মাত্র ৩০ সেকেন্ডেই শেষ! এয়ার ইন্ডিয়া প্লেন বিধ্বস্ত হওয়ার পেছনের কারণ নিয়ে বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ
real reason behind Ahmedabad plane crash: ২০২৫ সালের ১২ই জুন, দুপুর ১টা ৩৮ মিনিটে আহমেদাবাদ থেকে লন্ডনের গ্যাটউইক বিমানবন্দরের উদ্দেশ্যে রওনা দেয় এয়ার ইন্ডিয়ার বোয়িং ৭৮৭-৮ ড্রিমলাইনার (ফ্লাইট AI171)। বিমানে ছিলেন ২৩০ জন যাত্রী ও ১২ জন ক্রু। উড্ডয়নের মাত্র ৩০ সেকেন্ডের মধ্যে বিমানটি শহরের মেঘানিনগর এলাকার একটি মেডিকেল কলেজ হোস্টেলের ওপর ভেঙে পড়ে। মুহূর্তেই আগুন ধরে যায়, এবং বিস্ফোরণে বিমানের অধিকাংশ অংশ ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। এই ভয়াবহ দুর্ঘটনায় ২৪১ জন যাত্রী ও ক্রু এবং হোস্টেল ভবনের আরও কয়েকজন প্রাণ হারান। অলৌকিকভাবে বেঁচে যান কেবল একজন—ব্রিটিশ নাগরিক বিশ্বাস কুমার রমেশ, যিনি এখনো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
ঘটনার পূর্ণ বিবরণ: মুহূর্তে মুহূর্তে কী ঘটেছিল
- উড্ডয়নের ঠিক পরেই, বিমানটি স্বাভাবিক উচ্চতায় উঠতে পারেনি।
- পাইলট ‘Mayday’ সংকেত পাঠান, কিন্তু এরপর আর কোনো যোগাযোগ ছিল না।
- বিমানটি দ্রুত উচ্চতা হারিয়ে হোস্টেল ভবনের ওপর আছড়ে পড়ে।
- বিস্ফোরণের পর ঘন কালো ধোঁয়া চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে, স্থানীয় বাসিন্দা ও উদ্ধারকারী দল ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন।
- প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন এবং আহতদের খোঁজ নেন।
বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টিতে: কেন ভেঙে পড়ল এয়ার ইন্ডিয়ার প্লেন?
সম্ভাব্য ৪টি কারণ নিয়ে আলোচনা
১. ল্যান্ডিং গিয়ার ত্রুটি:
বিশেষজ্ঞদের মতে, বিমানের ল্যান্ডিং গিয়ার (চাকা ও ভার নিয়ন্ত্রণকারী যন্ত্রাংশ) উড্ডয়নের পর ঠিকমতো বন্ধ হয়নি। এতে বিমানের গতি ও ভারসাম্য বিঘ্নিত হয়। সাধারণত উড্ডয়নের পাঁচ সেকেন্ডের মধ্যে গিয়ার বন্ধ করা হয়, না হলে অতিরিক্ত ঘর্ষণ ও জ্বালানি খরচ বাড়ে, এবং গতি কমে যায়। এই গোলমাল থেকেই দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
২. ইঞ্জিনের শক্তি হারানো:
কয়েকজন বিশেষজ্ঞ বলছেন, বিমানের ইঞ্জিনে গুরুতর ত্রুটি দেখা দিয়েছিল। ভিডিও বিশ্লেষণে দেখা যায়, বিমানটি সর্বোচ্চ ৩২২ কিমি/ঘণ্টা গতিতে উঠতে পেরেছিল—যা স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক কম। ইঞ্জিনে শক্তি না থাকলে দ্রুত উচ্চতা হারিয়ে ফেলে বিমান, যা এই দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ বলে মনে করা হচ্ছে।
৩. ফ্ল্যাপ বা উইং কনফিগারেশনের সমস্যা:
বিমানের ডানার ফ্ল্যাপ (উড্ডয়নের সময় অতিরিক্ত লিফ্ট তৈরির জন্য ব্যবহৃত অংশ) সঠিকভাবে অবস্থান করছিল না কি, এ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন বিশেষজ্ঞরা। ভুল কনফিগারেশনের কারণে পর্যাপ্ত লিফ্ট না পেলে বিমান দ্রুত নিচে নেমে আসে।
৪. ওজন ও পাওয়ার ক্যালকুলেশনে ভুল:
বিমানের কম্পিউটার সিস্টেমে ওজন সংক্রান্ত ভুল তথ্য দিলে, প্রয়োজনীয় পাওয়ার কম মঞ্জুর হতে পারে। এতে রানওয়ে শেষ হওয়ার আগেই বিমান পর্যাপ্ত গতি বা লিফ্ট পায় না।
আরও কিছু সম্ভাব্য কারণ
- দ্বৈত ইঞ্জিন ফেলিওর বা পাখির ধাক্কা:
কিছু বিশেষজ্ঞ সন্দেহ করছেন, হয়তো দুই ইঞ্জিনই একসঙ্গে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল বা রানওয়ে ছাড়ার সময় বড় কোনো পাখির ধাক্কা লেগেছিল। যদিও ভিডিও ফুটেজে এর স্পষ্ট প্রমাণ মেলেনি, তবে তদন্তকারীরা এই দিকটিও খতিয়ে দেখছেন। - পাইলটের শেষ মুহূর্তের সিদ্ধান্ত:
দুর্ঘটনার ঠিক আগ মুহূর্তে পাইলটরা বিমানটির সামনের অংশ তুলতে চেষ্টা করেন, যাতে জনবহুল এলাকায় সরাসরি না পড়ে। এতে গতি আরও কমে যায় এবং বিমানটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে।
তদন্ত ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা
ভারতের এয়ারক্র্যাফ্ট অ্যাক্সিডেন্ট ইনভেস্টিগেশন ব্যুরো (AAIB) ইতিমধ্যেই তদন্ত শুরু করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ট্রান্সপোর্টেশন সেফটি বোর্ড (NTSB), ফেডারেল অ্যাভিয়েশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (FAA) এবং জেনারেল ইলেকট্রিক (GE) বিশেষজ্ঞ দল ভারতের তদন্তকারীদের সহায়তা করছে। দুর্ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার হয়েছে ব্ল্যাক বক্স, যার তথ্য বিশ্লেষণেই প্রকৃত কারণ জানা যাবে।
পরিসংখ্যান ও অতীতের নজির
- বোয়িং ৭৮৭-৮ ড্রিমলাইনারের ১৬ বছরের ইতিহাসে এটিই প্রথম বড় দুর্ঘটনা।
- ভারতের ইতিহাসে এটি অন্যতম ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনা, যেখানে ২৬৫ জনেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
- অতীতে বোয়িং ৭৮৭ মডেলে বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি, ফলে এই ঘটনা আন্তর্জাতিক বিমান নিরাপত্তা নিয়ে নতুন প্রশ্ন তুলেছে।
এয়ার ইন্ডিয়া প্লেন বিধ্বস্তের প্রকৃত কারণ এখনো তদন্তাধীন। তবে বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণে উঠে এসেছে—ল্যান্ডিং গিয়ার ত্রুটি, ইঞ্জিনের শক্তি হারানো, ফ্ল্যাপ কনফিগারেশনের গোলমাল, কিংবা ওজন ও পাওয়ার ক্যালকুলেশনের ভুল—এই চারটি বিষয়ই সবচেয়ে বেশি সন্দেহভাজন। ব্ল্যাক বক্সের তথ্য বিশ্লেষণ শেষ হলে চূড়ান্ত কারণ জানা যাবে। এই দুর্ঘটনা আবারও মনে করিয়ে দিল, আধুনিক প্রযুক্তি ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার পরও বিমান চলাচলে সর্বোচ্চ সতর্কতা ও দক্ষতা অপরিহার্য।