চীনের প্রাচীন কৌশলে গরমে বাড়ি ঠান্ডা রাখুন, বিদ্যুৎ বিল বাঁচান!

গ্রীষ্মের দাবদাহে যখন তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের উপরে উঠে যায়, তখন বাড়িতে ঠান্ডা থাকা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। এয়ার কন্ডিশনার চালালে বিদ্যুৎ বিল আকাশছোঁয়া হয়ে যায়। কিন্তু চিন্তার কিছু…

Ishita Ganguly

 

গ্রীষ্মের দাবদাহে যখন তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের উপরে উঠে যায়, তখন বাড়িতে ঠান্ডা থাকা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। এয়ার কন্ডিশনার চালালে বিদ্যুৎ বিল আকাশছোঁয়া হয়ে যায়। কিন্তু চিন্তার কিছু নেই। চীনের প্রাচীন সভ্যতা থেকে আমরা শিখতে পারি কীভাবে প্রাকৃতিক উপায়ে বাড়ি ঠান্ডা রাখা যায়। আসুন জেনে নেই সেই অভিনব কৌশলগুলি।

স্কাইওয়েল: প্রাকৃতিক এয়ার কন্ডিশনার

চীনের দক্ষিণ ও পূর্বাঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী বাড়িগুলিতে একটি অভিনব স্থাপত্য বৈশিষ্ট্য দেখা যায় – স্কাইওয়েল বা ‘তিয়ান জিং’। এটি হল বাড়ির মধ্যস্থলে একটি ছোট উন্মুক্ত উঠান, যা ছাদ পর্যন্ত খোলা থাকে। এই স্কাইওয়েল বাড়ির প্রাকৃতিক এয়ার কন্ডিশনার হিসেবে কাজ করে।স্কাইওয়েলের মাধ্যমে বাতাস প্রবাহিত হয়ে বাড়ির ভেতরের গরম বাতাস বের করে দেয় এবং ঠান্ডা বাতাস ভেতরে প্রবেশ করায়। এর ফলে বাড়ির তাপমাত্রা কমে যায়। এছাড়া স্কাইওয়েলে বৃষ্টির পানি জমা হয়ে বাষ্পীভবনের মাধ্যমে আরও ঠান্ডা পরিবেশ সৃষ্টি করে।

এসির ঠান্ডায় লুকিয়ে আছে মৃত্যুর ছোঁয়া! জানুন কীভাবে বাঁচবেন

বাঁশের চাটাই: প্রাকৃতিক কুলিং ম্যাট

গ্রীষ্মকালে চীনা লোকেরা বাঁশের চাটাই ব্যবহার করে শুয়ে থাকত। বাঁশের চাটাইয়ের মধ্য দিয়ে বাতাস চলাচল করতে পারে, ফলে শরীর ঠান্ডা থাকে। এছাড়া বাঁশের প্রাকৃতিক গুণের কারণে এটি তাপ শোষণ করে না, বরং তাপ প্রতিফলিত করে।আজও চীনের অনেক এলাকায় গ্রীষ্মকালে লোকেরা বাঁশের চাটাই ব্যবহার করে। এটি শুধু ঠান্ডা রাখে না, শরীরের জন্যও স্বাস্থ্যকর। বাঁশের চাটাই ব্যবহার করে আপনিও গরমে স্বস্তি পেতে পারেন।

পাখা: হাওয়া চালাচলের সহজ উপায়

চীনের হান রাজবংশের সময় থেকেই হাতপাখা ব্যবহৃত হত। পরবর্তীতে যান্ত্রিক পাখাও আবিষ্কৃত হয়েছিল। দ্বিতীয় শতাব্দীতে হান রাজবংশের এক কারিগর ডিং হুয়ান ৭টি চাকাওয়ালা একটি ঘূর্ণায়মান পাখা তৈরি করেন, যা মানুষের শক্তিতে চালানো যেত।৫০০ বছর পর তাং রাজবংশের সম্রাট জুয়ানজং তাঁর প্রাসাদে “কুল হল” নির্মাণ করেন। সেখানে জলের শক্তিতে চালিত ঘূর্ণায়মান পাখা ও ফোয়ারা ব্যবহার করে কৃত্রিম শীতলীকরণ ব্যবস্থা তৈরি করা হয়েছিল।আজও চীনের বিভিন্ন শহরে গ্রীষ্মকালে বয়স্ক মানুষদের হাতে পাখা নিয়ে বসে থাকতে দেখা যায়। এটি তাৎক্ষণিকভাবে শরীর ঠান্ডা রাখতে সাহায্য করে।

জালি: বাতাস চলাচলের জন্য ছিদ্রযুক্ত দেয়াল

চীনের প্রাচীন স্থাপত্যে জালি বা ছিদ্রযুক্ত দেয়াল ব্যবহৃত হত। এর মাধ্যমে বাতাস চলাচল করতে পারে কিন্তু সূর্যের তাপ ঢুকতে পারে না। ফলে ঘরের ভেতরে ঠান্ডা পরিবেশ বজায় থাকে।জালির বাইরের দিকে বড় ছিদ্র এবং ভেতরের দিকে ছোট ছিদ্র থাকে। এর ফলে বাতাস প্রবেশ করার সময় দ্রুত প্রবাহিত হয় এবং ঘরের তাপমাত্রা কমিয়ে দেয়। এই কৌশল থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে আধুনিক স্থাপত্যেও জালির ব্যবহার দেখা যায়।

