ভূমিকম্পের ধ্বংসযজ্ঞে কাঁপল আফগানিস্থান, মৃত্যু অন্তত ৫০০ জনের, কাঁপল ভারত-পাকিস্তানও

আফগানিস্থানের পূর্বাঞ্চলে রবিবার রাতে সংঘটিত ৬.০ মাত্রার ভয়াবহ ভূমিকম্পে কমপক্ষে ৫০০ মানুষের প্রাণহানি হয়েছে এবং এক হাজারেরও বেশি মানুষ আহত হয়েছে বলে সরকারি সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে। স্থানীয় সময় রাত ১১:৪৭ মিনিটে…

Avatar

 

আফগানিস্থানের পূর্বাঞ্চলে রবিবার রাতে সংঘটিত ৬.০ মাত্রার ভয়াবহ ভূমিকম্পে কমপক্ষে ৫০০ মানুষের প্রাণহানি হয়েছে এবং এক হাজারেরও বেশি মানুষ আহত হয়েছে বলে সরকারি সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে। স্থানীয় সময় রাত ১১:৪৭ মিনিটে সংঘটিত এই ভূমিকম্পের কম্পন অনুভূত হয়েছে ভারতের দিল্লি-এনসিআর থেকে পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদ পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকায়।

ইউএস জিওলজিক্যাল সার্ভের তথ্য অনুযায়ী, ভূমিকম্পের উৎসস্থল ছিল নাঙ্গারহার প্রদেশের জালালাবাদ শহর থেকে মাত্র ২৭ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে, যা ভূপৃষ্ঠ থেকে মাত্র ৮ কিলোমিটার গভীরতায় সংঘটিত হয়েছিল। ভূমিকম্পের অগভীর প্রকৃতির কারণে ক্ষয়ক্ষতি অধিক হয়েছে, যেহেতু ভূকম্পনীয় তরঙ্গ ভূপৃষ্ঠে পৌঁছানোর জন্য কম দূরত্ব অতিক্রম করেছে।

তালেবান সরকারের প্রাকৃতিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে যে, কুনার প্রদেশের নুর গুল, সকি, ওয়াতপুর, মানোগি এবং চাপাদারা জেলায় সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। কুনার প্রদেশেই সর্বোচ্চ সংখ্যক মৃত্যু নিবন্ধিত হয়েছে, যেখানে পুরো গ্রাম মাটিচাপা পড়ে গেছে এবং শত শত মানুষ এখনও ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে রয়েছে বলে অনুমান করা হচ্ছে।

নাঙ্গারহার প্রদেশেও অন্তত ৯ জনের মৃত্যু এবং ২৫ জন আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে দুটি শিশু তাদের বাড়ির ছাদ ধসে পড়ে মৃত্যুবরণ করেছে। লাগমান প্রদেশেও কয়েক ডজন মানুষ আহত হয়েছে বলে খবর রয়েছে।

উদ্ধারকাজ চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে দুর্গম পার্বত্য এলাকাগুলোতে, যেখানে যোগাযোগ ব্যবস্থা সীমিত এবং ভবনগুলো ভূমিকম্প প্রতিরোধী নয়। তালেবান সরকারের মুখপাত্র জবিহুল্লাহ মুজাহিদ সামাজিক মাধ্যমে জানিয়েছেন যে, স্থানীয় কর্মকর্তারা সব ধরনের সম্পদ ব্যবহার করে উদ্ধার অভিযান চালাচ্ছেন এবং কেন্দ্রীয় সরকার ও পার্শ্ববর্তী প্রদেশ থেকে ত্রাণ দল পাঠানো হয়েছে।

ভূমিকম্পের কম্পন অনুভূত হয়েছে পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখা ও পাঞ্জাব প্রদেশের বিভিন্ন শহরে। পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদ, লাহোর, রাওয়ালপিন্ডি, গুজরানওয়ালা, কুয়েটা এবং পেশাওয়ারের মানুষ ভয়ে তাদের ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিল।

ভারতেও ভূমিকম্পের প্রভাব অনুভূত হয়েছে ব্যাপকভাবে। দিল্লি-এনসিআর, জম্মু ও কাশ্মীর, পাঞ্জাব, হরিয়ানা, হিমাচল প্রদেশ এবং উত্তরাখণ্ডে কম্পন অনুভূত হয়েছে। যদিও ভূমিকম্প মাত্র ৫-৭ সেকেন্ড স্থায়ী হয়েছিল, তবুও আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছিল এবং মানুষ তাদের ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিল। আফগানিস্থানের রাজধানী কাবুল থেকে ১০০ মাইল দূরে থাকা সত্ত্বেও সেখানে শক্তিশালী কম্পন অনুভূত হয়েছিল।

মূল ভূমিকম্পের পরে অন্তত পাঁচটি পরকম্পন রেকর্ড করা হয়েছে, যার মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালীটি ছিল ৫.২ মাত্রার। প্রাথমিকভাবে ৪.৫ এবং ৫.০ মাত্রার দুটি পরকম্পনও রেকর্ড করা হয়েছে।

