আজ ২০ মার্চ, বিশ্ব চড়ুই দিবস। প্রতি বছর এই দিনে আমরা সেই ছোট্ট পাখির কথা স্মরণ করি, যার কিচিরমিচির শব্দ একসময় আমাদের সকালকে মুখরিত করে তুলত। এই দিনটি শুধু উদযাপনের জন্য নয়, বরং চড়ুই পাখির সংরক্ষণ ও তাদের অস্তিত্ব রক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য পালিত হয়। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় এই ক্ষুদ্র প্রাণীর ভূমিকা অপরিসীম, কিন্তু আধুনিক জীবনযাত্রা ও পরিবেশ দূষণের কারণে তাদের সংখ্যা ক্রমশ কমে যাচ্ছে। আজকের এই দিনে আমরা শুধু চড়ুইকে মনে করি না, তাদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য কী করা যায়, সে বিষয়েও ভাবি।
এই বিশেষ দিনটির শুরু হয়েছিল ২০১০ সালে। ভারতের ‘নেচার ফরএভার সোসাইটি’ এবং ফ্রান্সের ‘ইকো-সিস অ্যাকশন ফাউন্ডেশন’-এর যৌথ উদ্যোগে প্রথমবার বিশ্ব চড়ুই দিবস পালিত হয়। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল চড়ুই পাখির প্রতি মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা এবং তাদের সংখ্যা হ্রাসের কারণগুলো চিহ্নিত করে সমাধানের পথ খুঁজে বের করা। ব্রিটেনের ‘রয়্যাল সোসাইটি ফর দ্য প্রোটেকশন অব বার্ডস’ এমনকি চড়ুইকে তাদের লাল তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে, যা ইঙ্গিত দেয় যে এই প্রজাতি বিলুপ্তির ঝুঁকিতে রয়েছে। বিশ্বজুড়ে পরিবেশবিদরা এই দিনে বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে মানুষকে সচেতন করার চেষ্টা করেন। বাংলাদেশেও এই দিনটি পালিত হয়, যদিও অনেকের কাছে এটি এখনও তেমন পরিচিত নয়।
চড়ুইয়ের সংখ্যা কমে যাওয়ার পেছনে রয়েছে একাধিক কারণ। একসময় আমাদের ঘরের কোণে, বারান্দায় বা গাছের ডালে এই পাখিগুলোর বাসা দেখা যেত। কিন্তু এখন শহরের উঁচু ভবন, মোবাইল টাওয়ারের তরঙ্গ, দূষণ এবং প্রাকৃতিক আবাসস্থলের ক্ষতি তাদের জীবনকে কঠিন করে তুলেছে। গ্রামেও পরিস্থিতি ভালো নয়। জলাশয় ভরাট হয়ে যাওয়া, ফসলের জমি কমে যাওয়া এবং কীটনাশকের ব্যবহার চড়ুইয়ের খাদ্য ও বাসস্থানের অভাব ঘটিয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, মোবাইল টাওয়ার থেকে নির্গত তরঙ্গ চড়ুইয়ের উড়ার পথে বাধা সৃষ্টি করে, যার ফলে তারা দিকভ্রান্ত হয়। এমনকি কিছু অঞ্চলে চড়ুই শিকারের ঘটনাও দেখা গেছে, যা তাদের অস্তিত্বের জন্য আরেকটি হুমকি।
পৃথিবীতে চড়ুইয়ের প্রায় ৪৮টি প্রজাতি রয়েছে। এর মধ্যে গৃহস্থালি চড়ুই বা ‘হাউস স্প্যারো’ আমাদের কাছে সবচেয়ে পরিচিত। এদের বৈজ্ঞানিক নাম ‘পাসার ডোমেস্টিকাস’। এই পাখির দৈর্ঘ্য সাধারণত ১৬ সেন্টিমিটারের কাছাকাছি হয় এবং ওজন ৪০ গ্রামের মতো। পুরুষ চড়ুইয়ের ডানায় বাদামি রঙ থাকে, গাল সাদাটে এবং ঠোঁটের নিচে কালো দাগ দেখা যায়। অন্যদিকে, স্ত্রী চড়ুইয়ের গায়ের রঙ ধূসর এবং পিঠে গাঢ় ছাপ থাকে। এরা খড়, শুকনো ঘাস দিয়ে বাসা বানায় এবং মাটি থেকে শস্য বা পোকামাকড় খুঁটে খায়। জীববৈচিত্র্য রক্ষায় এদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এরা কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
চিনের একটি ঘটনা এই বিষয়ে চোখ খুলে দেয়। ১৯৫০-এর দশকে চিনে ফসল রক্ষার নামে চড়ুই নিধনের প্রচারণা চালানো হয়েছিল। লাখ লাখ চড়ুই মারা যাওয়ার পর কীটপতঙ্গের সংখ্যা বেড়ে যায়, ফসল নষ্ট হয় এবং দেশটি ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের মুখে পড়ে। এই ঘটনা প্রমাণ করে যে, প্রকৃতির ভারসাম্যে চড়ুইয়ের মতো ছোট প্রাণীরও অপরিহার্য অবদান রয়েছে। তাই এদের রক্ষা করা শুধু পরিবেশের জন্য নয়, আমাদের নিজেদের ভবিষ্যতের জন্যও জরুরি।
আমরা যদি চাই, তাহলে চড়ুইকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। এজন্য বেশি কিছু করতে হবে না। বাড়ির বারান্দায় একটু ভাত বা শস্য ছড়িয়ে দিলে এরা খেতে আসবে। একটি ছোট পাত্রে পানি রাখলে তাদের তেষ্টা মিটবে। গাছ লাগানো এবং কীটনাশকের ব্যবহার কমানোও তাদের বাসস্থান ফিরিয়ে দিতে সাহায্য করবে। শহরে কৃত্রিম বাসা তৈরির উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। ভারতের বিহারে চড়ুইকে ‘রাজ্য পাখি’ ঘোষণা করা হয়েছে এবং সেখানে সংরক্ষণের চেষ্টা শুরু হয়েছে। আমরাও এমন কিছু করতে পারি।
শৈশবে আমরা চড়ুইয়ের গল্প শুনতাম। রবীন্দ্রনাথের কবিতায় বা দাদির মুখে এই পাখি ছিল আমাদের জীবনের অংশ। কিন্তু আজ আমাদের সন্তানরা তাদের চেনে না। এটি শুধু একটি পাখির হারিয়ে যাওয়া নয়, আমাদের প্রকৃতির একটি অংশ হারানোর গল্প। বিশ্ব চড়ুই দিবসে আসুন আমরা প্রতিজ্ঞা করি, এই কিচিরমিচির শব্দ আবার আমাদের চারপাশে ফিরিয়ে আনব। এটি আমাদের পরিবেশকে বাঁচানোর একটি ছোট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হবে।