What religion was Sheikh Hasina’s mother: বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে যখন আমরা শেখ হাসিনার কথা বলি, তখন অবশ্যই তার মহান মায়ের কথাও মনে পড়ে যায়। শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব, যিনি বেগম মুজিব বা বঙ্গমাতা নামেও পরিচিত, ছিলেন একজন ধর্মপ্রাণ মুসলিম নারী। তুঙ্গিপাড়ার এই মহান নারীর জীবনকাহিনী শুধু একটি পরিবারের ইতিহাস নয়, বরং পুরো বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। ১৯৩০ সালের ৮ আগস্ট গোপালগঞ্জের তুঙ্গিপাড়ায় এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন এই মহীয়সী নারী।
প্রারম্ভিক জীবন এবং পারিবারিক পটভূমি
শেখ ফজিলাতুন্নেসার জন্ম হয়েছিল এমন এক সময়ে যখন বাংলার মুসলিম সমাজে নারীশিক্ষা এবং ধর্মীয় শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম ছিল। তার পিতা শেখ জহুরুল হক এবং মাতা হোসনে আরা বেগম উভয়েই ছিলেন গভীর ধর্মবিশ্বাসী মুসলিম। পরিবারটি ছিল তুঙ্গিপাড়ার অন্যতম সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবার, যাদের ইসলামী ঐতিহ্য এবং সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের গভীর শেকড় ছিল।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে, ফজিলাতুন্নেসার বয়স যখন মাত্র তিন বছর, তখন তার পিতা মৃত্যুবরণ করেন। আর পাঁচ বছর বয়সে তিনি তার মাতাকেও হারান। এই অল্প বয়সেই এতিম হয়ে যাওয়া ফজিলাতুন্নেসাকে লালন-পালন করেন শেখ মুজিবুর রহমানের মা শেখ সায়েরা খাতুন, যিনি তাকে নিজের সন্তানের মতোই ভালোবাসা এবং যত্ন দিয়ে বড় করেন।
ধর্মীয় শিক্ষা এবং সাংস্কৃতিক বিকাশ
ইসলামী ঐতিহ্যের সাথে গভীরভাবে সংযুক্ত এই পরিবারে ফজিলাতুন্নেসার ধর্মীয় শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছিল অত্যন্ত যত্নসহকারে। তিনি কুরআন ও হাদিসের শিক্ষা গ্রহণ করেন, যা তৎকালীন মুসলিম পরিবারের মেয়েদের জন্য অত্যাবশ্যক বিবেচিত হতো। একজন গৃহশিক্ষকের কাছে তিনি শুধু ধর্মীয় শিক্ষাই নয়, বাংলা, ইংরেজি এবং গণিতের মতো বিষয়েও শিক্ষা লাভ করেন।
স্থানীয় মিশনারি স্কুলে কিছুদিন আনুষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ করলেও, তৎকালীন সামাজিক রীতি অনুযায়ী তৃতীয় শ্রেণির পর তার আনুষ্ঠানিক শিক্ষা বন্ধ হয়ে যায়। তবে তার জ্ঞানপিপাসা এবং বইপড়ার প্রতি অনুরাগ ছিল অসীম, যা পরবর্তী জীবনে তার ব্যক্তিত্ব গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
বৈবাহিক জীবন এবং পারিবারিক দায়িত্ব
১৯৩৮ সালে মাত্র আট বছর বয়সে ফজিলাতুন্নেসার আকদ সম্পন্ন হয় ১৮ বছর বয়সী শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে, যা ছিল তৎকালীন মুসলিম সমাজের একটি স্বাভাবিক প্রথা। ১৯৪২ সালে তাদের আনুষ্ঠানিক বিবাহ সম্পন্ন হয়। একজন ধর্মপ্রাণ মুসলিম নারী হিসেবে তিনি তার স্বামী এবং পরিবারের প্রতি দায়িত্ব পালনে ছিলেন অত্যন্ত নিষ্ঠাবান।
শ্বশুরমা শেখ সায়েরা খাতুনের কাছ থেকে তিনি পারিবারিক ব্যবস্থাপনা, রান্নাবান্না, সেলাই এবং গৃহস্থালির সমস্ত কাজ শিখে নেন। ইসলামী শিক্ষা এবং মূল্যবোধের ভিত্তিতে তিনি তার সন্তানদের লালন-পালন করেন। তার পাঁচ সন্তান – শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, শেখ কামাল, শেখ জামাল এবং শেখ রাসেল – সবাই মায়ের কাছ থেকে ইসলামী সংস্কৃতি এবং নৈতিক শিক্ষা লাভ করেন।
রাজনৈতিক সংগ্রামে অংশীদারিত্ব
শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক জীবনে ফজিলাতুন্নেসা ছিলেন একজন নীরব কিন্তু দৃঢ় সহযোগী। একজন ধর্মপ্রাণ মুসলিম নারী হিসেবে তিনি স্বামীর রাজনৈতিক আদর্শকে সমর্থন করতেন এবং পারিবারিক জীবনে স্থিতিশীলতা বজায় রাখতেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে গৃহবন্দী ছিলেন ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত।
মুজিব পরিবারের সদস্যরা বারবার কারাভোগ করেছেন, এবং প্রতিটি ক্ষেত্রেই ফজিলাতুন্নেসা ছিলেন পরিবারের মূল শক্তি। তার ধৈর্য, সহনশীলতা এবং আল্লাহর প্রতি অগাধ বিশ্বাস পরিবারের সবাইকে কঠিন সময়ে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছে।