বরফ সংরক্ষণ: গ্রীষ্মে ঠান্ডা পানীয়ের জন্য

চীনের ঝোউ রাজবংশের সময় থেকেই শীতকালে বরফ সংরক্ষণের রীতি চালু ছিল। নদী থেকে বরফ কেটে মাটির নীচে সংরক্ষণ করা হত। গ্রীষ্মকালে সেই বরফ ব্যবহার করে ঠান্ডা পানীয় তৈরি করা হত।তাং রাজবংশের সময় থেকে সাধারণ মানুষও বরফ সংরক্ষণ শুরু করে। শীতকালে বরফ কেটে মাটির নীচের ঘরে রেখে দেওয়া হত। পরের গ্রীষ্মে সেই বরফ বের করে নানা রকম ঠান্ডা পানীয় তৈরি করা হত।

আধুনিক যুগে প্রাচীন কৌশলের প্রয়োগ

চীনের এই প্রাচীন কৌশলগুলি থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে আধুনিক স্থাপত্যেও নানা উদ্ভাবনী পদ্ধতি ব্যবহৃত হচ্ছে। যেমন:

  • আবু ধাবির আল বাহার টাওয়ারে মাশরাবিয়া থেকে অনুপ্রাণিত গতিশীল ছায়া প্যানেল ব্যবহার করা হয়েছে। ২,০০০টি ষড়ভুজাকার উপাদান সূর্যের গতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে নড়ে এবং ভবনের ভেতরে ছায়া প্রদান করে।
  • ভারতের অ্যান্ট স্টুডিও জালি থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে বাষ্পীভবন শীতলীকরণ কৌশল ব্যবহার করে মাটির শঙ্কু তৈরি করেছে। এর মাধ্যমে পরিবেশবান্ধব উপায়ে তাপমাত্রা কমানো যায়।
  • চেংদু শহরের নিউ সেন্চুরি গ্লোবাল সেন্টারে স্কাইওয়েল থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে বিশাল আকারের অভ্যন্তরীণ উদ্যান তৈরি করা হয়েছে। এর মাধ্যমে প্রাকৃতিক আলো-বাতাস প্রবেশ করে এবং তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।

ঐতিহ্যকে সাথে নিয়ে বাংলার হাতপাখার বিবর্তন

উপসংহার

চীনের প্রাচীন কৌশলগুলি আমাদের শেখায় কীভাবে প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে বাস করা যায়। এই পদ্ধতিগুলি শুধু পরিবেশবান্ধব নয়, অর্থনৈতিকভাবেও লাভজনক। বর্তমান বিশ্বে যখন জলবায়ু পরিবর্তন একটি বড় সমস্যা, তখন এই প্রাচীন জ্ঞান আমাদের টেকসই ভবিষ্যৎ গড়তে সাহায্য করতে পারে।তাই আসুন, আমরা চীনের এই প্রাচীন কৌশলগুলি থেকে শিক্ষা নিই এবং আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োগ করি। এর মাধ্যমে আমরা শুধু গরমে স্বস্তি পাব না, পরিবেশকেও রক্ষা করতে পারব।

কৌশল বৈশিষ্ট্য উপকারিতা
স্কাইওয়েল বাড়ির মধ্যস্থলে উন্মুক্ত উঠান প্রাকৃতিক বায়ু চলাচল, তাপমাত্রা কমায়
বাঁশের চাটাই বাতাস চলাচলের উপযোগী শরীর ঠান্ডা রাখে, স্বাস্থ্যকর
পাখা হাতে বা যান্ত্রিকভাবে চালিত তাৎক্ষণিক শীতলতা প্রদান করে
জালি ছিদ্রযুক্ত দেয়াল বাতাস চলাচল করায়, সূর্যের তাপ আটকায়
বরফ সংরক্ষণ মাটির নীচে বরফ সংরক্ষণ গ্রীষ্মে ঠান্ডা পানীয় তৈরির জন্য
About Author
Ishita Ganguly

ঈশিতা গাঙ্গুলী ইন্দিরা গান্ধী ন্যাশনাল ওপেন ইউনিভার্সিটি (IGNOU) থেকে স্নাতক। তিনি একজন উদ্যমী লেখক এবং সাংবাদিক, যিনি সমাজের বিভিন্ন দিক নিয়ে গভীর বিশ্লেষণ ও অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে থাকেন। ঈশিতার লেখার ধরন স্পষ্ট, বস্তুনিষ্ঠ এবং তথ্যবহুল, যা পাঠকদের মুগ্ধ করে। তার নিবন্ধ ও প্রতিবেদনের মাধ্যমে তিনি সমাজের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকে সামনে আনেন এবং পাঠকদের চিন্তা-চেতনার পরিসরকে বিস্তৃত করতে সহায়তা করেন। সাংবাদিকতার জগতে তার অটুট আগ্রহ ও নিষ্ঠা তাকে একটি স্বতন্ত্র পরিচিতি দিয়েছে, যা তাকে ভবিষ্যতে আরও সাফল্যের দিকে নিয়ে যাবে।