Rakhee Gulzar comeback 2025: শোবিজ জগতের অন্যতম উজ্জ্বল নক্ষত্র রাখি গুলজার দীর্ঘ ২২ বছরের বিরতি দিয়ে আবার বাংলা চলচ্চিত্রে ফিরে এসেছেন। নন্দিতা রায় ও শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় পরিচালিত ‘আমার বস’ ছবিতে অভিনয় করে দর্শকদের কাছে ফিরছেন এই বর্ষীয়ান অভিনেত্রী। চলচ্চিত্র জগতে ফিরে আসার পিছনে তাঁর এই সিদ্ধান্তের কারণ কী? তাঁর নিজের ভাষায়, “এই সিনেমাটাও করতাম না। সিনেমার গল্পটি আমাকে টেনেছে। একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে যাচ্ছে। মা-বাবারা বড্ড একা। ঘরে ঘরে এই দৃশ্য। সেই সব একা হয়ে যাওয়া মা-বাবাকে আগলে রাখার বার্তা দেবে এই সিনেমা। যা খুব জরুরি।”
রাখি গুলজারের অভিনয় জগতে ফেরার কাহিনী
১৯৬৭ সালে মাত্র ২০ বছর বয়সে ‘বধূ বরণ’ ছবির মাধ্যমে বাংলা চলচ্চিত্রে পা রাখেন রাখি গুলজার। এরপর দীর্ঘ সময় ধরে বলিউড সহ বিভিন্ন চলচ্চিত্রে অভিনয় করে বিশেষ জায়গা করে নিয়েছিলেন। আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে তিনি ধীরে ধীরে চলচ্চিত্র জগৎ থেকে দূরে সরে যান। মাঝে প্রয়াত পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘শুভ মহরৎ’ এবং গৌতম হালদারের ‘নির্বাণ’ ছবিতে অভিনয় করেছিলেন।
এবার দীর্ঘ ২২ বছর পর নন্দিতা রায় ও শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের ‘আমার বস’ ছবির মাধ্যমে আবার অভিনয় জগতে ফিরে এসেছেন রাখি গুলজার। ৯ মে ২০২৫ তারিখে এই ছবি মুক্তি পাবে। ছবিতে শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় অভিনেত্রীর ছেলের চরিত্রে অভিনয় করেছেন।
‘আমার বস’ ছবির প্রতি আকর্ষণের কারণ
সম্প্রতি ‘আমার বস’ ছবির ট্রেইলার লঞ্চ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন রাখি গুলজার। এখানেই তিনি জানিয়েছেন কেন এই ছবিতে অভিনয় করতে রাজি হয়েছেন। আজকের সমাজে একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে যাওয়ার পর মা-বাবারা একাকীত্বের শিকার হচ্ছেন। এই বিষয়টি তাঁকে গভীরভাবে স্পর্শ করেছে।
রাখি গুলজারের মতে, “একসময় বহু ছবিতে অভিনয় করেছি তবে সেইসব ছবি যে আমার জন্য হিট হয়েছে তা আমি মানতে পারি না। কোনওদিন অভিনয় শিখিনি, শেখার প্রয়োজন বোধও করিনি। কারণ বাস্তবেও আমরা প্রত্যেক মুহূর্তে অভিনয় করে চলেছি। তবে এই ছবির গল্প শুনেই আমি ভেবেছিলাম এই ছবিতে আমার কাজ করা উচিত। মা-বাবারা আজ বড্ড একা, যদিও আমার মেয়ে আমাকে নিয়ে থাকতেই ভালবাসে। তবুও বেশিরভাগ মা-বাবাদের সঙ্গেই সন্তানদের দূরত্ব তৈরি হয়, তাই এই সময়ে এই ছবি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।”
ব্যক্তিগত স্মৃতির টান
রাখি গুলজারের অভিনয় জগতে ফেরার পিছনে আরেকটি ব্যক্তিগত কারণও রয়েছে। ট্রেলার লঞ্চ অনুষ্ঠানে তিনি জানান, “কিছুদিন আগেই আমার ভাই শিবুকে হারিয়েছি, তারপরেই শিবপ্রসাদ অর্থাৎ শিবুর সঙ্গে আলাপ। ও আমার সেই ভাইয়ের কথা বারবার মনে করিয়ে দেয়। ওকে বলেছিলাম ও যদি আমার একটা দাবি মানে তবেই আমি কাজ করব। যতবার আমি কলকাতায় আসব মুম্বই থেকে ততবার ওকে আমায় নিয়ে আসতে হবে।”