স্বাধীনতা পরবর্তী জীবন
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ফজিলাতুন্নেসা বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতির স্ত্রী হিসেবে দেশের উন্নয়নে নিজের অবদান রাখতে থাকেন। একজন মুসলিম নারী হিসেবে তিনি সমাজের অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়ানো এবং দানশীলতাকে তার জীবনের অংশ করে নিয়েছিলেন। ইসলামের শিক্ষা অনুযায়ী গরিব-দুঃখীদের সেবা করা এবং সমাজকল্যাণে কাজ করা তার নিয়মিত অভ্যাস ছিল।
ট্র্যাজিক সমাপ্তি এবং শাহাদত
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট, বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে কালো দিনে শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব তার স্বামী শেখ মুজিবুর রহমান এবং তিন পুত্র শেখ কামাল, শেখ জামাল ও শেখ রাসেলের সাথে নির্মমভাবে হত্যার শিকার হন। এই হত্যাকাণ্ডে কেবল শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা বেঁচে ছিলেন, কারণ তারা সে সময় পশ্চিম জার্মানিতে অবস্থান করছিলেন।
একজন ধর্মপ্রাণ মুসলিম নারী হিসেবে ফজিলাতুন্নেসার মৃত্যু ছিল একটি শাহাদত, কেননা তিনি তার পরিবার এবং দেশের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছিলেন। ইসলামী বিশ্বাস অনুযায়ী, যারা অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করে এবং ন্যায়ের পথে জীবন দেয়, তাদের শহীদের মর্যাদা দেওয়া হয়।
বঙ্গমাতার উত্তরাধিকার
শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং জীবনাদর্শ তার কন্যা শেখ হাসিনার মধ্যে স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। একজন মুসলিম নারী হিসেবে তার যে সহনশীলতা, ধৈর্য এবং দেশপ্রেম ছিল, তা শেখ হাসিনার রাজনৈতিক জীবনেও দেখা যায়। মায়ের ইসলামী শিক্ষা এবং নৈতিক মূল্যবোধ শেখ হাসিনাকে একজন দৃঢ়চেতা নেত্রী হিসেবে গড়ে তুলেছে।
আজও বাংলাদেশের মানুষ বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেসা মুজিবকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। তার ধর্মীয় বিশ্বাস, পারিবারিক মূল্যবোধ এবং দেশপ্রেম আজও বাংলাদেশের নারীদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস।
সমসাময়িক প্রভাব এবং স্মৃতিচারণ
বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের ইসলামী মূল্যবোধ এবং জীবনাদর্শের প্রভাব শুধু তার পরিবারেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং পুরো বাংলাদেশের সমাজে তার প্রভাব পড়েছে। একজন মুসলিম নারী হিসেবে তিনি যেভাবে ধর্মীয় শিক্ষা, পারিবারিক দায়িত্ব এবং সামাজিক অবদানের মধ্যে সমন্বয় রেখেছিলেন, তা আজকের দিনেও অনুকরণীয়।
তার জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে ইসলামী সংস্কৃতি এবং বাঙালি ঐতিহ্যের মিশ্রণ ঘটেছিল সুন্দরভাবে। একজন ধর্মপ্রাণ মুসলিম নারী হিসেবে তিনি প্রমাণ করেছিলেন যে ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং আধুনিক জীবনযাত্রার মধ্যে কোনো বিরোধ নেই।
শেখ হাসিনার মতো একজন বিশ্বনন্দিত নেত্রীর পেছনে যে মহান মায়ের অবদান রয়েছে, তার ধর্মীয় বিশ্বাস এবং জীবনদর্শন সে বিষয়ে জানা প্রতিটি বাংলাদেশীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ। একজন সাধারণ গ্রামীণ মুসলিম নারী থেকে বাংলাদেশের প্রথম ফার্স্ট লেডি হয়ে ওঠার যে অসাধারণ যাত্রা ফজিলাতুন্নেসার জীবনে ঘটেছিল, তা বাংলাদেশের প্রতিটি নারীর জন্য অনুপ্রেরণাদায়ক।
বাংলাদেশের ইতিহাসে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব চিরকাল একজন আদর্শ মুসলিম নারী, দেশপ্রেমিক মা এবং ত্যাগী জীবনসঙ্গী হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। তার ধর্মীয় বিশ্বাস, নৈতিক মূল্যবোধ এবং পারিবারিক দায়বদ্ধতার আদর্শ আগামী প্রজন্মের কাছে একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে রয়ে যাবে।