Benefits of basil seeds: তুলসী গাছের পাতার গুণাগুণ সম্পর্কে আমরা সবাই জানি, কিন্তু এর বীজের অসাধারণ উপকারিতা সম্পর্কে অনেকেই অবগত নন। সবজা বীজ, ফালুদা বীজ বা টুকমারিয়া বীজ নামেও পরিচিত এই ছোট কালো বীজগুলি পুষ্টিতে ভরপুর এবং নানা স্বাস্থ্য সমস্যার সমাধানে সাহায্য করে। আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায় তুলসী গাছের প্রতিটি অংশেরই বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। আজকের এই আর্টিকেলে আমরা জানব তুলসীর বীজের বিভিন্ন উপকারিতা এবং কীভাবে এটি আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার করা যায়।
তুলসীর বীজ কি?
তুলসীর বীজ হল মিষ্টি তুলসী গাছ থেকে প্রাপ্ত ছোট, কালো বীজ যা দেখতে চিয়া বীজের মতো হলেও এদের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। এই বীজগুলি কুলফি, ফালুদা এবং বিভিন্ন পানীয়ে ব্যবহার করা হয়। প্রাচীনকাল থেকেই চীনা এবং আয়ুর্বেদিক ওষুধে এর গুরুত্ব স্বীকৃত, তবে সাধারণ মানুষ সাম্প্রতিক সময়ে এর স্বাস্থ্য উপকারিতা সম্পর্কে সচেতন হয়েছে1।
তুলসীর বীজ পানিতে ভিজালে ফুলে উঠে এবং একটি জেল-সদৃশ আবরণ তৈরি করে, যা এদের ব্যবহারকে বিশেষ করে তোলে। এই বৈশিষ্ট্যটি এদেরকে হজম প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে ত্বকের যত্নে বিভিন্ন ভাবে ব্যবহার করার সুযোগ দেয়।
তুলসীর বীজের পুষ্টিগুণ
তুলসীর বীজ পুষ্টিগুণে ভরপুর, যা এদেরকে স্বাস্থ্যকর খাদ্য হিসেবে বিবেচনা করার কারণ1। এই বীজের পুষ্টিগুণ সম্পর্কে জানা যাক:
-
ক্যালোরি: ১ টেবিল চামচ তুলসীর বীজে মাত্র ৫৭ কিলোক্যালোরি থাকে
-
কার্বোহাইড্রেট: প্রায় ৪২% বা ৭ গ্রাম প্রতি টেবিল চামচে
-
প্রোটিন: ২০% বা প্রায় ২ গ্রাম প্রতি টেবিল চামচে
-
স্বাস্থ্যকর চর্বি: ২৫% বা ২.৫ গ্রাম প্রতি টেবিল চামচে
-
ফাইবার: ৭ গ্রাম প্রতি টেবিল চামচে, যা চিয়া বীজের তুলনায় বেশি
-
খনিজ: ক্যালসিয়াম, আয়রন, ম্যাগনেশিয়াম, কপার, ম্যাঙ্গানিজ
-
ভিটামিন: ফোলেট, ভিটামিন সি
-
ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড: পর্যাপ্ত পরিমাণে
এই পুষ্টিগুণ তুলসীর বীজকে শুধু স্বাদযুক্ত করেই নয়, বরং অনেক স্বাস্থ্য সমস্যার সমাধানেও সহায়তা করে।
তুলসীর বীজের স্বাস্থ্য উপকারিতা
প্রাকৃতিক শরীরের কুল্যান্ট
গরমে শরীরকে ঠান্ডা রাখতে তুলসীর বীজ অত্যন্ত কার্যকরী। এটি প্রাকৃতিকভাবে শরীরের তাপমাত্রা কমাতে সাহায্য করে। গ্রীষ্মের মাসগুলিতে তুলসীর বীজ মিশ্রিত পানীয় পান করলে শারীরিক তাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় এবং ত্বকের জ্বালাপোড়া এবং রোদে পোড়া সমস্যা থেকেও উপশম পাওয়া যায়।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সহায়ক
তুলসীর বীজে উপস্থিত ডায়েটারি ফাইবার রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। বিশেষত টাইপ-২ ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য এটি খুবই উপকারী। নিয়মিত তুলসীর বীজ সেবন করলে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে কমাতে সাহায্য করে, যা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
ওজন কমাতে সহায়ক
যারা ওজন কমাতে চান, তাদের জন্য তুলসীর বীজ একটি উত্তম পছন্দ। ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিডে ভরপুর এই বীজ খিদে কমাতে সাহায্য করে। এতে প্রচুর ফাইবার থাকায় অল্প পরিমাণে খেলেও দীর্ঘক্ষণ পেট ভরা থাকে, যা আপনাকে অতিরিক্ত খাবার থেকে বিরত রাখতে সাহায্য করে।
