আহমেদাবাদের সরদার বল্লভভাই প্যাটেল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে লন্ডনগামী এয়ার ইন্ডিয়ার বিমান দুর্ঘটনায় ২০৪ জনের মৃত্যু এবং ৪১ জনের আহত হওয়ার ঘটনা গোটা দেশকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে দিয়েছে। এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় যে পরিবারগুলোর স্বপ্ন চিরতরে ধূলিসাৎ হয়ে গেছে, তাদের মধ্যে অন্যতম হলো বাঁসওয়াড়ার ডাক্তার দম্পতি ও তাদের তিন সন্তানের পরিবার।
বৃহস্পতিবার দুপুর ১টা ৩৮ মিনিটে আহমেদাবাদ বিমানবন্দর থেকে উড্ডয়নের মাত্র পাঁচ মিনিট পর এয়ার ইন্ডিয়ার AI 171 ফ্লাইটের বোয়িং ৭৮৭-৮ বিমানটি মেঘানী এলাকার ডাক্তারদের হোস্টেলে বিধ্বংসী দুর্ঘটনায় পতিত হয়। বিমানে মোট ২৪২ জন যাত্রী ও ক্রু মেম্বার ছিলেন, যাদের মধ্যে ২৩০ জন যাত্রী, ২ জন পাইলট এবং ১০ জন কেবিন ক্রু অন্তর্ভুক্ত ছিল।
রাজস্থানের বাঁসওয়াড়া থেকে আসা প্রতিক জোশী এবং ডা. কমি ব্যাসের পরিবারের করুণ কাহিনী এই দুর্ঘটনার অন্যতম হৃদয়বিদারক অধ্যায়। প্রতিক জোশী গত ছয় বছর ধরে লন্ডনে সফটওয়্যার পেশায় নিয়োজিত ছিলেন এবং দীর্ঘদিনের স্বপ্ন ছিল তার স্ত্রী ও তিন সন্তানকে নিয়ে বিদেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করা। তার স্ত্রী ডা. কমি ব্যাস একজন চিকিৎসক ছিলেন, যিনি মাত্র দুদিন আগে তার চাকরি থেকে পদত্যাগ করেছিলেন লন্ডনে স্থায়ী বসবাসের প্রস্তুতি হিসেবে।
পরিবারটির তিন সন্তান, যাদের মধ্যে পাঁচ বছর বয়সী যমজ মেয়ে দুটি অন্তর্ভুক্ত ছিল, তারাও এই স্বপ্নের যাত্রায় বাবা-মায়ের সাথে ছিল2। স্থানীয়রা এই দম্পতিকে উচ্চাভিলাষী এবং সংকল্পবদ্ধ হিসেবে স্মরণ করেন – উভয়েই উচ্চশিক্ষিত, নিজ নিজ পেশায় গভীরভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং সন্তানদের প্রতি অত্যন্ত যত্নশীল ছিলেন।
দুর্ঘটনায় রাজস্থান থেকে মোট ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে, যার মধ্যে জোশী পরিবারের পাঁচ সদস্য ছাড়াও উদয়পুরের চার বাসিন্দাও রয়েছেন। উদয়পুরের শুভ মোদি (২৪) এবং শাগুন মোদি (২২), যারা বিখ্যাত মার্বেল ব্যবসায়ী পিঙ্কু মোদির সন্তান ছিলেন, তারা উচ্চশিক্ষার জন্য একসাথে ভ্রমণ করছিলেন। এছাড়াও উদয়পুর জেলার রুন্দেদা গ্রামের বর্দি চাঁদ মেনারিয়া ও প্রকাশ মেনারিয়া এবং বালোত্রার ২৭ বছর বয়সী খুশবু রাজপূরোহিত, যিনি নারী শিক্ষায় স্বেচ্ছাসেবী কাজের জন্য পরিচিত ছিলেন, তারাও এই দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান।
আহমেদাবাদ বিমান দুর্ঘটনা: শনাক্ত করা যাচ্ছে না মৃতদেহ, পরিবারকে ডিএনএ নমুনা জমার নির্দেশ