এই অনুরোধ শিবপ্রসাদ মেনে নিয়েছেন। ট্রেলার লঞ্চ অনুষ্ঠানের আগের দিন মুম্বই গিয়ে রাখি গুলজারকে নিয়ে এসেছিলেন তিনি। অনুষ্ঠানেও হাত ধরে নিয়ে এসেছিলেন রাখি গুলজারকে। এই ধরনের আন্তরিক সম্পর্ক তৈরি হওয়াটাও ছবিতে অভিনয় করার কারণের অন্যতম।
বর্তমান জীবনযাপন ও অভিনয় জগৎ সম্পর্কে ভাবনা
শোবিজ জগতের চাকচিক্য থেকে দূরে সরে গিয়ে আজকাল রাখি গুলজার নিজের মতো করে জীবন কাটাচ্ছেন। ট্রেলার লঞ্চ অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, “এই জগৎ আমাকে আর টানে না। নিজের ফার্ম হাউজ আছে সেখানে পশু, পাখি, গাছপালার সঙ্গ আমার ভাল লাগে। আমার মধ্যে এখনও প্রাণ আছে, এই ভাবেই সময়টা কাটিয়ে দিতে চাই। আমি বিনা পারিশ্রমিকেও একাধিক ছবিতে কাজ করেছি, যাতে সেই ইন্ডাস্ট্রির ভাল হয়। প্রত্যেকের সঙ্গে আমার ভাল সম্পর্ক, আজও আমার কোনও শত্রু নেই। এই কলকাতার হোটেল, রাস্তাঘাট সব আমার চেনা। আবার কবে আসতে পারব জানিনা।”
এই কথা শোনার পর শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় বলে ওঠেন, “একদম এই কথা বলবেন না। আরও অনেক কাজ করতে হবে।” কিন্তু রাখি গুলজার স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেন, “আর না, এবার যাওয়ার সময় তো হয়ে এল।”
ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে প্রত্যাবর্তন এবং সিনেমার গল্প
IFFI 2024-এ ‘আমার বস’ ছবির প্রদর্শনী অনুষ্ঠানে রাখি গুলজার জানিয়েছিলেন, “আমি এখানেই আছি। আমার মেয়ে একটি ছবি তৈরি করছে, আমি সব নতুন অভিনেতা, তরুণ প্রজন্ম এবং আমার সমসাময়িকদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছি। আমি এখানেই আছি। তবে হ্যাঁ, একজন অভিনেত্রী হিসাবে কোনো ছবি বেছে নেওয়ার সিদ্ধান্ত ভেতর থেকেই আসা উচিত। কেউ আমাকে একটি ছবি করতে বাধ্য করতে পারে না। আমি স্ক্রিপ্টটি পছন্দ করেছিলাম, ছবিটি করতে চেয়েছিলাম, তাই করেছি। আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল ছবির বিষয়বস্তু এবং গল্প। আমি এটা পছন্দ করেছি।”
‘আমার বস’ ছবিতে শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় রাখি গুলজারের ছেলের চরিত্রে অভিনয় করেছেন। এই ছবিতে তাদের মা-ছেলের সম্পর্ক বেশ জটিল। রাখি গুলজার বলেন, “সে আমার ছেলের চরিত্রে অভিনয় করেছে, এবং সেই চরিত্রটি খুব বাস্তবসম্মত, তবে মা-ছেলের সম্পর্কে একটি তিক্ত সমীকরণ আছে।”
শুটিংয়ের অভিজ্ঞতা
‘আমার বস’ ছবির শুটিংয়ের সময় রাখি গুলজার মেক-আপ রুমে না থেকে কাস্ট এবং ক্রু সদস্যদের সাথে সময় কাটাতে পছন্দ করতেন। পরিচালকদ্বয় নন্দিতা রায় ও শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় জানান, “‘আমার বস’-এর শুটিংয়ের সময় রাখি দি’র উপস্থিতি প্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করেছে। টেক-এর মাঝে আন্তরিক কথোপকথন বা হাসি-ঠাট্টার হালকা মুহূর্ত ভাগ করে নেওয়া হোক না কেন, রাখি দি’র আন্তরিক উষ্ণতা এবং সহজলভ্যতা সমস্ত কাস্ট এবং ক্রুকে মুগ্ধ করেছিলো, যারা তার শেষ শুটিংয়ের দিন চোখের জলে ভেসে গিয়েছিল… তিনি আমাদের সবাইকে সারা জীবনের স্মৃতি দিয়েছেন।”
