অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স: আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের সামনে নীরব মহামারি

What is antimicrobial resistance: আপনি কি জানেন যে একটি সাধারণ ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণ যা আজ অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে সহজেই নিরাময় করা যায়, তা আগামী কিছু বছরের মধ্যে প্রাণঘাতী হয়ে উঠতে পারে? এই…

Debolina Roy

 

What is antimicrobial resistance: আপনি কি জানেন যে একটি সাধারণ ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণ যা আজ অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে সহজেই নিরাময় করা যায়, তা আগামী কিছু বছরের মধ্যে প্রাণঘাতী হয়ে উঠতে পারে? এই ঘটনাকে বলা হয় অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স (এএমআর) বা অণুজীব-বিরোধী প্রতিরোধ্যতা। বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর প্রায় ৫০ লাখ মানুষ এর কারণে মারা যাচ্ছে, যা এইচআইভি-এইডস এবং ম্যালেরিয়াজনিত মোট মৃত্যুর চেয়েও বেশি। বিশেষজ্ঞরা এটিকে “নীরব মহামারি” হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন, কারণ এটি ধীরে ধীরে কিন্তু নিশ্চিতভাবে বিশ্বব্যাপী জনস্বাস্থ্যের জন্য এক বিশাল হুমকি হয়ে উঠছে।

অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স কী?

অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স বা অণুজীব-বিরোধী প্রতিরোধ্যতা হচ্ছে অণুজীবদের (ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, ছত্রাক এবং পরজীবী) এমন এক ক্ষমতা অর্জন করা যার ফলে তারা তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করা ওষুধের প্রভাবকে প্রতিরোধ করতে পারে। সহজ ভাষায় বলতে গেলে, রোগ সৃষ্টিকারী অণুজীবরা এমন একটি ক্ষমতা বিকশিত করে যার ফলে তারা অ্যান্টিবায়োটিক বা অন্যান্য অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল ওষুধের প্রভাবে মারা যায় না।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক তৌফিক আহমেদের মতে, এভাবে মানুষের শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা ক্রমে হ্রাস পাচ্ছে। অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স এর ফলে যে ওষুধগুলো আগে রোগীদের সারিয়ে তুলত, এখন সেগুলো আর কার্যকর নয়। বাধ্য হয়ে চিকিৎসকরা অত্যন্ত উচ্চ মাত্রার অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করছেন।

কিভাবে ঘটে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স?

অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স প্রকৃতিগতভাবেও ঘটতে পারে। সময়ের সাথে সাথে অণুজীবরা জেনেটিক পরিবর্তনের মাধ্যমে নিজেদের অভিযোজিত করে। কিন্তু মানব কার্যকলাপের কারণে এই প্রক্রিয়া অনেক দ্রুত ঘটছে। প্রধানত:

  1. অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার: যদি কারও শরীরে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণজনিত রোগ হয় এবং সেই রোগ নিরাময়ে কেউ চিকিৎসকের পরামর্শমত সঠিক পরিমাণে এবং পর্যাপ্ত সময় ধরে অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ না করেন, তাহলে ব্যাকটেরিয়াগুলো পুরোপুরি ধ্বংস না হয়ে উল্টো আরও শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে।
  2. হরিজন্টাল জিন ট্রান্সফার: রেসিস্ট্যান্সের জিন এক অণুজীব থেকে অন্য অণুজীবে স্থানান্তরিত হতে পারে। এটি একটি অ-রোগজনক অণুজীব থেকে একটি রোগজনক অণুজীবে যেতে পারে, যা সমস্যাকে আরও জটিল করে তোলে।
  3. পশুপাখি এবং কৃষিতে অ্যান্টিবায়োটিকের অতিরিক্ত ব্যবহার: উন্নয়নশীল দেশগুলিতে অ্যান্টিবায়োটিকগুলি প্রায়ই প্রেসক্রিপশন ছাড়াই দোকানে কিনতে পাওয়া যায়, যা সমস্যাটিকে আরও বাড়িয়ে তোলে।
  4. দুর্বল স্বাস্থ্যবিধি ও সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ: পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভাব এবং সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের দুর্বল ব্যবস্থা অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্সের বিস্তারকে ত্বরান্বিত করে।

অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্সের বিশ্বব্যাপী প্রভাব

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) অনুসারে, অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ জনস্বাস্থ্য হুমকি। বিশ্বব্যাপী এর প্রভাব বিস্তারিতভাবে দেখা যাক:

