Hidden NASA space missions: ন্যাশনাল অ্যারোনটিক্স অ্যান্ড স্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বা NASA-র নাম শুনলেই আমাদের চোখে ভেসে ওঠে চাঁদে মানুষের প্রথম পদক্ষেপ, মঙ্গল গ্রহে রোভার পাঠানো বা হাবল টেলিস্কোপের তোলা মহাবিশ্বের বিস্ময়কর সব ছবি। NASA মানেই যেন উন্মুক্ত বিজ্ঞান, গবেষণা আর আবিষ্কারের জয়গান। কিন্তু জানেন কি, এই সুপরিচিত কার্যক্রমের আড়ালেও NASA এমন কিছু মিশন পরিচালনা করেছে বা সহায়তা করেছে, যা জনসাধারণের চোখের আড়ালে রাখা হয়েছে? হ্যাঁ, জাতীয় নিরাপত্তা, প্রযুক্তিগত গোপনীয়তা বা অন্যান্য কৌশলগত কারণে NASA-র কিছু কার্যক্রম বা সহযোগী মিশন অত্যন্ত গোপনীয়তার সাথে পরিচালিত হয়। এই ব্লগ পোস্টে আমরা NASA-র সাথে সম্পর্কিত এমন ৭টি গোপন বা স্বল্প পরিচিত মিশনের গভীরে যাবো, যা সাধারণ মানুষের জানার বাইরে। এই মিশনগুলো কেবল মহাকাশ গবেষণার ভিন্ন একটি দিকই তুলে ধরবে না, বরং ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে মহাকাশের গুরুত্বকেও স্পষ্ট করবে। চলুন, শুরু করা যাক সেই রহস্যময় জগতের অনুসন্ধান, যেখানে লুকিয়ে আছে বহু অজানা NASA secret missions।
NASA এবং গোপনীয়তার সংস্কৃতি
NASA মূলত একটি বেসামরিক সংস্থা, যার লক্ষ্য মহাকাশ গবেষণা এবং বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার। তবে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা এবং প্রযুক্তিগত শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখার বৃহত্তর লক্ষ্যের অংশ হিসেবে, NASA প্রায়শই প্রতিরক্ষা বিভাগ (Department of Defense – DoD) এবং অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে। এই সহযোগিতার ফলেই এমন কিছু মিশনের জন্ম হয় যা সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে গোপন রাখা হয়। এর মূল কারণগুলো হলো:
-
জাতীয় নিরাপত্তা: কিছু মিশনের উদ্দেশ্য থাকে নজরদারি, গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ বা সামরিক যোগাযোগ স্থাপন, যা সরাসরি জাতীয় নিরাপত্তার সাথে যুক্ত।
-
প্রযুক্তিগত গোপনীয়তা: নতুন এবং অত্যাধুনিক প্রযুক্তির পরীক্ষা বা ব্যবহার গোপন রাখা হয়, যাতে প্রতিযোগী দেশগুলো সেই প্রযুক্তি সম্পর্কে জানতে না পারে।
-
কৌশলগত সুবিধা: মহাকাশে কৌশলগত برتری (Supremacy) বজায় রাখার জন্য কিছু মিশনের তথ্য গোপন রাখা জরুরি।
এখন আমরা নির্দিষ্ট কিছু মিশনের দিকে নজর দেবো যেগুলোর সাথে NASA যুক্ত ছিল এবং যেগুলোর কার্যক্রম অত্যন্ত গোপনীয় ছিল।
১. স্পেস শাটলের গোপন DoD পেলোড মিশন (Classified DoD Payloads on Space Shuttle)
