বিমানে যাত্রা করার সময় আপনি কি কখনও লক্ষ্য করেছেন যে আপনি সবসময় বিমানের বাম দিক থেকেই উঠছেন? এটি কোনো কাকতালীয় ঘটনা নয়, বরং এর পিছনে রয়েছে বেশ কিছু যুক্তিসঙ্গত কারণ। আসুন জেনে নেওয়া যাক কেন বিমানে ওঠার দরজা সবসময় বাম পাশেই থাকে।
বিমানে বাম দিক থেকে ওঠার রীতিটি আসলে নৌযানের ঐতিহ্য থেকে এসেছে। প্রাচীনকাল থেকেই জাহাজে যাত্রীরা বাম দিক বা পোর্ট সাইড দিয়ে ওঠানামা করত। বিমান যখন আবিষ্কার হলো, তখন এই রীতিটি স্বাভাবিকভাবেই বিমান শিল্পেও অনুসরণ করা হয়েছিল।
দ্য এভিয়েশন হিস্টোরিয়ান পত্রিকার সম্পাদক মাইকেল ওকলে বলেন, “এটি এমন একটি বিমান চর্চা যা বিমান শিল্পের আগে থেকেই চলে আসছে। বিমান শব্দাবলীর অনেক কিছুই সামুদ্রিক ঐতিহ্য থেকে এসেছে, যেমন রাডার, ককপিট, কেবিন, বালখেড, নট ইত্যادি। একইভাবে বিমানের কাজের পদ্ধতিও অনেকটা নৌযান থেকে ধার করা।”
কার্যকরী কারণ
বাম দিক থেকে বিমানে ওঠার পিছনে রয়েছে বেশ কিছু কার্যকরী কারণও এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:
পাইলটের দৃষ্টিভঙ্গি
বিমানের ক্যাপ্টেন সাধারণত বাম দিকে বসেন। তাই বিমানটিকে টার্মিনালের সাথে সঠিকভাবে সংযুক্ত করার জন্য বাম দিকে দরজা থাকা সুবিধাজনক। এতে করে পাইলট সহজেই বিমানটিকে জেটব্রিজের সাথে সঠিকভাবে অবস্থান করাতে পারেন।
একজন বোয়িং ৭৮৭ ক্যাপ্টেন দ্য ডেইলি মেইলকে জানিয়েছেন, “বাম দিকে দরজা থাকায় পাইলট সহজেই বিমানের ডানা এবং টার্মিনাল ভবনের মধ্যে দূরত্ব অনুমান করতে পারেন। এতে করে বিমানটিকে নিরাপদে পার্ক করা সম্ভব হয়।”
ভারতের ক্রিকেট তারকাদের প্রাইভেট বিমান: বিলাসিতা ও সাফল্যের প্রতীক
গ্রাউন্ড ক্রুদের কাজের সুবিধা
যাত্রীরা যখন বাম দিক দিয়ে বিমানে ওঠেন, তখন গ্রাউন্ড ক্রুরা ডান দিকে নিরাপদে এবং নির্বিঘ্নে তাদের কাজ করতে পারেন। এরোস্পেস ইঞ্জিনিয়ার বিষ্ণু রবি কোরায় লিখেছেন, “যাত্রীরা বাম দিক দিয়ে ওঠার সময় গ্রাউন্ড ক্রুরা মূলত ডান দিকে জ্বালানি ভরা এবং লাগেজ লোড করার মতো কাজগুলো করেন। বাম দিক দিয়ে ওঠা-নামা করায় তাদের কাজের ক্ষেত্রে কোনো বাধা সৃষ্টি হয় না।”
নিরাপত্তা বিবেচনা
সিভিল এভিয়েশন অথরিটি (CAA) জানিয়েছে, নিরাপত্তার দিক থেকেও বাম দিক দিয়ে বিমানে ওঠা-নামা করা যুক্তিযুক্ত। CAA বলেছে, “বিমানের হোল্ডে প্রবেশের পথ সাধারণত ডান দিকে থাকে, যার ফলে সেখানে যানবাহনের চলাচল বেশি থাকে। এছাড়া অনেক বড় বাণিজ্যিক বিমানে জ্বালানি ভরার কাজও ডান দিকে করা হয়। তাই যাত্রীদের গ্রাউন্ড সার্ভিসিং কার্যক্রম থেকে আলাদা রাখা নিরাপত্তার দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ।”
