে নদী ভরাট হওয়া রোধ করা সম্ভব হবে বলে আশা করা হয়েছিল।
উজানে ফারাক্কা বাঁধের প্রভাব
পঞ্চাশ বছর পূর্ণ করল ফারাক্কা বাঁধ, কিন্তু উজান অঞ্চলে এর নেতিবাচক প্রভাব দেখা গেছে ব্যাপকভাবে:
পলি জমা ও নদীর প্রশস্ততা বৃদ্ধি
ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের ফলে বাঁধের উজানে (উত্তরে) প্রতি বছর প্রায় ৬৪ কোটি টন পলি জমে। নদীর স্বাভাবিক প্রবাহে বাধা সৃষ্টি হওয়ায় পলি জমার হার বৃদ্ধি পেয়েছে, যা নদীবেডের উচ্চতা বাড়িয়েছে। ফলে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মালদা ও মুর্শিদাবাদ এবং বিহারের পাটনা, বারাউনি, মুঙ্গের, ভাগলপুর ও পূর্ণিয়া জেলায় বন্যার প্রকোপ বৃদ্ধি পেয়েছে।
বন্যার তীব্রতা ও ঘনত্ব বৃদ্ধি
ফারাক্কা বাঁধের কারণে গঙ্গা নদীর জলস্তর প্রায় ৮ মিটার উঁচু হয়েছে। এর ফলে বাঁধের উত্তরের অঞ্চলে, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ ও মালদা এলাকায় বাম তীরে বন্যা দেখা দিয়েছে। ১৯৭১ এবং ১৯৭২ সালে, বাঁধ নির্মাণের পরপরই, প্রচণ্ড বন্যা হয়েছিল।
নদী ভাঙন ও জনসংখ্যা স্থানান্তর
উজান এলাকায় প্রচণ্ড নদী ভাঙন ও জনসংখ্যা স্থানান্তর হয়েছে। মালদা ও মুর্শিদাবাদ জেলার বিস্তীর্ণ এলাকা নদী ভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে। এর ফলে বিহার ও বাংলাদেশের সাথে সীমান্ত বিবাদও দেখা দিয়েছে। গ্রামীণ সম্প্রদায়ের দারিদ্র্যতা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং চরে নতুন শরণার্থীর জন্ম হয়েছে।
ভাটিতে ফারাক্কা বাঁধের প্রভাব
ফারাক্কা বাঁধ পঞ্চাশ বছর পূর্ণ করল, কিন্তু এর নেতিবাচক প্রভাব ভাটিতেও পড়েছে গভীরভাবে:
বাংলাদেশে পানির সংকট
ফারাক্কা বাঁধের কারণে বাংলাদেশের ৭৯টি নদী ও খাল, ৭৫ হাজার পুকুর, হ্রদ ও হাওর শুকিয়ে গেছে। এই প্রাকৃতিক জলসম্পদগুলো বছরের অধিকাংশ সময় শুকনো থাকে। জলের অভাবে কৃষি, মৎস্য, বনায়ন ও নৌ-চলাচল ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি
ফারাক্কা বাঁধের কারণে ১০৯ প্রজাতির মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণীর প্রজনন ও বাসস্থান ধ্বংস হয়েছে। পঙ্গাশ ও ইলিশসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছের চলাচল বাধাগ্রস্ত হওয়ায় মৎস্যজীবীদের জীবনযাত্রা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
লবণাক্ততা বৃদ্ধি
ফারাক্কা বাঁধের কারণে ভাটিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পেয়েছে, যা সুন্দরবনের মত ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। এছাড়া, বাঁধের কারণে ভূগর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিকের প্রবেশ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি স্বরূপ।
রক্ষণাবেক্ষণের সমস্যা ও বর্তমান অবস্থা
পঞ্চাশ বছর পূর্ণ করল ফারাক্কা বাঁধ, কিন্তু এর রক্ষণাবেক্ষণে গুরুতর অবহেলা দেখা গেছে:
ক্যাগের সমালোচনামূলক রিপোর্ট
ভারতের নিয়ন্ত্রক ও মহাহিসাব পরীক্ষক (ক্যাগ) ফারাক্কা বাঁধের অপর্যাপ্ত রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কঠোর সমালোচনা করেছেন। প্রকল্পটির অপর্যাপ্ত রক্ষণাবেক্ষণের কারণে ১৯৮৫ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত বাঁধের গেটগুলি ছয়বার ব্যর্থ হয়েছে। সুরক্ষামূলক কাজ না করে বাঁধের সামগ্রিক নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়েছে।
মরিচা ধরা গেট ও যান্ত্রিক সমস্যা