স্পেস শাটল প্রোগ্রাম মূলত বৈজ্ঞানিক গবেষণা এবং আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন (ISS) নির্মাণের জন্য পরিচিত হলেও, এর বেশ কয়েকটি ফ্লাইট মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগের জন্য উৎসর্গীকৃত ছিল। এই মিশনগুলোর পেলোড বা কার্গো কী ছিল, তাদের উদ্দেশ্য কী ছিল, এমনকি অনেক সময় সঠিক কক্ষপথ সম্পর্কেও খুব কম তথ্য প্রকাশ করা হতো।
-
গোপনীয়তার ধরণ: এই মিশনগুলোর উৎক্ষেপণের সময় প্রায়শই জনসাধারণের জন্য নির্দিষ্ট করে বলা হতো না, কেবল একটি উৎক্ষেপণ “উইন্ডো” উল্লেখ করা হতো। মিশনের ক্রুরাও অনেক সময় পেলোড সম্পর্কে বিস্তারিত জানতেন না। যোগাযোগ ব্যবস্থা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত ছিল।
-
উদাহরণ: STS-27, STS-28, STS-33, STS-36, STS-38, STS-53 এবং STS-51-C এর মতো মিশনগুলো সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে DoD-এর জন্য পরিচালিত হয়েছিল। ধারণা করা হয়, এগুলোর মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের গোয়েন্দা স্যাটেলাইট (যেমন সিগন্যাল ইন্টেলিজেন্স বা ইমেজিং স্যাটেলাইট) মহাকাশে স্থাপন করা হয়েছিল। এই military space missions গুলো স্নায়ুযুদ্ধের সময়কালে কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
২. প্রজেক্ট করোনা (Project Corona): নাসার পরোক্ষ ভূমিকা
যদিও প্রজেক্ট করোনা মূলত সিআইএ (CIA) এবং মার্কিন এয়ার ফোর্সের একটি অত্যন্ত গোপনীয় প্রোগ্রাম ছিল, এর প্রযুক্তিগত উন্নয়নে এবং উৎক্ষেপণ সহায়তায় NASA এবং এর পূর্বসূরি NACA (National Advisory Committee for Aeronautics)-এর পরোক্ষ ভূমিকা ছিল। এটি ছিল বিশ্বের প্রথম সফল ফটোগ্রাফিক রিকনেসান্স স্যাটেলাইট প্রোগ্রাম।
-
উদ্দেশ্য: সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং চীনের মতো প্রতিপক্ষ দেশগুলোর উপর নজরদারি করা।
-
গোপনীয়তা: প্রোগ্রামটি এতটাই গোপন ছিল যে এর অস্তিত্ব ১৯৯২ সালের আগে জনসমক্ষে স্বীকার করা হয়নি। স্যাটেলাইটগুলো ছবি তুলে ফিল্ম ক্যাপসুল পৃথিবীতে ফেরত পাঠাতো, যা বিমান থেকে মধ্য-আকাশে সংগ্রহ করা হতো। NASA-র উৎক্ষেপণ পরিকাঠামো এবং কিছু প্রযুক্তিগত জ্ঞান এই classified NASA projects গুলোর সফলতায় সহায়ক হয়েছিল।
৩. ভেলা হোটেল প্রোগ্রাম (Vela Hotel Program): পারমাণবিক বিস্ফোরণ শনাক্তকরণ
ভেলা হোটেল ছিল একটি স্যাটেলাইট প্রোগ্রাম, যা মহাকাশ থেকে পারমাণবিক বিস্ফোরণ শনাক্ত করার জন্য ডিজাইন করা হয়েছিল। ১৯৬৩ সালের পারমাণবিক পরীক্ষা নিষিদ্ধকরণ চুক্তি (Partial Test Ban Treaty) মেনে চলা হচ্ছে কিনা তা পর্যবেক্ষণ করাই ছিল এর মূল লক্ষ্য। যদিও এটি সরাসরি এয়ার ফোর্স দ্বারা পরিচালিত ছিল, NASA উৎক্ষেপণে সহায়তা করেছিল।
-