ক্রমবর্ধমান মৃত্যুহার: বর্তমানে প্রতি বছর প্রায় ১.২৭ মিলিয়ন মানুষ সরাসরি এবং প্রায় ৪.৯৫ মিলিয়ন মানুষ পরোক্ষভাবে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্সের কারণে মারা যায়। গবেষকদের অনুমান, ২০৫০ সালের মধ্যে এর ফলে বার্ষিক মৃত্যুসংখ্যা ১ কোটিতে পৌঁছাতে পারে, যা বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর প্রধান কারণ ক্যানসারকেও ছাড়িয়ে যাবে।

অর্থনৈতিক প্রভাব: অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্সের কারণে স্বাস্থ্যসেবা ব্যয় বাড়ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শুধুমাত্র ছয়টি অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল-প্রতিরোধী জীবাণু সংক্রমণের চিকিৎসার জন্য বার্ষিক ৪.৬ বিলিয়ন ডলারের বেশি খরচ হয়। ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী এর আর্থিক ক্ষতি ১০০ ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে।

জটিল চিকিৎসা: অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্সের কারণে সংক্রমণের চিকিৎসা আরও জটিল হয়ে উঠেছে, যার ফলে রোগীদের হাসপাতালে থাকার সময় দীর্ঘায়িত হয় এবং মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়ে।

খাদ্য নিরাপত্তায় হুমকি: পশুপাখি ও কৃষিতে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের কারণে খাদ্য উৎপাদন কমে যেতে পারে এবং খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়তে পারে।

কোভিড-১৯ মহামারীর প্রভাব

কোভিড-১৯ মহামারী অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্সের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করেছে। রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র (সিডিসি) জানিয়েছে যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ২০১৯ সালে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী সংক্রমণে মৃত্যুর হার ১৮% কমেছিল, যা হাসপাতালগুলিতে প্রায় ৩০% কমেছিল। কিন্তু কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে ২০২০ সালে এই অগ্রগতি হারিয়ে যেতে শুরু করে। মহামারীর সময় আরও বেশি প্রতিরোধী সংক্রমণ, অ্যান্টিবায়োটিকের বেশি ব্যবহার এবং কম ডেটা সংগ্রহ ও প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল।

সুপারবাগের উত্থান

প্রতিরোধী অনুজীবদের মধ্যে সবচেয়ে উদ্বেগজনক হল “সুপারবাগ” – এমন অণুজীব যা একাধিক অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধী। এদের মধ্যে ক্যান্ডিডা অরিস (সি. অরিস) একটি বিশেষভাবে উদ্বেগজনক ছত্রাক, যা প্রায়শই অ্যান্টিফাঙ্গাল ওষুধের বিরুদ্ধে প্রতিরোধী এবং স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলিতে দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে। সিডিসি’র রিপোর্ট অনুযায়ী, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ক্যান্ডিডা অরিসের ক্লিনিকাল কেসের সংখ্যা ২০১৯ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে প্রায় পাঁচগুণ বেড়েছে।

অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স মোকাবেলার উপায়

অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স এমন একটি সমস্যা যা একাই সমাধান করা যাবে না। এটি মোকাবেলা করতে বিশ্বব্যাপী সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন:

সচেতনতা বৃদ্ধি: অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার সম্পর্কে জনসাধারণকে শিক্ষিত করা এবং অ্যান্টিবায়োটিকের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। সাধারণ সর্দি-কাশি বা ভাইরাল সংক্রমণের জন্য অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার না করা।

অ্যান্টিবায়োটিক স্টুয়ার্ডশিপ: অ্যান্টিবায়োটিক স্টুয়ার্ডশিপ বলতে অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যকারিতা সংরক্ষণের জন্য দায়বদ্ধ ব্যবহার বোঝায়। স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের এই জীবনরক্ষাকারী ওষুধের অব্যাহত কার্যকারিতা নিশ্চিত করতে সাবধানে এবং সঠিক ইঙ্গিত দিয়ে অ্যান্টিবায়োটিক প্রেসক্রাইব করা উচিত।

সংক্রমণ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ: স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র, খামার এবং সমাজে সংক্রমণ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার উন্নতি করা। এর মধ্যে হাত ধোয়া, বিচ্ছিন্নতা এবং জীবাণুমুক্তকরণ অভ্যাসের উন্নতি অন্তর্ভুক্ত।