কেন্দ্রীয় জল কমিশন (CWC) এবং গেট রেগুলেশন কমিটির (GRC) নির্দেশিকা অনুসারে, মরিচা এড়াতে প্রতি চার থেকে ছয় বছর অন্তর গেটগুলো রং করা উচিত। কিন্তু অডিট অনুসারে, এটি হয়নি। ফলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাঠামো যেমন গেট, গেট পরিচালনা ব্যবস্থা এবং নেভিগেশনাল লক ঠিকমতো রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামত করা হয়নি।
ক্ষয়প্রাপ্ত কাঠামো
২০০৬-০৭ থেকে ২০১১-১২ সাল পর্যন্ত নদী ভাঙন প্রতিরোধমূলক কাজে প্রায় ১৮৫ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে। কিন্তু এই কাজে নিয়মিত কর্মীদের ব্যবহার করায় তাদের নিয়মিত কাজ থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছে। অডিট রিপোর্ট অনুসারে, এটি প্রকল্পের প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণ অবহেলার অন্যতম কারণ।
ফারাক্কা বাঁধের ভবিষ্যৎ: প্রশ্ন ও সম্ভাবনা
পঞ্চাশ বছর পূর্ণ করল ফারাক্কা বাঁধ, এই সময়ে এর ভবিষ্যৎ নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে:
স্বাধীন মূল্যায়নের দাবি
অনেক গোষ্ঠী, বিশেষজ্ঞ এবং এমনকি বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার ফারাক্কা বাঁধের স্বাধীন মূল্যায়নের দাবি জানিয়েছেন। এই মূল্যায়নে বাঁধের প্রকৃত খরচ, সুফল এবং প্রভাবগুলি – উভয় অনুমিত ও বাস্তব – বিবেচনা করে এর অস্তিত্বের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।
বাঁধের প্রধান উদ্দেশ্য কি পূরণ হয়েছে?
ফারাক্কা বাঁধের মূল উদ্দেশ্য ছিল কলকাতা বন্দরকে নাব্য করা। কিন্তু প্রমাণিত হয়েছে যে, বাঁধ নির্মাণের পর থেকে কলকাতা বন্দরকে নাব্য রাখতে ড্রেজিংয়ের পরিমাণ আসলে বৃদ্ধি পেয়েছে। তাহলে প্রশ্ন ওঠে – বাঁধটি কি তার প্রধান উদ্দেশ্য পূরণ করতে পেরেছে?
ডিকমিশনিংয়ের সম্ভাবনা
বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার বাঁধ অপসারণের পক্ষে বক্তব্য দিয়েছেন, কারণ বাঁধের কারণে উজানে বন্যার বিস্তার, তীব্রতা ও ঘনত্ব উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। হাজার হাজার মৎস্যজীবীও তাদের জীবিকা হারিয়েছেন, কারণ ইলিশসহ প্রধান লাভজনক মাছ প্রজাতি আর বাঁধের উপরে মাইগ্রেট করতে পারে না।
পঞ্চাশ বছর পরে ফারাক্কা: সাফল্য না ব্যর্থতা?
ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল কলকাতা বন্দরকে বাঁচানো। কিন্তু পঞ্চাশ বছর পরে দেখা যাচ্ছে, বাঁধটি এই উদ্দেশ্য পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। বরং এটি নানা সমস্যার জন্ম দিয়েছে:
- উজানে পলি জমা ও বন্যার প্রকোপ বৃদ্ধি
- নদী ভাঙনের কারণে হাজার হাজার মানুষের ঘরবাড়ি হারানো
- মৎস্যসম্পদের ব্যাপক ক্ষতি
- বাংলাদেশে জলসঙ্কট ও পরিবেশগত সমস্যা
- রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বাঁধের কাঠামোগত অবক্ষয়
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশেষজ্ঞরা স্পষ্টভাবে বলেছেন যে, একটি বাঁধের উপযোগী জীবনকাল হিসেবে ৫০ বছর ধরা হয়। সেই হিসাবে ফারাক্কা বাঁধ তার নিয়মিত জীবনকাল শেষ করেছে। এখন সময় এসেছে একটি স্বাধীন ও বিস্তৃত পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার – এই বাঁধ টিকবে আর কতদিন? এটি রাখা হবে নাকি অপসারণ করা হবে?
পঞ্চাশ বছর পূর্ণ করল ফারাক্কা বাঁধ, কিন্তু প্রশ্ন রয়ে গেছে – মেঘের আড়ালে থাকা এই বিশাল স্থাপনা কতটা উপকারী, আর কতটা ক্ষতিকর? সময়ই বলবে এই প্রকল্পের চূড়ান্ত পরিণতি।