কলকাতার শহরজুড়ে যাঁরা রুফটপ বার, রেস্তরাঁ বা ক্যাফেতে আড্ডা দিতে ভালোবাসেন তাঁদের জন্য বড় ধাক্কার খবর! কলকাতা পুরসভা শহরের ৮৩টি নামী রুফটপ বার-রেস্তরাঁ-ক্যাফে বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছে। কলকাতা পুলিশের তরফে পুরসভাকে একটি বিস্তারিত তালিকা পাঠানো হয়েছে যার ভিত্তিতে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, পুরসভা থেকে এই প্রতিষ্ঠানগুলিকে আইনি নোটিসও জারি করা হয়েছে।
কেন বন্ধ হচ্ছে কলকাতার রুফটপ বার-রেস্তরাঁ-ক্যাফে?
বড়বাজারের মেছুয়া এলাকায় সম্প্রতি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর থেকেই নজরদারি কড়া করেছে প্রশাসন। ওই ঘটনায় ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছিল, যাদের অধিকাংশই ধোঁয়ায় শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা গিয়েছিলেন। এই হোটেলের জানালা এবং সিঁড়ি দেয়াল দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল, যা নিরাপত্তা বিধি লঙ্ঘনের স্পষ্ট উদাহরণ।
এই ঘটনার পরেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কড়া নির্দেশ দিয়েছেন যে শহরের কোনও ছাদে আটকে ব্যবসা করা যাবে না। শুক্রবার মেয়র ফিরহাদ হাকিম “টক টু মেয়র” অনুষ্ঠানের পর স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন যে ছাদ, সিঁড়ি আটকে ব্যবসা করা যাবে না। এর পরেই পুর কমিশনার এই মর্মে একটি সার্কুলার জারি করেন।
রেস্তরাঁর মালিকদের চিন্তা
রুফটপ রেস্তরাঁ, বার ও ক্যাফে বন্ধের এই সিদ্ধান্তে বেশ কিছু রেস্তরাঁর মালিক আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার কথা ভাবছেন। তাঁরা এই সিদ্ধান্তকে ‘খামখেয়ালি’ বলে অভিহিত করেছেন। অনেক প্রতিষ্ঠানেই শত শত কর্মচারী কাজ করেন, তাঁদের চাকরি নিয়েও উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।
কলকাতায় ৮৩ নামী রুফটপ বার-রেস্তরাঁ-ক্যাফের বিস্তারিত তালিকা
কলকাতা পুলিশের দেওয়া তালিকা অনুসারে শহরের বিভিন্ন এলাকার রুফটপ বার-রেস্তরাঁ-ক্যাফেগুলি যেগুলি বন্ধ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, সেগুলি হল:
পার্ক স্ট্রিট এলাকা (৭টি)
দ্য স্কাই স্টোরি
রুটস
আউরিস হোটেল অফ ফোর
দ্য গোল্ডেন পার্ক
ড্রাঙ্কেন টেডি
স্ক্র্যাপ ইয়ার্ড
এলএমএনওকিউ
শেক্সপিয়র থানা এলাকা (৮টি)
হ্যাশট্যাগ
সোল
অলটেরা
দ্য অ্যাসটোর
পার্ক স্ট্রিট সোশাল
কিউ এআই কিউ এআই
দ্য লর্ডস অ্যান্ড ব্যারনস
ইটিং হাউস কাম রেস্তরাঁ
ভবানীপুর থানা এলাকা (৩টি)
ক্লাউড ট্যাভেরন
ক্লাব কলকাতা মিক্সটেপ
রোমানিয়া কানহা কনফেকশনারি
টালিগঞ্জ থানা এলাকা (২টি)
নমনস ইন
ক্যালোরি এইচআইসি
কসবা থানা এলাকা (১০টি)
ভিভান্ত
সিংজি ধাবা
লা ফ্লেম
এইচ টু ও নভলিটি অফ ৩৮৭
চিনি কম
মিস চিলিস
মিস সেন হোটেলস
এশিয়া কিচেন
হপ্পিপোলা
জারা
অন্যান্য এলাকা
নিউ আলিপুর: জায়কা
চেতলা: রুফটপ
বেলেঘাটা: কিচেন কিউ স্পেশালিটি
ট্যাংরা: কলকাতা ৪৬
বড়বাজার: মিস অলিভ
গিরীশ পার্ক: ক্যাফে সিক্সটিনথ এয়ার কাসা
হেয়ার স্ট্রিট: মাইট কুইনস বার
নিউ মার্কেট: ব্লু অ্যান্ড বেয়ন্ড
আনন্দপুর: মনজিলাত
প্রগতি ময়দান: লা ফেলিস
যাদবপুর: স্ক্র্যাপ ইয়ার্ড
পুরসভার অভিযান এবং জনসাধারণের প্রতিক্রিয়া
শনিবার (৩ মে, ২০২৫) থেকে অভিযান শুরু করেছে কলকাতা পুরসভা। পার্ক স্ট্রিটের সেলিকা পার্কে অবস্থিত এলএমএনওকিউ স্কাই বারের ইনডোর সিটিং এরিয়ার ছাদের একাংশ ইতিমধ্যেই ভেঙে ফেলা হয়েছে। পাশাপাশি, সাদার্ন এভিনিউর ‘হোয়াটস আপ ক্যাফে’তেও অভিযান চালিয়েছে পুরসভা।