কার্যকারিতা: এই স্যাটেলাইটগুলো সফলভাবে বায়ুমণ্ডলে এবং মহাকাশে পারমাণবিক বিস্ফোরণ শনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছিল। মজার বিষয় হলো, ১৯৭৯ সালে ভেলা স্যাটেলাইট ভারত মহাসাগরের উপরে একটি রহস্যময় “দ্বৈত ফ্ল্যাশ” শনাক্ত করে, যা একটি অঘোষিত পারমাণবিক পরীক্ষা বলে সন্দেহ করা হয় (যা ‘ভেলা ইনসিডেন্ট’ নামে পরিচিত), যদিও এটি নিয়ে বিতর্ক আজও বিদ্যমান। NASA এই মিশনের উৎক্ষেপণ এবং ট্র্যাকিং-এ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
৪. এক্স-৩৭বি অরবিটাল টেস্ট ভেহিকেল (X-37B Orbital Test Vehicle)
এক্স-৩৭বি হলো একটি অত্যন্ত রহস্যময় এবং পুনরায় ব্যবহারযোগ্য মনুষ্যবিহীন মহাকাশযান, যা বর্তমানে ইউনাইটেড স্টেটস স্পেস ফোর্সের অধীনে পরিচালিত হয়। তবে এর যাত্রা শুরু হয়েছিল NASA-র হাত ধরে ১৯৯৯ সালে। পরে প্রকল্পটি প্রতিরক্ষা অ্যাডভান্সড রিসার্চ প্রজেক্টস এজেন্সি (DARPA) এবং এয়ার ফোর্সের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
-
রহস্যময়তা: এক্স-৩৭বি মহাকাশে শত শত দিন কাটাতে পারে (একটি মিশন ৭৮০ দিনেরও বেশি সময় ধরে চলেছিল)। এর পেলোড এবং মিশনের উদ্দেশ্য কঠোরভাবে গোপন রাখা হয়। ধারণা করা হয়, এটি নতুন মহাকাশ প্রযুক্তি পরীক্ষা, নজরদারি বা স্যাটেলাইট স্থাপনার কাজে ব্যবহৃত হয়। NASA-র প্রাথমিক গবেষণা এবং ডিজাইন এই secret space program-এর ভিত্তি স্থাপন করেছিল।
৫. ট্র্যাকিং অ্যান্ড ডেটা রিলে স্যাটেলাইট সিস্টেম (TDRS) ও তার গোপন ব্যবহার
ট্র্যাকিং অ্যান্ড ডেটা রিলে স্যাটেলাইট সিস্টেম (TDRS) হলো NASA-র একটি কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট নেটওয়ার্ক, যা পৃথিবী প্রদক্ষিণকারী অন্যান্য স্যাটেলাইট (যেমন হাবল টেলিস্কোপ, ISS) এবং NASA-র মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করে। যদিও এর মূল উদ্দেশ্য বৈজ্ঞানিক এবং বেসামরিক, TDRS নেটওয়ার্ক প্রায়শই DoD এবং অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থার ক্লাসিফায়েড স্যাটেলাইটগুলোর সাথে যোগাযোগের জন্যও ব্যবহৃত হয়।
-
দ্বৈত ব্যবহার: NASA-র এই পরিকাঠামো গোপন মিশনের ডেটা পৃথিবীতে নিরাপদে এবং দ্রুততার সাথে প্রেরণ করতে সহায়তা করে। অর্থাৎ, NASA-র একটি আপাতদৃষ্টিতে সাধারণ কমিউনিকেশন নেটওয়ার্কও জাতীয় নিরাপত্তার প্রয়োজনে গোপনীয়তার সাথে ব্যবহৃত হচ্ছে। এর মাধ্যমে NASA classified payloads থেকে তথ্য আদান-প্রদান করা হয়।
৬. জিওলাইট প্রোগ্রাম (Geolite Program): সিগন্যাল ইন্টেলিজেন্স
জিওলাইট প্রোগ্রাম ছিল ন্যাশনাল রিকনেসান্স অফিস (NRO)-এর একটি গোপন স্যাটেলাইট প্রোগ্রাম, যা সিগন্যাল ইন্টেলিজেন্স (SIGINT) অর্থাৎ ইলেকট্রনিক সিগন্যাল (যেমন রেডিও, রাডার) ধরে বিশ্লেষণ করার জন্য ডিজাইন করা হয়েছিল। এই স্যাটেলাইটগুলো উৎক্ষেপণের জন্য NASA-র শাটল বা অন্যান্য রকেট ব্যবহার করা হয়েছে বলে মনে করা হয়।