কাঠামোগত কারণ
বিমানের কাঠামোগত ডিজাইনও বাম দিকে দরজা রাখার একটি কারণ। বোয়িং ৭৮৭ ক্যাপ্টেনের মতে, “ডান দিকের সার্ভিস দরজাগুলো ছোট রাখা হয় যাতে বিমানের কাঠামোতে বেশি শক্তি থাকে। বড় দরজার জন্য বেশি শক্তিশালী কাঠামো প্রয়োজন। তাই যাত্রীরা যেহেতু বাম দিক দিয়ে ওঠে, সেদিকে বড় দরজা রাখা হয়।”
বিমান বোর্ডিং প্রক্রিয়ার ক্রমবিকাশ
যদিও বর্তমানে বাম দিক দিয়ে বিমানে ওঠা একটি সার্বজনীন রীতি, কিন্তু এটি সবসময় এমন ছিল না। বিমান শিল্পের শুরুর দিকে এ ব্যাপারে কোনো কঠোর নিয়ম ছিল না।
দ্য এভিয়েশন হিস্টোরিয়ানের সম্পাদক মাইকেল ওকলে জানিয়েছেন, “বাণিজ্যিক বিমান চলাচলের শুরুর দিকে যাত্রীরা কোন দিক দিয়ে উঠবে সেটা খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। কারণ তখন সব যাত্রীই রানওয়েতে সিঁড়ি বেয়ে উঠত ও নামত।”
Left Side Belly Pain: পেটের বাম পাশে নিচের দিকে ব্যথা হয় কেন? কারণ জানলে সতর্ক হবেন আপনিও
ন্যাশনাল এয়ার অ্যান্ড স্পেস মিউজিয়ামের কিউরেটর বব ভ্যান ডার লিন্ডেন বলেছেন, “১৯৩০ এর দশকে প্রথম আধুনিক যাত্রীবাহী বিমান বোয়িং ২৪৭ এর যাত্রী দরজা ছিল ডান দিকে, যা তখন ইউনাইটেড এয়ারলাইন্সের রীতি ছিল। কিন্তু ১৯৪০ এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে যখন ইউনাইটেড উন্নত ডগলাস ডিসি-৩ বিমান কিনল, তখন তারা বাম দিকে দরজা চেয়েছিল। ধীরে ধীরে বিমান শিল্প বড় হওয়ার সাথে সাথে এবং বিমানবন্দরগুলো ব্যস্ত হয়ে ওঠার সাথে সাথে, বাম দিকের দরজা ব্যবস্থাটাই পছন্দসই হয়ে ওঠে। এতে করে বিমানবন্দরের কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে এবং একই ধরনের পদ্ধতিতে পরিচালনা করা সম্ভব হয়।”
বর্তমান প্রবণতা
বর্তমানে প্রায় সব বাণিজ্যিক বিমানেই বাম দিকে দরজা রাখা হয়। তবে কিছু ছোট বিমানে এখনও ডান দিকে দরজা রাখার রীতি রয়েছে।
মিউজিয়াম অফ ফ্লাইটের সিনিয়র কিউরেটর ম্যাথিউ বারচেট জানিয়েছেন, “মুনি এম-২০ এর মতো কিছু ছোট বিমানে এখনও যাত্রীরা ডান দিক দিয়ে ওঠে। এতে করে পাইলট প্রথমে উঠতে পারেন, তারপর পাশের যাত্রী।”
তবে জরুরি অবস্থা বা অসুবিধার কারণে কখনও কখনও বড় বিমানের ডান দিকের দরজাও যাত্রীদের জন্য ব্যবহার করা হতে পারে।
বোর্ডিং সময় কমানোর প্রচেষ্টা
যদিও বাম দিক দিয়ে বিমানে ওঠার রীতি এখন প্রতিষ্ঠিত, তবুও বিমান বোর্ডিংয়ের সময় কমানোর জন্য বিভিন্ন এয়ারলাইন নতুন নতুন পদ্ধতি পরীক্ষা করছে।
ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, সাউথওয়েস্ট এয়ারলাইন্স বোর্ডিং প্রক্রিয়া থেকে ৫ মিনিট কমানোর উপায় খুঁজছে। বর্তমানে ছোট বিমানের (যেমন বোয়িং ৭৩৭) জন্য বোর্ডিং সময় প্রায় ৪০ মিনিট এবং বড় বিমানের জন্য ৫০ মিনিট।
সাউথওয়েস্ট এয়ারলাইন্সের চিফ অপারেটিং অফিসার অ্যান্ড্রু ওয়াটারসন বলেছেন, “যদি আপনি প্রতিটি টার্নে এই মিনিটগুলো সংগ্রহ করতে পারেন, তাহলে আপনি আরও বেশি উড়ান শুরু করতে পারবেন।” এই লক্ষ্যে তারা হার্টসফিল্ড-জ্যাকসন আটলান্টা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের চারটি গেটে ১১টি ভিন্ন সময় সাশ্রয়ী ধারণা পরীক্ষা করছে।
এই ধারণাগুলোর মধ্যে রয়েছে:
– গেট এজেন্ট, গ্রাউন্ড ক্রু এবং ফ্লাইট ক্রুর মধ্যে উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা
– বোর্ডিং শুরুর অনেক আগে থেকেই বড় আকারের ব্যাগ চেক করা বা পোষ
া প্রাণীদের কার্গো হোল্ডে রাখা
– যাত্রীদের আগে থেকেই সিট নম্বর জানিয়ে দেওয়া
– বিমানের পিছনের দিক থেকে বোর্ডিং শুরু করা
বোর্ডিং প্রক্রিয়ার চ্যালেঞ্জ
যদিও বিমানে ওঠার দরজা বাম দিকে রাখার পিছনে যুক্তিসঙ্গত কারণ রয়েছে, তবুও বোর্ডিং প্রক্রিয়া নিয়ে এখনও নানা চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য:
সময় ব্যবস্থাপনা
গবেষণায় দেখা গেছে, বিমানে ওঠার সময় যাত্রীদের গড় সময় লাগে প্রায় ২০ সেকেন্ড। কিন্তু এই সময় বেড়ে যায় যখন যাত্রীরা ওভারহেড বিনে লাগেজ রাখতে গিয়ে অন্যদের পথ আটকে দেয়।
জার্নাল অফ এয়ার ট্রান্সপোর্ট ম্যানেজমেন্টে প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যাত্রীদের মাত্র ২৫% এর কারণে বোর্ডিং সময়ের ৪২.৫% নষ্ট হয়। এই সমস্যা সমাধানে বিভিন্ন এয়ারলাইন বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করছে।
সিট বরাদ্দকরণ
সিট বরাদ্দকরণের ক্ষেত্রেও চ্যালেঞ্জ রয়েছে। অনেক এয়ারলাইন এখন র্যান্ডম সিট বরাদ্দকরণ পদ্ধতি ব্যবহার করছে, যা কিছু যাত্রীর জন্য অসুবিধাজনক হতে পারে।
ইউনিভার্সিটি অফ ইলিনয়ের গবেষক জেসন স্টেফি বলেছেন, “র্যান্ডম সিট বরাদ্দকরণ পদ্ধতি বোর্ডিং সময় কমাতে সাহায্য করে। কিন্তু এতে পরিবার বা একসাথে ভ্রমণকারী দলের সদস্যরা আলাদা হয়ে যেতে পারে।”
ভবিষ্যতের সম্ভাবনা
বিমান শিল্পে প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে বোর্ডিং প্রক্রিয়াও পরিবর্তিত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ভবিষ্যতে আমরা নিম্নলিখিত পরিবর্তনগুলো দেখতে পারি:
বায়োমেট্রিক বোর্ডিং