হজম সমস্যার সমাধান
কোষ্ঠকাঠিন্য, অ্যাসিডিটি এবং পেটের অন্যান্য সমস্যার সমাধানে তুলসীর বীজ অত্যন্ত কার্যকরী। এতে উপস্থিত দ্রবণীয় ফাইবার জল শোষণ করে অন্ত্রে টানতে পারে, যা মলকে নরম করে এবং মসৃণ মলত্যাগে সহায়তা করে। এছাড়া তুলসীর বীজে থাকা পেকটিন প্রোবায়োটিক বৈশিষ্ট্য হিসেবে কাজ করে, যা অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়ার বিপাক ও সংমিশ্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
পাইলস নিরাময়ে কার্যকরী
তুলসীর বীজে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার থাকে যা হজম সংক্রান্ত সমস্যা দূর করে। দীর্ঘদিনের কোষ্ঠকাঠিন্য থেকে পাইলস সমস্যা হতে পারে, এবং তুলসীর বীজ এই সমস্যা প্রতিরোধে সাহায্য করে। তুলসীর বীজের প্রদাহবিরোধী বৈশিষ্ট্য পাইলসের সাথে জড়িত ব্যথা, ফোলাভাব এবং লালভাব কমাতে সাহায্য করে।
ত্বক ও চুলের জন্য উপকারী
তুলসীর বীজে উপস্থিত অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট এবং ফ্ল্যাভোনয়েড ত্বকের জন্য অত্যন্ত উপকারী। এর অ্যান্টি-মাইক্রোবিয়াল এবং অ্যান্টি-ফাঙ্গাল বৈশিষ্ট্য ত্বকের সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে। বিশেষত, এগজিমা এবং সোরিয়াসিসের মতো ত্বকের রোগের চিকিৎসায় তুলসীর বীজ ব্যবহার করা হয়। নারকেল তেলের সাথে মিশিয়ে এই বীজ ব্যবহার করলে এগজিমা এবং সোরিয়াসিসের মতো ত্বকের রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
তুলসীর বীজে উপস্থিত অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট চুলের বৃদ্ধিতেও সহায়তা করে। নিয়মিত ব্যবহারে চুল ঝরা কমে এবং চুলের স্বাস্থ্য উন্নত হয়।
রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সহায়ক
তুলসীর বীজ রক্ত পাতলা করে শরীরে রক্তের সঞ্চালন বাড়ায়। ফলে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে। উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন এমন ব্যক্তিদের জন্য নিয়মিত তুলসীর বীজ সেবন উপকারী হতে পারে।
মুখের স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী
তুলসীর বীজের অ্যান্টি-ভাইরাল, অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল এবং অ্যান্টি-ফাঙ্গাল বৈশিষ্ট্য মুখের আলসার নিরাময় করতে এবং মুখের ফ্রেশনার হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। এছাড়া দাঁতের বিভিন্ন সমস্যা, ফলক, গহ্বর এবং নিঃশ্বাসের দুর্গন্ধের বিরুদ্ধে লড়াই করতেও তুলসীর বীজ সাহায্য করে।
তুলসীর বীজ বনাম চিয়া বীজ: কোনটি বেশি উপকারী?
তুলসীর বীজ ও চিয়া বীজ – উভয়ই উপকারী, তবে কিছু ক্ষেত্রে এদের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে
চিয়া বীজে প্রোটিন কিছুটা বেশি থাকে, যেখানে তুলসীর বীজে ফাইবারের পরিমাণ বেশি। গরমের দিনে শরীর ঠান্ডা রাখার জন্য তুলসীর বীজ চিয়া বীজের তুলনায় বেশি কার্যকর।
চিয়া বীজ ভিজতে অন্তত ঘণ্টাখানেক সময় লাগে, অন্যদিকে তুলসীর বীজ দ্রুত ভিজে যায়। পেটের স্বাস্থ্যের কথা ভাবলে, চিয়ার চেয়ে তুলসীর বীজ অধিক উপকারী।
ব্রণের সমস্যা থাকলে বা অম্বল-গ্যাসের সমস্যা হলে চিয়ার বদলে তুলসীর বীজ সেবন করা বেশি ভালো।
তুলসীর বীজ কীভাবে ব্যবহার করবেন