মেক-আপ ভ্যানের আরাম এবং নিভৃততা ছেড়ে চলে আসার সিদ্ধান্ত নিয়ে রাখি এমন একটি পরিবেশ তৈরি করেছিলেন যেখানে সবাই নিজেকে সংযুক্ত বোধ করেছে। শুটিংয়ের শেষদিনে দলের সকলের চোখে অশ্রু দেখে তার আন্তরিকতা ও সহৃদয়তার প্রমাণ মেলে।
‘আমার বস’ ছবির প্রথম গান
‘আমার বস’ ছবির প্রথম গান “বসন্ত ডেকেছে আমাকে” শীঘ্রই প্রকাশিত হবে। এই গানটিতে রাখি গুলজারের পাশাপাশি শ্রুতি দাস এবং সৌরসেনী মাইত্র অভিনয় করেছেন। গানটিতে কাঞ্চন মল্লিক এবং গৌরব চট্টোপাধ্যায়ও যোগ দিয়েছেন, যা জীবন এবং সম্পর্কের এই উজ্জ্বল উদযাপনে আরও আকর্ষণ যোগ করেছে।
“বসন্ত ডেকেছে আমাকে” গানটি বিশেষ কারণে আরও তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ এটি অনুপম রায় এবং প্রশ্মিতা পল বিবাহের পর প্রথমবারের মতো একসাথে কাজ করছেন। আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে গানের প্রকাশ সম্পর্কে নন্দিতা এবং শিবপ্রসাদ বলেন, “মহিলারা সবসময় আমাদের গল্পের কেন্দ্রে থেকেছে, এবং ‘আমার বস’ এর ক্ষেত্রেও এটি আলাদা নয়। ‘বসন্ত ডেকেছে আমাকে’ শুধু একটি গান নয় – এটি প্রতিটি মহিলার যাত্রা, তার আত্মা এবং তিনি পৃথিবীতে যে সৌন্দর্য আনেন তার উদযাপন।”
রাখি গুলজারের অভিনয় যাত্রায় এক নতুন অধ্যায়
নন্দিতা রায় ও শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের কাছে রাখি গুলজার অভিনয় করছেন এটি বিশেষ অর্থবহ। নন্দিতা বলেন, “তখন ‘শর্মিলি’ ছবির কাল। রাখিজি সাদা শিফন শাড়িতে সেজে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। সে দিন এক মুহূর্তের জন্য ওঁর থেকে চোখ ফেরাতে পারিনি! সেই নায়িকা আমার ছবিতে অভিনয় করলেন।”
শিবপ্রসাদ জানিয়েছেন, রাখিজির নির্দেশেই তিনি পর্দায় অভিনেত্রীর ছেলের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। এটি তাদের মধ্যে একটি বিশেষ বন্ধন তৈরি করেছে।
রাখি গুলজারের অভিনয় জগতে ফিরে আসার এই যাত্রা আমাদের সকলকে ভাবিয়ে তোলে। ২২ বছর পর তিনি যে ছবিতে অভিনয় করতে এসেছেন, তার বার্তা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ – বয়স্ক মা-বাবাদের একাকীত্ব এবং তাদের প্রতি সমাজের দায়িত্ব। তবে অভিনেত্রী স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, এটিই তার শেষ ছবি। অনুষ্ঠানে শিবপ্রসাদ ও নন্দিতা আবার তাঁকে কাজ করার আহ্বান জানালেও রাখি গুলজার বলেন, “আর না। এটাই শেষ। এ বার তো যাওয়ার পালা!”
রাখি গুলজারের এই ফিরে আসা বাংলা চলচ্চিত্র জগতের জন্য একটি বিশেষ মুহূর্ত। তার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা, অভিনয় দক্ষতা এবং ব্যক্তিত্ব নতুন প্রজন্মের অভিনেতা-অভিনেত্রীদের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে। এই বিশেষ ছবি আগামী ৯ মে ২০২৫ তারিখে মুক্তি পাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে দর্শকরা।