-
সংযোগ: যদিও মিশনটি NRO-এর, NASA-র উৎক্ষেপণ ক্ষমতা এবং প্রযুক্তিগত সহায়তা ছাড়া এই ধরনের গোপন পেলোড মহাকাশে পাঠানো সম্ভব হতো না। এটি NASA এবং সামরিক/গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মধ্যেকার গভীর সহযোগিতার আরেকটি উদাহরণ। এই ধরনের NASA secret missions প্রায়শই বেসামরিক প্রকল্পের আড়ালে পরিচালিত হয়।
৭. প্রজেক্ট ওরিয়ন (Project Orion): পারমাণবিক বোমার সাহায্যে মহাকাশযাত্রা
এটি একটি অত্যন্ত উচ্চাভিলাষী এবং বিতর্কিত ধারণা ছিল, যা ১৯৫০ এবং ১৯৬০-এর দশকে NASA এবং DARPA দ্বারা বিবেচিত হয়েছিল। এর লক্ষ্য ছিল পারমাণবিক বোমার নিয়ন্ত্রিত বিস্ফোরণ ব্যবহার করে বিশাল মহাকাশযানকে মহাকাশে চালিত করা।
-
গোপনীয়তা ও বিতর্ক: যদিও প্রজেক্ট ওরিয়নের কিছু দিক পরে প্রকাশিত হয়, এর বিস্তারিত গবেষণা এবং সম্ভাব্য সামরিক প্রয়োগের দিকগুলো দীর্ঘদিন গোপন রাখা হয়েছিল। পারমাণবিক পরীক্ষা নিষিদ্ধকরণ চুক্তি এবং পরিবেশগত উদ্বেগের কারণে প্রকল্পটি পরিত্যক্ত হয়। তবে, এটি মহাকাশ যাত্রার জন্য সবচেয়ে শক্তিশালী প্রপালশন সিস্টেমগুলোর মধ্যে একটি হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল এবং এর কিছু প্রযুক্তিগত দিক আজও প্রাসঙ্গিক। এটি সরাসরি মিশন না হলেও, NASA-র গোপন গবেষণা ও উন্নয়নের একটি উদাহরণ।
NASA নিঃসন্দেহে মানবজাতির জ্ঞান এবং অনুসন্ধিৎসার প্রতীক। চাঁদে অবতরণ থেকে শুরু করে সুদূর মহাবিশ্বের ছবি তোলা পর্যন্ত এর অর্জনগুলো আমাদের অনুপ্রাণিত করে। কিন্তু পর্দার আড়ালে, জাতীয় নিরাপত্তা এবং কৌশলগত প্রয়োজনে NASA এমন অনেক কার্যক্রমের সাথেও জড়িত যা সাধারণ মানুষের জানার বাইরে থেকে যায়। স্পেস শাটলের গোপন পেলোড, এক্স-৩৭বি-র মতো রহস্যময় মহাকাশযান, বা বিভিন্ন গোয়েন্দা স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণে সহায়তা – এই সবই প্রমাণ করে যে মহাকাশ গবেষণা কেবল বিজ্ঞান নয়, এটি ভূ-রাজনীতি এবং ক্ষমতারও একটি ক্ষেত্র।
এই NASA secret missions গুলোর অস্তিত্ব হয়তো আমাদের মনে নানা প্রশ্ন জাগায়, কিন্তু একই সাথে এটি মহাকাশ প্রযুক্তির অবিশ্বাস্য ক্ষমতা এবং এর বহুমুখী ব্যবহার সম্পর্কেও ধারণা দেয়। একদিকে যেমন আমরা NASA-র প্রকাশ্য অর্জনগুলোতে গর্ববোধ করি, তেমনই এর গোপন কার্যক্রমগুলোও মহাকাশে মানবজাতির অগ্রযাত্রার এক অবিচ্ছেদ্য, যদিও অন্ধকারাচ্ছন্ন, অংশ। এই গোপনীয়তা হয়তো জাতীয় নিরাপত্তার জন্য জরুরি, তবে এটি মহাকাশ গবেষণায় স্বচ্ছতার গুরুত্ব নিয়েও ভাবনার খোরাক জোগায়।