বিমানে বিভিন্ন জাতীয়তার যাত্রী ছিলেন – ১৬৯ জন ভারতীয়, ৫৩ জন ব্রিটিশ নাগরিক, ১ জন কানাডীয় নাগরিক এবং ৭ জন পর্তুগিজ নাগরিক। ক্যাপ্টেন সুমিত সভারওয়াল এবং ফার্স্ট অফিসার ক্লাইভ কুন্দরের নেতৃত্বে বিমানটি পরিচালিত হচ্ছিল।
প্রত্যক্ষদর্শী হরেশ শাহ জানান যে বিমানটি খুবই নিচু দিয়ে উড়ছিল এবং সরকারি কলেজের ডাক্তারদের আবাসিক কোয়ার্টারে আছড়ে পড়ে। দীর্ঘ দূরত্বের যাত্রার জন্য বিমানটিতে প্রচুর জ্বালানি ছিল, যা দুর্ঘটনার পর বিস্ফোরণ ও আগুনের তীব্রতা বৃদ্ধি করেছিল। উদ্ধার কাজে বাধার সৃষ্টি করেছে এই জ্বালানির কারণে সৃষ্ট প্রবল আগুন।
ঘটনাস্থলে দ্রুত জরুরি টিম, ফায়ার ইঞ্জিন এবং অ্যাম্বুলেন্স পাঠানো হয়েছে উদ্ধার অভিযান পরিচালনার জন্য। পাইলট উড্ডয়নের কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলে “May Day” বার্তা পাঠিয়েছিলেন। ভারতীয় মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন গুজরাত তিনজন এমবিবিএস শিক্ষার্থীর মৃত্যু নিশ্চিত করেছে এবং জানিয়েছে যে ৪৫ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এই ঘটনায় “স্তব্ধ ও দুঃখিত” হওয়ার কথা জানিয়ে শোক প্রকাশ করেছেন। গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী ভূপেন্দ্র প্যাটেল এই ট্র্যাজেডিতে গভীর দুঃখ প্রকাশ করে ঘটনাস্থলে উদ্ধার ও ত্রাণ কাজ ত্বরান্বিত করার নির্দেশ দিয়েছেন। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী, রাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং আহমেদাবাদ পুলিশ কমিশনারের সাথে এই ঘটনা নিয়ে আলোচনা করেছেন।
টাটা গ্রুপ দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণকারী প্রতিটি পরিবারের জন্য ১ করোড় টাকা ক্ষতিপূরণের ঘোষণা দিয়েছে। এয়ার ইন্ডিয়া যাত্রীদের পরিবারের জন্য হটলাইন নম্বর ১৮০০ ৫৬৯১ ৪৪৪ চালু করেছে এবং তদন্তকারী কর্তৃপক্ষের সাথে পূর্ণ সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে6। বেসামরিক বিমান পরিবহন অধিদপ্তর (ডিজিসিএ) আনুষ্ঠানিক তদন্ত শুরু করবে বলে আশা করা হচ্ছে, সম্ভবত বোয়িং থেকে একটি প্রযুক্তিগত দল দুর্ঘটনার কারণ নির্ধারণে সহায়তা করবে।
এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা শুধু একটি বিমান দুর্ঘটনা নয়, বরং অসংখ্য পরিবারের স্বপ্ন ও আশার চিরতরে বিলুপ্তি। বিশেষত ডা. কমি ব্যাস ও প্রতিক জোশীর পরিবারের মতো যারা নতুন জীবনের স্বপ্ন নিয়ে এই যাত্রায় বেরিয়েছিলেন, তাদের অকাল প্রয়াণ গোটা জাতিকে গভীর শোকে নিমজ্জিত করেছে।