ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে এক যুবককে ‘চোর’ সন্দেহে আটক করে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। বুধবার (১৮ সেপ্টেম্বর) রাতে এই ঘটনা ঘটে। নিহত যুবকের নাম তোফাজ্জল হোসেন (৩২)। তিনি বরগুনা জেলার পাথরঘাটা উপজেলার কাঁঠালতলী ইউনিয়নের বাসিন্দা ছিলেন।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা অনুযায়ী, বুধবার সন্ধ্যা ৮টার দিকে হলের ছাত্ররা তোফাজ্জলকে চোর সন্দেহে আটক করে। এরপর তাকে হলের অতিথি কক্ষে নিয়ে যায় এবং সেখানে রাত ১০টা পর্যন্ত নির্মম মারধর করা হয়। এরপর তাকে হলের ক্যান্টিনে খাবার খাওয়ানো হয়। খাওয়ার পর আবারও তাকে পিটিয়ে অজ্ঞান করা হয়।
মধ্যরাতে তোফাজ্জলের অবস্থা খারাপ হলে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ মোহাম্মদ ফারুক জানান, তোফাজ্জলের শরীরে অনেক আঘাতের চিহ্ন ছিল।
ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু ভবন ধ্বংস: ইতিহাসের এক কালো অধ্যায়
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক সাইফুদ্দিন আহমেদ জানিয়েছেন, “প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আজ (১৯ সেপ্টেম্বর) মামলা দায়ের করবে। এছাড়া সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে আজই একটি প্রতিবেদন দেওয়া হবে, যার ভিত্তিতে প্রাথমিক শাস্তি দেওয়া হবে দায়ীদের।”
তোফাজ্জলের বন্ধু মোহাম্মদ বেলাল গাজী জানিয়েছেন, তোফাজ্জল বিএম কলেজ থেকে হিসাববিজ্ঞানে মাস্টার্স সম্পন্ন করেছিলেন। কিন্তু মানসিক সমস্যার কারণে চাকরি করতে পারেননি। গত ৩-৪ বছর ধরে তিনি ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে বেড়াতেন। মাঝে মাঝে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়ও থাকতেন।
এই ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়েছে। অনেকেই জানিয়েছেন যে তোফাজ্জল মানসিক প্রতিবন্ধী ছিলেন এবং নিয়মিত ক্যাম্পাসে ঘুরে বেড়াতেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী এই ঘটনার প্রতিবাদে ক্যাম্পাসে মিছিল করেছেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা আবু বকর মজুমদার এক বিবৃতিতে বলেন, “জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের একজন সাবেক নেতাকে হত্যা করা হয়েছে, আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আরেকজন যুবককে হত্যা করা হয়েছে। এসব ঘটনা মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন।”
এই ধরনের ঘটনা বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সহিংসতার একটি উদ্বেগজনক চিত্র তুলে ধরেছে। গত কয়েক বছরে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে সংঘর্ষ ও হিংসাত্মক ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৮ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলন এবং নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থী আন্দোলনের সময়ও ব্যাপক সহিংসতা দেখা গিয়েছিল।
বাংলাদেশের যুব সমাজের মধ্যে বেকারত্ব একটি বড় সমস্যা। দেশের মোট বেকারত্বের হার ৪.২% হলেও যুবদের মধ্যে এই হার ১২.৫%। অর্থনৈতিক চাপ, সামাজিক অসন্তোষ ও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে অনেক যুবক হিংসাত্মক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম বলেন, “শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে এই ধরনের হিংসাত্মক ঘটনা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। এটি শুধু আইন-শৃঙ্খলার সমস্যা নয়, বরং সামাজিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের একটি বৃহত্তর ইস্যু। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় নৈতিকতা ও মূল্যবোধের শিক্ষা জোরদার করতে হবে।”
মানবাধিকার সংগঠন অধিকার-এর নির্বাহী পরিচালক আদিলুর রহমান খান বলেন, “বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। যে কোনো অপরাধের বিচার আইনের মাধ্যমে হওয়া উচিত। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।”
এই ঘটনার পর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তবে অনেক শিক্ষার্থী ও শিক্ষক মনে করেন, শুধু শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নয়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সহিংসতা প্রতিরোধে দীর্ঘমেয়াদী পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।
শিক্ষাবিদরা মনে করেন, শিক্ষার্থীদের মধ্যে সহনশীলতা, সহমর্মিতা ও মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রত করার জন্য পাঠ্যক্রমে পরিবর্তন আনা, কাউন্সেলিং সেবা বাড়ানো এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড জোরদার করা প্রয়োজন। পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোকেও তাদের ছাত্র সংগঠনগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ জোরদার করতে হবে।
তোফাজ্জলের মৃত্যুর ঘটনায় ফজলুল হক মুসলিম হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক শাহ মোহাম্মদ মাসুম বলেন, “এটি অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনা। আমরা ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেব। পাশাপাশি এই ধরনের ঘটনা যাতে আর না ঘটে সেজন্য সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালাবো।”
বাংলাদেশের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, “আমরা এই ঘটনায় গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সহিংসতা প্রতিরোধে জাতীয় পর্যায়ে একটি কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।”
এই ঘটনার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে #JusticeForTofazzal হ্যাশট্যাগ ট্রেন্ড করছে। অনেকেই বিচারের দাবি জানিয়েছেন এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিরাপত্তা জোরদার করার আহ্বান জানিয়েছেন।
সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করেন, এই ধরনের ঘটনা প্রতিরোধে শুধু আইনি ব্যবস্থা নয়, সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক দিকগুলোর দিকেও নজর দিতে হবে। তরুণদের মধ্যে সহিংসতার প্রবণতা কমাতে তাদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ানো, মানসিক স্বাস্থ্য সেবা সহজলভ্য করা এবং সামাজিক সংহতি বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।