ইউএস জিওলজিক্যাল সার্ভের PAGER সিস্টেম একটি কমলা সতর্কতা জারি করেছে, যা ইঙ্গিত করে যে “উল্লেখযোগ্য প্রাণহানি সম্ভাব্য এবং দুর্যোগ ব্যাপক হতে পারে”। এই ধরনের সতর্কতা স্তরের ঘটনাগুলো সাধারণত আঞ্চলিক বা জাতীয় পর্যায়ে সাড়া প্রয়োজন হয়।

আফগানিস্থান ভূতাত্ত্বিকভাবে অত্যন্ত সক্রিয় একটি অঞ্চলে অবস্থিত, যেখানে ভারতীয় ও ইউরেশীয় টেকটনিক প্লেটের সংঘর্ষের কারণে নিয়মিত ভূমিকম্প হয়ে থাকে। হিন্দুকুশ পর্বতমালা বিশেষভাবে ভূমিকম্প প্রবণ এলাকা হিসেবে পরিচিত। এ বছরের মে মাসে ৪.৭ মাত্রার এবং এপ্রিল মাসে ৫.৯ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল, তবে তখন কোনো প্রাণহানি হয়নি।

২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে আফগানিস্থানের পশ্চিমাঞ্চলে ৬.৩ মাত্রার ভূমিকম্পে তালেবান সরকারের তথ্য অনুযায়ী অন্তত ৪ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছিল, যদিও জাতিসংঘ প্রায় দেড় হাজার মৃত্যুর কথা জানিয়েছিল। সেটি ছিল আফগানিস্থানের সাম্প্রতিক স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ।

বর্তমানে আফগানিস্থান গুরুতর অর্থনৈতিক সংকটের মুখোমুখি, যা আমেরিকান বিদেশী সাহায্য বন্ধ এবং প্রতিবেশী ইরান ও পাকিস্থান থেকে ২০ লাখেরও বেশি আফগান নাগরিকের বহিষ্কার ও জোরপূর্বক প্রত্যাবাসনের কারণে আরও খারাপ হয়েছে। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, আফগানিস্থানের ৪ কোটি ২০ লাখ জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি মানুষ মানবিক সহায়তার প্রয়োজন রয়েছে।

তালেবান সরকারের দুর্যোগ মোকাবেলার সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, পূর্ববর্তী সরকারের অধিকাংশ প্রশিক্ষিত পেশাদার ইতিমধ্যে দেশ ছেড়ে চলে গেছেন, যা এই দুর্যোগ মোকাবেলায় সুস্পষ্ট চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র শরফত জামান জানিয়েছেন যে, “হতাহতের সংখ্যা বেশি, কিন্তু এলাকাটি দুর্গম হওয়ায় আমাদের দলগুলো এখনও ঘটনাস্থলে রয়েছে”।

উদ্ধারকর্মীরা জীবন সনাক্তকারী যন্ত্র, কম্পন বা ভূকম্পন সতর্কতা এবং এমনকি অনুসন্ধান ও উদ্ধারকারী কুকুরের অভাবে লাঠি, কোদাল এবং খালি হাত দিয়ে বেঁচে থাকা এবং মৃতদেহ উদ্ধার করতে বাধ্য হচ্ছেন। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় যোগাযোগ ব্যবস্থা বিঘ্নিত হওয়ায় সঠিক তথ্য সংগ্রহ করা কঠিন হয়ে পড়েছে।

আহতদের নাঙ্গারহার আঞ্চলিক হাসপাতালে হেলিকপ্টারের মাধ্যমে পাঠানো হচ্ছে। প্রতিরক্ষা, অভ্যন্তরীণ এবং জনস্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে উদ্ধার দল এই অঞ্চলে পৌঁছেছে। তবে দুর্গম পার্বত্য এলাকায় ভূমিধসের কারণে কিছু বিচ্ছিন্ন সম্প্রদায়ে সাহায্য পৌঁছানো চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠেছে।

এই ভূমিকম্প আফগানিস্থানের জন্য আরেকটি বড় দুর্যোগ হিসেবে দেখা দিয়েছে, যে দেশটি ইতিমধ্যে যুদ্ধবিধ্বস্ত এবং অর্থনৈতিক সংকটের কবলে রয়েছে। অনেক ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা ভূতাত্ত্বিক ফল্ট লাইনের কাছে অবস্থিত হওয়ায় ভবিষ্যতেও এ ধরনের দুর্যোগের ঝুঁকি রয়ে গেছে।

About Author
Avatar

আন্তর্জাতিক খবরের সর্বশেষ আপডেট, গভীর বিশ্লেষণ এবং বিশ্বের প্রভাবশালী ঘটনাবলীর বিস্তারিত প্রতিবেদন পেতে আমাদের International Desk-এ আসুন। বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তের গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ, রাজনৈতিক গতিবিধি, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং সাংস্কৃতিক ঘটনাবলী সম্পর্কে জানতে এই পাতাটি আপনার একমাত্র গন্তব্য।