অনেক বিমানবন্দর ইতিমধ্যেই চেহারা শনাক্তকরণ প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। ভবিষ্যতে এই প্রযুক্তি বোর্ডিং প্রক্রিয়াকেও দ্রুততর করতে পারে।
এয়ারপোর্ট টেকনোলজি স্পেশালিস্ট মার্টিন বোওয়েন বলেছেন, “বায়োমেট্রিক বোর্ডিং পাসপোর্ট বা বোর্ডিং পাস দেখানোর প্রয়োজনীয়তা দূর করবে। এতে করে বোর্ডিং প্রক্রিয়া অনেক দ্রুত হবে।”
স্মার্ট বিমানবন্দর
ভবিষ্যতের বিমানবন্দরগুলো আরও স্মার্ট হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এতে করে যাত্রীদের চলাচল আরও সহজ হবে।
ইন্টারন্যাশনাল এয়ার ট্রান্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশন (IATA) এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, “স্মার্ট বিমানবন্দরগুলো যাত্রীদের স্মার্টফোনে রিয়েল-টাইম তথ্য প্রদান করবে। এতে করে তারা সহজেই নিজেদের গেট খুঁজে পাবে এবং বোর্ডিং সময় সম্পর্কে জানতে পারবে।”
ভার্চুয়াল রিয়ালিটি
কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করেন, ভবিষ্যতে ভার্চুয়াল রিয়ালিটি প্রযুক্তি বোর্ডিং প্রক্রিয়াকে আরও সহজ করতে পারে।
এভিয়েশন কনসালট্যান্ট জন স্মিথ বলেছেন, “ভার্চুয়াল রিয়ালিটি হেডসেট ব্যবহার করে যাত্রীরা আগে থেকেই বিমানের ভেতরের দৃশ্য দেখতে পারবেন। এতে করে তারা আগে থেকেই জানতে পারবেন কোথায় তাদের সিট, কোথায় লাগেজ রাখতে হবে। এতে বোর্ডিং প্রক্রিয়া আরও দ্রুত হবে।”
বিমানে ওঠার দরজা বাম পাশে রাখার পিছনে রয়েছে ঐতিহাসিক, কার্যকরী এবং নিরাপত্তাজনিত নানা কারণ। এই রীতি বিমান শিল্পকে একটি সুনির্দিষ্ট কাঠামোতে আনতে সাহায্য করেছে। তবে প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে বোর্ডিং প্রক্রিয়াও পরিবর্তিত হচ্ছে।
যদিও বাম দিক দিয়ে বিমানে ওঠার রীতি আগামী দিনেও চলতে থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে, তবুও বোর্ডিং প্রক্রিয়াকে আরও দক্ষ ও যাত্রী-বান্ধব করার জন্য নতুন নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন করা হচ্ছে। ভবিষ্যতে হয়তো আমরা এমন একটি সময় দেখব যখন বিমানে ওঠা হবে আরও দ্রুত, সহজ এবং আরামদায়ক।
বিমান ভ্রমণের ক্রমবর্ধমান চাহিদার সাথে তাল মিলিয়ে, বিমান শিল্প ও প্রযুক্তি খাত মিলে কাজ করছে যাত্রীদের অভিজ্ঞতাকে আরও উন্নত করতে। তাই আগামী দিনে বিমানে ওঠার অভিজ্ঞতা হয়তো আজকের চেয়ে অনেক ভিন্ন হবে। কিন্তু যতই পরিবর্তন আসুক না কেন, বিমানের বাম দিকের দরজা হয়তো সবসময়ই থাকবে যাত্রীদের স্বাগত জানাতে।