অনেক প্রতিষ্ঠান এখনও নোটিস পাননি, তবে নিজ থেকেই রুফটপ অংশ বন্ধ করে দিয়েছেন। লিন্ডসে স্ট্রিটের ব্লু অ্যান্ড বিয়ন্ডও নিজেদের রুফটপ সেকশন বন্ধ করে দিয়েছে, যদিও তারা কোনও নোটিস পাননি।
বাধার মুখে পড়ছে পুরসভা
সাদার্ন এভিনিউ অবস্থিত ‘হোয়াটস আপ ক্যাফে’ ভাঙতে গিয়ে বাধার মুখে পড়েছেন পুরসভার আধিকারিকরা। ক্যাফের সঙ্গে প্রায় ৮০ জন কর্মীর রুটি-রুজি জড়িয়ে থাকার কথা বলে পুরসভার কর্মীদের বাধা দেওয়া হয়। ক্যাফের মালিকের সঙ্গে বিস্তর ঝামেলা হওয়ার পর বাধ্য হয়ে পুরসভার ওই দল এবং পুলিশ বাহিনী ফিরে যায়।
কলকাতার পর বিধাননগরেও একই পদক্ষেপ
কলকাতার পর এবার বিধাননগর পুরসভাও একই ধরনের কঠোর পদক্ষেপ নিতে চলেছে। বিধাননগর পুরসভার মেয়র কৃষ্ণা চক্রবর্তী জানিয়েছেন, ছাদের উপর রেস্তোরা বন্ধ করতে পুরসভার ৪১টি ওয়ার্ডের কাউন্সিলরদের বলা হয়েছে তালিকা তৈরি করতে। সেই তালিকা সংশ্লিষ্ট থানার তুলে দেওয়া হবে। এর পর পুলিশ সরেজমিনে খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় আইনি পথে হাঁটবে।
রুফটপ বার-রেস্তরাঁ-ক্যাফে কেন বিপজ্জনক?
কলকাতা পুরসভার অধিকারিকদের মতে, বেশিরভাগ রুফটপ বার-রেস্তরাঁ-ক্যাফে নিরাপত্তা বিধি মানে না। ছাদে টিনের শেড বা থার্মোকলের ছাউনির মধ্যে বাতানুকূল যন্ত্র চালিয়ে এই ধরনের ব্যবসা চালানো হয়। অনেক ক্ষেত্রে ছাদে ওঠার সিঁড়িতে গ্যাস সিলিন্ডার, জলের জার বা প্লাস্টিকের ঢাঁই থাকে, যা আগুনের ঝুঁকি আরও বাড়ায়।
কলকাতা পুরসভা শনিবার (৪ মে, ২০২৫) একটি নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে শহরে কোনও নতুন রুফটপ রেস্তরাঁকে অনুমতি দেওয়া হবে না। বর্তমানে চালু থাকা প্রতিষ্ঠানগুলির অনুমতিও পর্যালোচনা করা হবে এবং প্রয়োজনে বাতিল করা হবে।
মুখ্যমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ
বৃহস্পতিবার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেলিকা পার্ক আকস্মিক পরিদর্শনে গিয়ে একাধিক রেস্তরাঁ এবং বারে অগ্নি নিরাপত্তা মাপদণ্ড লঙ্ঘন করা হচ্ছে বলে উল্লেখ করেন। মুখ্যমন্ত্রী অবিলম্বে সংশোধনমূলক পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, “এটা শুধু ব্যবসা এবং অর্থ উপার্জনের বিষয় নয়”।
প্রশাসনের অভিযান
এর পরেই কলকাতা পুরসভার সমস্ত বিভাগকে বেআইনিভাবে নির্মিত রুফটপ রেস্তরাঁ ভেঙে ফেলার জন্য প্রস্তুত থাকতে বলা হয়। শনিবার থেকেই শুরু হয় বিশেষ অভিযান। বিল্ডিং আইনের ৪০০(৮) ধারায় অনেক বিল্ডিং আগেই বেআইনি নির্মাণ বলে ঘোষণা করা হয়েছিল।
সর্বশেষ স্থিতি
রুফটপ রেস্তরাঁ বন্ধের এই সিদ্ধান্তের ফলে শহরের বিভিন্ন জনপ্রিয় আড্ডাস্থলে ঝুলছে তালা। পুরসভা ও পুলিশের যৌথ অভিযান চলছে শহরজুড়ে। নাগরিকদের নিরাপত্তার স্বার্থে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানানো হয়েছে। যাঁরা নিয়ম না মানবেন, তাঁদের সম্পূর্ণ রেস্তরাঁ, বার বা ক্যাফে ভেঙে দেওয়া হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছে পুরসভা।
কলকাতার ৮৩ নামী রুফটপ বার-রেস্তরাঁ-ক্যাফে বন্ধ করার এই সিদ্ধান্ত অনেক ক্ষেত্রে আশঙ্কা ও অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করেছে। একদিকে ব্যবসায়ীদের আর্থিক ক্ষতি, অন্যদিকে নাগরিকদের নিরাপত্তা – এই দ্বন্দ্ব নিয়ে বর্তমানে চলছে বিতর্ক। আগামী দিনগুলিতে কী ধরনের সমাধান বের হয়, সেদিকেই নজর রয়েছে সবার।