আহমেদাবাদ এয়ার ইন্ডিয়ার একটি যাত্রীবাহী বিমান ভেঙে পড়ার পর শহরের সিভিল হাসপাতালে একের পর এক দগ্ধ দেহ এসে পৌঁছায়, যেগুলির অধিকাংশই এতটাই ঝলসে গিয়েছে যে চেনা সম্ভব হচ্ছে না। এই পরিস্থিতিতে গুজরাত সরকার মৃতদের আত্মীয়-পরিজনদের ডিএনএ নমুনা জমা দিতে বলেছে, যাতে দ্রুত ও নির্ভুলভাবে মৃতদেহ শনাক্ত করা যায়।
বৃহস্পতিবার দুপুরে আহমেদাবাদ বিমানবন্দর থেকে উড়ে যাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই লন্ডনগামী এয়ার ইন্ডিয়া ফ্লাইট AI-171 ভয়াবহ দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। বোয়িং ৭৮৭-৮ ড্রিমলাইনার মডেলের এই বিমানটিতে ২৪২ জন যাত্রী ও ক্রু ছিলেন, যাদের মধ্যে সবাই নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন অসামরিক বিমান পরিবহণ মন্ত্রী। দুর্ঘটনাস্থল ছিল বিমানবন্দর সংলগ্ন মেঘানি নগর এলাকা, যেখানে হোস্টেল, হাসপাতালের কর্মীদের কোয়ার্টার এবং আবাসিক বহুতল রয়েছে। দুর্ঘটনার অভিঘাতে আশেপাশের বাড়িঘরও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যেও আহতের সংখ্যা রয়েছে।
বিমানটি দুপুর ১টা ৩৮ মিনিটে উড়ে যায় এবং মাত্র এক মিনিট পর, পাইলট এটিসি-কে ‘মে ডে কল’ পাঠান, যা মারাত্মক বিপদের সংকেত হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এরপরই বিমানের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই সেটি মেঘানি নগর এলাকায় ভেঙে পড়ে। দুর্ঘটনার কারণ এখনও স্পষ্ট নয়; তদন্তে নেমেছে ডিজিসিএ ও এয়ারক্র্যাফ্ট অ্যাক্সিডেন্ট ইনভেস্টিগেশন ব্যুরো (এএআইবি)। বিমানের ব্ল্যাকবক্স উদ্ধার করা হয়েছে, যার তথ্য বিশ্লেষণের পর প্রকৃত কারণ জানা যাবে বলে মনে করা হচ্ছে।
দুর্ঘটনার পরপরই উদ্ধারকাজে নামে জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী (NDRF)-র তিনটি দল, মোট ৯০ জন কর্মী নিয়ে। আহতদের মধ্যে অন্তত ৫০ জনকে আহমেদাবাদ সিভিল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। হাসপাতালের চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, অধিকাংশ দেহ এতটাই দগ্ধ যে চেনা যাচ্ছে না, এমনকি আহতরাও অচেতন অবস্থায় রয়েছেন এবং তাদের চেহারা ও ত্বক মারাত্মকভাবে পুড়ে গিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে আত্মীয়-পরিজনদের পক্ষে প্রিয়জনকে শনাক্ত করা কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
গুজরাত সরকারের স্বাস্থ্য দফতরের অতিরিক্ত সচিব ধনঞ্জয় দ্বিবেদী জানিয়েছেন, মৃতদের আত্মীয়-পরিজনদের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহের জন্য আহমেদাবাদ সিভিল হাসপাতালের কাসৌটি ভবনে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে মৃতদের বাবা-মা, সন্তান বা নিকট আত্মীয়দের দ্রুত নমুনা জমা দিতে অনুরোধ করা হয়েছে, যাতে শনাক্তকরণ দ্রুত সম্ভব হয়। নমুনা জমা দেওয়ার জন্য দুটি হেল্পলাইন নম্বরও চালু করা হয়েছে—৬৩৫৭৩৭৩৮৩১ এবং ৬৩৫৭৩৭৩৮৪১।
বিমানটিতে ভারত, ব্রিটেন, কানাডা ও পর্তুগালের নাগরিকরাও ছিলেন4। দুর্ঘটনার পরপরই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী ভূপেন্দ্র পটেল ঘটনাস্থল ও হাসপাতালে পৌঁছে যান5। শোক প্রকাশ করেছেন বলিউড অভিনেতা শাহরুখ খান থেকে শুরু করে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসও।
বিমান দুর্ঘটনার অভিঘাত এতটাই প্রবল ছিল যে, আহমেদাবাদের একাধিক হাসপাতাল ও হোস্টেল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দুর্ঘটনার পরপরই বিমানবন্দরের পরিষেবা সাময়িকভাবে বন্ধ থাকলেও, বিকেল ৪টে ৫ মিনিট থেকে পুনরায় পরিষেবা চালু হয়েছে5। যাত্রীদের সংশ্লিষ্ট বিমান সংস্থার ওয়েবসাইটে নজর রাখতে বলা হয়েছে।
‘মে ডে কল’ নিয়ে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, এটি বিমানের মারাত্মক বিপদের সংকেত। পাইলটরা যখন অনুভব করেন, বিমান বা যাত্রীদের জীবন বিপন্ন, তখন এটিসি-কে এই সংকেত পাঠান। ফ্লাইটরাডার২৪-এর তথ্য অনুযায়ী, বিপদবার্তা পাঠানোর পর এটিসি বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করলেও, আর কোনও উত্তর মেলেনি।
এই দুর্ঘটনা নিয়ে তদন্ত চলছে। বোয়িং ৭৮৭ ড্রিমলাইনার মডেলটি সাধারণত অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ও নিরাপত্তার জন্য পরিচিত, এবং এর আগে এই ধরনের মডেলে বড় দুর্ঘটনা ঘটেনি। তাই এই দুর্ঘটনার প্রকৃত কারণ জানতে ব্ল্যাকবক্সের তথ্য ও অন্যান্য প্রযুক্তিগত বিশ্লেষণের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন তদন্তকারীরা।
পরিশেষে বলা যায়, অহমদাবাদে এই মর্মান্তিক বিমান দুর্ঘটনা গোটা দেশকে শোকস্তব্ধ করেছে। মৃতদের পরিচয় শনাক্তে ডিএনএ পরীক্ষার সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে একটি দুঃখজনক কিন্তু অত্যন্ত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ। উদ্ধারকর্মী, প্রশাসন ও চিকিৎসকদের নিরলস প্রচেষ্টায় আহতদের চিকিৎসা ও মৃতদের শনাক্তকরণ প্রক্রিয়া দ্রুত এগিয়ে চলেছে, তবে স্বজনহারা পরিবারগুলির যন্ত্রণা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। প্রশাসন ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের তরফে সবরকম সহযোগিতার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে, যাতে এই শোকের সময়ে পরিবারগুলি অন্তত প্রিয়জনের শেষ পরিচয় পেতে পারে।