নতুন অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল ওষুধ বিকাশ: নতুন অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল ওষুধ বিকাশের জন্য গবেষণায় বিনিয়োগ বাড়ানো প্রয়োজন। সর্বশেষ ৩০ বছরে কেবল ২টি নতুন শ্রেণির অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কৃত হয়েছে।

নিয়ন্ত্রণমূলক নীতি: পশুপাখি ও কৃষিতে অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার রোধে নিয়ন্ত্রণমূলক নীতি প্রয়োগ করতে হবে।

বাংলাদেশে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স

বাংলাদেশে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স একটি গুরুতর উদ্বেগের বিষয়। দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে সাধারণ রোগ নিয়ে চিকিৎসা নেয়া অনেক মানুষের মধ্যে অ্যান্টিবায়োটিক রেসিস্ট্যান্স দেখা দিয়েছে। এর ফলে রোগীর আগে যে অ্যান্টিবায়োটিকে রোগ সারতো, এখন আর সেটি কাজ করছে না। ফলে অত্যন্ত উচ্চ মাত্রার অ্যান্টিবায়োটিক দিতে হচ্ছে।

বাংলাদেশে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্সের প্রধান কারণগুলি হল:

  1. প্রেসক্রিপশন ছাড়াই অ্যান্টিবায়োটিক কেনা এবং ব্যবহার করা।
  2. চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই অসম্পূর্ণ কোর্স অ্যান্টিবায়োটিক নেওয়া।
  3. স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলিতে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের দুর্বল ব্যবস্থা।
  4. পশুপালন খাতে অ্যান্টিবায়োটিকের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার।

অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স বর্তমান বিশ্বের একটি নীরব মহামারি, যা ক্রমশ মানবজাতির জন্য বিশাল হুমকি হয়ে উঠছে। এটি শুধু একটি চিকিৎসা সমস্যা নয়, বরং একটি সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং নীতিগত চ্যালেঞ্জ। যদি আমরা এখনই সঠিক পদক্ষেপ না নিই, তবে অ্যান্টিবায়োটিক যুগের সমাপ্তি হতে পারে, যার ফলে আমরা আবার সেই সময়ে ফিরে যেতে পারি যখন সাধারণ সংক্রমণও প্রাণঘাতী হতে পারে।

অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স মোকাবেলায় প্রত্যেকের ভূমিকা রয়েছে। সাধারণ মানুষ হিসেবে আমরা কেবল চিকিৎসকের পরামর্শে অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ করতে পারি, নির্ধারিত সময় অনুযায়ী সম্পূর্ণ কোর্স শেষ করতে পারি এবং সংক্রমণ প্রতিরোধে ভাল স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করতে পারি। স্বাস্থ্য নীতি নির্ধারকদের অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স সম্পর্কে আরও গবেষণা এবং নতুন অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল ওষুধ বিকাশে বিনিয়োগ করতে হবে।

শেষ পর্যন্ত, অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্সের বিরুদ্ধে লড়াই একটি বিশ্বব্যাপী লড়াই, যা কেবল সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমেই জয় করা সম্ভব। এখন সময় এসেছে যে আমরা সবাই এই নীরব মহামারির বিরুদ্ধে সোচ্চার হই এবং আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য কার্যকর অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল ওষুধ সংরক্ষণ করি।

About Author
Debolina Roy

দেবলীনা রায় একজন চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্য বিষয়ক লেখক, যিনি স্বাস্থ্য সচেতনতা এবং চিকিৎসা বিজ্ঞান সম্পর্কে পাঠকদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য নিবেদিত। ডাক্তারি নিয়ে পড়াশোনা করা দেবলীনা তার লেখায় চিকিৎসা বিষয়ক জটিল তথ্যগুলি সহজ ভাষায় উপস্থাপন করেন, যা সাধারণ পাঠকদের জন্য সহজবোধ্য এবং উপকারী। স্বাস্থ্য, পুষ্টি, এবং রোগ প্রতিরোধের বিষয়ে তার গভীর জ্ঞান এবং প্রাঞ্জল লেখনী পাঠকদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। দেবলীনা রায়ের লক্ষ্য হল সঠিক ও তথ্যনির্ভর স্বাস্থ্যবিধি প্রচার করা এবং মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত করা।