চীন সম্প্রতি শিল্প জগতে একটি বিপ্লবী পদক্ষেপ নিয়েছে, যার নাম ‘অন্ধকার কারখানা’। এই কারখানাগুলোতে কোনো শ্রমিক কাজ করেন না, এমনকি আলোও জ্বলে না। সম্পূর্ণভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) এবং রোবটের মাধ্যমে পরিচালিত এই কারখানাগুলো ২৪ ঘণ্টা, সপ্তাহে সাত দিন কাজ করে। এর ফলে উৎপাদনশীলতা বাড়ছে, খরচ কমছে এবং শক্তি সাশ্রয় হচ্ছে। এই প্রযুক্তি চীনকে বিশ্বের শীর্ষ শিল্পশক্তি হিসেবে আরও মজবুত অবস্থানে নিয়ে যাচ্ছে।
এই ‘অন্ধকার কারখানা’র ধারণাটি শুনতে যতটা অবাক করা, বাস্তবে ততটাই কার্যকর। এই কারখানাগুলোতে মানুষের উপস্থিতির প্রয়োজন নেই বলে আলো, গরম বা ঠান্ডা করার ব্যবস্থা, এমনকি বিশ্রামের সময়ও লাগে না। সবকিছু পরিচালনা করে অত্যাধুনিক রোবট এবং AI সিস্টেম। উদাহরণস্বরূপ, চীনের শেনজেন এবং সিয়ানের মতো শহরে বৈদ্যুতিক গাড়ি নির্মাতা BYD-এর কারখানায় রোবট ব্যাটারি এবং গাড়ির চেসিস তৈরি করছে। এই প্রক্রিয়ায় ইনফ্রারেড সেন্সর, লিডার এবং মেশিন ভিশনের মতো প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়, যা অন্ধকারেও নিখুঁতভাবে কাজ করতে পারে। ফলে, শুধু উৎপাদন দ্রুত হচ্ছে না, শক্তির ব্যবহারও কমছে।
বিষয়টির গভীরে গেলে দেখা যায়, চীনের এই উদ্যোগ শুধু প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের প্রমাণ নয়, বরং তাদের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ। ২০৬০ সালের মধ্যে কার্বন নিরপেক্ষতার লক্ষ্য অর্জনের জন্য চীন সরকার এই ধরনের অটোমেশনকে উৎসাহ দিচ্ছে। আন্তর্জাতিক শক্তি সংস্থা (IEA) জানিয়েছে, এই ধরনের কারখানা শিল্পে শক্তি খরচ ১৫ থেকে ২০ শতাংশ কমাতে পারে। চীনের জাতীয় পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে শিল্পে শক্তি খরচ ১.৭ শতাংশ কমেছে, যার একটি বড় কারণ এই অটোমেশন। এছাড়া, যেহেতু এই কারখানায় শ্রমিক নেই, তাই শ্রমিকদের বেতন, খাবার, বা কর্মঘণ্টা নিয়ে দরকষাকষির মতো জটিলতাও এড়ানো যায়।
চীনের এই প্রযুক্তি বিশ্বের অন্যান্য দেশের জন্যও একটি চ্যালেঞ্জ। যেখানে পশ্চিমা দেশগুলো এখনও অনেক ক্ষেত্রে শ্রমিকনির্ভর উৎপাদনের উপর নির্ভর করে, সেখানে চীন এগিয়ে যাচ্ছে সম্পূর্ণ অটোমেশনের দিকে। এর ফলে পণ্যের দাম কমে যাচ্ছে, যা বিশ্ব বাজারে চীনা পণ্যের প্রতিযোগিতার ক্ষমতা বাড়াচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যে কারখানাগুলোতে আগে শ্রমিকরা দিনে ৮-১০ ঘণ্টা কাজ করতো, সেখানে এখন মেশিন ২৪ ঘণ্টা কাজ করছে। এতে উৎপাদন বাড়ছে, খরচ কমছে এবং পরিবেশের উপর চাপও কমছে।
তবে এই অগ্রগতির পিছনে কিছু উদ্বেগও রয়েছে। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, শ্রমিকদের কী হবে? যেসব কাজে আগে হাজার হাজার মানুষ কাজ করতো, সেগুলো এখন রোবটের হাতে। ফলে নিম্ন-দক্ষতার শ্রমিকদের চাকরি হারানোর ঝুঁকি বাড়ছে। চীনে প্রতি বছর লাখ লাখ তরুণ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হচ্ছেন, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে তাদের জন্য উপযুক্ত চাকরি পাওয়া যাচ্ছে না। এই ‘অন্ধকার কারখানা’র প্রসার আরও বেকারত্ব সৃষ্টি করতে পারে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি নতুন ধরনের চাকরির সুযোগও তৈরি করবে, যেমন রোবট রক্ষণাবেক্ষণ বা AI প্রোগ্রামিংয়ের কাজ।
এই প্রযুক্তির আরেকটি দিক হলো এর পরিবেশগত প্রভাব। যেহেতু আলো বা শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন নেই, তাই বিদ্যুৎ খরচ অনেক কম। চীনের মতো দেশ, যেখানে শিল্পায়নের জন্য প্রচুর শক্তির প্রয়োজন, সেখানে এটি একটি বড় সুবিধা। তবে সমালোচকরা বলছেন, এই রোবট এবং AI সিস্টেম তৈরি করতে যে শক্তি ও সম্পদ লাগে, তা প্রাথমিকভাবে পরিবেশের উপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে। তবুও, দীর্ঘমেয়াদে এটি পরিবেশের জন্য ইতিবাচক বলে মনে করা হচ্ছে।
চীনের এই পদক্ষেপ বিশ্বব্যাপী শিল্পের ভবিষ্যৎ কী হবে, তা নিয়ে ভাবতে বাধ্য করছে। অনেকে মনে করেন, এটি অন্য দেশগুলোর জন্য একটি উদাহরণ হয়ে উঠবে। ইতিমধ্যে, টেসলা বা সিমেন্সের মতো কোম্পানিগুলো এই ধরনের প্রযুক্তি গ্রহণ করছে। কিন্তু চীনের স্কেল এবং গতি অন্য কাউকে ছাড়িয়ে গেছে। এই ‘অন্ধকার কারখানা’ শুধু উৎপাদনের একটি নতুন পদ্ধতি নয়, বরং ভবিষ্যতের শিল্পবিপ্লবের একটি ইঙ্গিত।
শেষ কথা হিসেবে বলা যায়, চীনের এই উদ্ভাবন বিশ্বকে নতুন করে ভাবতে শেখাচ্ছে। যেখানে একদিকে প্রযুক্তির জয়গান চলছে, সেখানে মানুষের ভবিষ্যৎ নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। তবে একটি বিষয় পরিষ্কার, চীন এই প্রযুক্তির মাধ্যমে বিশ্ব শিল্পে নিজের আধিপত্য আরও শক্ত করছে। এই ‘অন্ধকার কারখানা’র যুগ কেবল শুরু হয়েছে, এবং এর প্রভাব আমরা সবাই অনুভব করবো।