আইপিএল বা বিশ্বকাপের চাকচিক্য থেকে হাজার মাইল দূরে, জম্মু ও কাশ্মীরের পুলওয়ামায় এক অখ্যাত ক্রিকেটার রাতারাতি শিরোনাম হয়ে উঠেছেন। স্থানীয় ক্রিকেট টুর্নামেন্টে মাত্র ৭৭ বলে বিস্ফোরক ২৩২ রান করে ইতিহাস রচনা করেছেন আদিল নবি, যিনি উপত্যকায় ‘কাশ্মীরের পোলার্ড’ নামে পরিচিত। সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় হলো, তিনি শচীন টেন্ডুলকারের আইকনিক ১০ নম্বর জার্সি পরে এই কীর্তি সাধন করেছেন।
নাগওয়ান ক্রিকেট মাঠে অনুষ্ঠিত এই ম্যাচে বাঙ্গাম টাইটান্সের হয়ে ব্যাট করতে নেমে আদিল নবি প্রতিপক্ষ মিশওয়াড়া ক্রিকেট ক্লাব সোপিয়ানের বোলারদের ধরাশায়ী করেন। তার এই অসাধারণ ইনিংসে ছিল ১১টি চার ও ২৯টি ছক্কা। জম্মু-কাশ্মীর পুলিশের আয়োজনে এই প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে তিনি স্থানীয় ক্রিকেটে এক নতুন মাইলফলক স্থাপন করেছেন।
মাত্র ৭৭ বলে দ্বিশতরান অতিক্রম করার এই কীর্তি শুধু স্থানীয় পর্যায়েই নয়, আন্তর্জাতিক মানদণ্ডেও বিরল। বিশ্বমানের ক্রিকেটে এমন স্ট্রাইক রেট খুবই অস্বাভাবিক, যেখানে আদিল নবি প্রমাণ করেছেন যে প্রতিভার কোনো ভৌগোলিক সীমারেখা নেই। ইনিংসের শুরু থেকেই তিনি আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে খেলেন এবং বোলারদের কোনো প্রকার সুবিধা দেননি।
আদিল নবি দীর্ঘদিন ধরে স্থানীয় ক্রিকেটে সক্রিয় থাকলেও এই প্রথম তিনি এমন বড় পরিসরে আলোচনায় এসেছেন। ক্রিকেট বিশ্বে তিনি অখ্যাত হলেও কাশ্মীর উপত্যকার উঠতি ক্রিকেটারদের কাছে তিনি এক আদর্শ ব্যক্তিত্ব। ছোটবেলা থেকেই ক্রিকেটের প্রতি তার গভীর ভালোবাসা ছিল এবং নিয়মিত অনুশীলনের মাধ্যমে তিনি নিজেকে একজন দক্ষ অলরাউন্ডার হিসেবে গড়ে তুলেছেন।
ব্যাটিং দক্ষতার পাশাপাশি আদিল নবি একজন দক্ষ অফ স্পিন বোলারও। তবে দুঃখের বিষয় হলো, তিনি এখনো পর্যন্ত কোনো সরকারি ক্রিকেট ট্রায়ালে অংশ নিতে পারেননি। এর মূল কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেছেন স্থানীয় এলাকায় প্রয়োজনীয় ক্রিকেট সুবিধার অভাব।
কাশ্মীরের ক্রিকেট পরিকাঠামোর সমস্যা নিয়ে খোলামেলা মন্তব্য করেছেন এই তরুণ ক্রিকেটার। তার ভাষায়, “এখানে প্রতিভার কোনো অন্ত নেই। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হলো এখানে কোনো মাঠ বা অ্যাকাডেমি নেই। যেখানে গেলে আমরা নিজেদের দক্ষতাকে আরও বেশি শাণিত করতে পারব।” তিনি আরও যোগ করেন যে তাদের এলাকায় টার্ফ নেই, ম্যাটের উইকেটে খেলতে হয়।
স্থানীয় প্রশাসনের কাছে তার আবেদন হলো ক্রিকেট খেলার জন্য উপযুক্ত মাঠের ব্যবস্থা করা। ডেপুটি কমিশনারের কাছে আবেদন জানিয়ে তিনি বলেছেন, “তিনি যেন খেলার মাঠের বন্দোবস্ত করেন। তাহলে আমাদের ছেলেরাও খেলাধুলায় শীর্ষে পৌঁছতে পারবে।” এই বক্তব্যে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে শুধু প্রতিভা নয়, সুযোগের অভাবেই অনেক মেধাবী ক্রিকেটার জাতীয় পর্যায়ে পৌঁছাতে পারছেন না।
জম্মু ও কাশ্মীরের ক্রিকেট ইতিহাসে এমন বিস্ফোরক ইনিংস বিরল। এই অঞ্চল থেকে পারভেজ রসুল, রজত ভাটিয়াদের মতো কিছু ক্রিকেটার জাতীয় দলে স্থান পেলেও সামগ্রিকভাবে কাশ্মীরের ক্রিকেট এখনো যথাযথ উন্নতি করতে পারেনি। আদিল নবির এই কীর্তি প্রমাণ করে যে এখানে অফুরন্ত সম্ভাবনা রয়েছে, শুধু প্রয়োজন সঠিক পৃষ্ঠপোষকতা ও সুবিধার।
টেন্ডুলকারের ১০ নম্বর জার্সি পরে এই রেকর্ড গড়া প্রতীকী তাৎপর্য বহন করে। শচীন টেন্ডুলকার যিনি ভারতীয় ক্রিকেটের জীবন্ত কিংবদন্তি, তার জার্সি নম্বর ধারণ করে একজন অখ্যাত ক্রিকেটারের এমন অভূতপূর্ব সাফল্য যেন স্বপ্ন দেখায় যে সঠিক সুযোগ পেলে যে কেউ অসাধ্য সাধন করতে পারে।
সোশ্যাল মিডিয়ায় আদিল নবির এই ইনিংস ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। ক্রিকেট প্রেমীরা তার প্রশংসা করার পাশাপাশি দাবি জানাচ্ছেন যেন তাকে উচ্চতর পর্যায়ে খেলার সুযোগ দেওয়া হয়। অনেকে মনে করছেন যে সঠিক প্রশিক্ষণ ও সুবিধা পেলে তিনি রাজ্য দল এমনকি জাতীয় দলেও স্থান করে নিতে পারবেন।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যে এমন প্রতিভাবান খেলোয়াড়দের চিহ্নিত করে তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা উচিত। আইপিএল বা অন্যান্য ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে স্কাউটিং সিস্টেম আরও শক্তিশালী করলে আদিল নবির মতো প্রতিভাবানরা বড় মঞ্চে পৌঁছানোর সুযোগ পেতে পারেন। তার এই ইনিংস প্রমাণ করে যে ভারতের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও লুকিয়ে আছে অপার সম্ভাবনা।
কাশ্মীরের এই তরুণ ক্রিকেটারের গল্প অনুপ্রেরণার। কঠোর পরিশ্রম, অদম্য ইচ্ছাশক্তি এবং প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও স্বপ্ন দেখার সাহসের প্রতীক তিনি। আদিল নবির এই অসাধারণ কীর্তি শুধু স্থানীয় ক্রিকেট ইতিহাসে নয়, সমগ্র ভারতীয় ক্রিকেটেও একটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায় সংযোজন করেছে যা দীর্ঘদিন মনে রাখা হবে।