তুলসীর বীজ নানাভাবে ব্যবহার করা যায়, আসুন দেখে নেই কিছু সহজ ব্যবহারবিধি:
সাধারণ ভিজানো পদ্ধতি
১. এক গ্লাস পানিতে এক চা চামচ পরিমাণ তুলসীর বীজ ভিজিয়ে রাখুন
২. ৭-৮ ঘন্টা ভিজিয়ে রেখে পানিসহ তুলসীর বীজ পান করুন
৩. সকালে ভিজিয়ে রেখে রাতে খেতে পারেন অথবা সন্ধ্যায় ভিজিয়ে রেখে পরদিন সকালে খেতে পারেন
পানীয়তে ব্যবহার
তুলসীর বীজ বিভিন্ন পানীয়তে যোগ করা যেতে পারে:
-
নারিকেলের পানি
-
লেমোনেড
-
স্মুদি
-
মিল্কশেক
-
দই
-
দুধের সাথে
বিশেষত গরমের দিনে পাতিলেবুর শরবত বা কুলুক্কি (পাতিলেবুর রস, চিনির সিরাপ, তুলসীর বীজ, মশলা সহযোগে তৈরি পানীয়) তে তুলসীর বীজ ব্যবহার করা অত্যন্ত জনপ্রিয়।
খাবারে ব্যবহার
তুলসীর বীজ বিভিন্ন খাবারেও যোগ করা যেতে পারে:
-
ফালুদা
-
কুলফি
-
পুডিং
-
দইয়ের সাথে মিশিয়ে স্বাস্থ্যকর নাস্তা
ত্বকের যত্নে ব্যবহার
ত্বকের বিভিন্ন সমস্যার জন্য তুলসীর বীজ নারকেল তেলের সাথে মিশিয়ে ব্যবহার করা যেতে পারে। এটি এগজিমা এবং সোরিয়াসিসের মতো ত্বকের রোগের উপশম ঘটাতে সাহায্য করে।
তুলসীর বীজের সম্ভাব্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
যেকোনো খাদ্য বা পরিপূরকের মতো, তুলসীর বীজেরও কিছু সম্ভাব্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে যা মনে রাখা জরুরি:
-
তুলসীর বীজের অতিরিক্ত সেবন বমি বমি ভাব, বমি, ডায়রিয়া, অ্যাসিড রিফ্লাক্স, ব্রণ, পেটে অস্বস্তি, এবং ক্ষুধা হ্রাস ঘটাতে পারে
-
কিছু ক্ষেত্রে রক্তে শর্করার মাত্রা অত্যধিক কমিয়ে দিতে পারে
-
প্রচুর পরিমাণে ফাইবার থাকায় কিছু লোকের গ্যাস্ট্রিক সমস্যা এবং ফোলাভাব দেখা দিতে পারে
-
এতে ভিটামিন কে আছে যা রক্ত জমাট বাঁধতে সাহায্য করে, তাই রক্ত পাতলা ওষুধের সাথে নেতিবাচকভাবে যোগাযোগ করতে পারে
-
পানিতে ভিজিয়ে রাখলে ফুলে উঠতে পারে, যা গিলতে অসুবিধা এবং দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণ হতে পারে, বিশেষত শিশুদের ক্ষেত্রে
কিভাবে আপনার ডায়েটে তুলসীর বীজ অন্তর্ভুক্ত করবেন
তুলসীর বীজ আপনার দৈনন্দিন খাদ্যাভ্যাসে অন্তর্ভুক্ত করার কয়েকটি সহজ উপায়:
-
সকালের নাস্তায় ভিজানো তুলসীর বীজ দই বা ফলের সাথে মিশিয়ে খেতে পারেন
-
গরমের দিনে ঠান্ডা পানীয়তে যোগ করে পান করুন
-
স্যালাডে ছিটিয়ে দিতে পারেন
-
স্মুদি বোলে যোগ করে পুষ্টিকর পানীয় তৈরি করুন
-
কিছু রেসিপিতে ফাইবার বাড়াতে ব্যবহার করতে পারেন
তুলসীর বীজ একটি অত্যন্ত পুষ্টিকর ও বহুমুখী খাদ্য উপাদান যা নানা স্বাস্থ্য সমস্যার সমাধানে সাহায্য করতে পারে। গরমে শরীর ঠান্ডা রাখা থেকে শুরু করে ওজন কমানো, কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করা, ত্বকের যত্ন নেওয়া, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা – সবেতেই এই ছোট কালো বীজের প্রভাব রয়েছে।
তবে সবকিছুর মতোই, পরিমিত পরিমাণে ব্যবহার করা উচিত। যদি আপনি কোনো ঔষধ নিয়মিত সেবন করেন বা কোনো চিকিৎসাধীন থাকেন, তাহলে তুলসীর বীজ নিয়মিত খাবারে অন্তর্ভুক্ত করার আগে একবার চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া ভালো।আমাদের প্রাচীন আয়ুর্বেদিক ঐতিহ্যে তুলসীর অবদান যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি আধুনিক জীবনে এর প্রয়োগও সমান প্রাসঙ্গিক। আজই আপনার দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় তুলসীর বীজ অন্তর্ভুক্ত করে দেখুন এর অসাধারণ উপকারিতা।