বাংলাদেশের স্কুল পাঠ্যক্রমে ব্যাপক পরিবর্তন আসছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জাতীয় পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডকে (এনসিটিবি) নির্দেশনা দিয়েছে যে, আগামী শিক্ষাবর্ষের জন্য পাঠ্যবইগুলোতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে আরবি ভাষা শিক্ষার অন্তর্ভুক্তি, বঙ্গভবনের ছবি অপসারণ এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উল্লেখ কমানো।
এনসিটিবির সূত্র জানিয়েছে, চতুর্থ থেকে নবম শ্রেণির পাঠ্যবইগুলোতে এই পরিবর্তনগুলো আনা হচ্ছে। প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণির পাঠ্যবইগুলো অপরিবর্তিত থাকবে। নতুন পাঠ্যক্রমে আরবি ভাষা শিক্ষাকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। চতুর্থ শ্রেণি থেকে আরবি ভাষা শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে।
পাশাপাশি, পাঠ্যবইগুলো থেকে বঙ্গভবনের ছবি সরিয়ে ফেলা হচ্ছে। এর পরিবর্তে জাতীয় সংসদ ভবন, লালবাগ কেল্লা, আহসান মঞ্জিল প্রভৃতি ঐতিহাসিক স্থাপত্যের ছবি ব্যবহার করা হবে। এছাড়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উল্লেখ ও ছবি কমানো হচ্ছে। তবে তাঁর জীবনী ও অবদান সম্পর্কে মৌলিক তথ্য থাকবে।
এনসিটিবির একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, “আমরা নির্দেশনা পেয়েছি যে, পাঠ্যবইগুলোতে কোনো একক ব্যক্তির অতিরিক্ত মহিমায়ন যেন না থাকে। বরং দেশের স্বাধীনতা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে সকল নেতৃবৃন্দের অবদানকে সমানভাবে তুলে ধরতে হবে।”
পাঠ্যক্রম পরিবর্তনের এই সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে শিক্ষাবিদ ও অভিভাবকদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। অনেকে মনে করছেন, আরবি ভাষা শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করা ভালো উদ্যোগ। তবে কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন, এতে শিক্ষার্থীদের উপর অতিরিক্ত চাপ পড়বে কিনা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, “আরবি ভাষা শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করা ভালো উদ্যোগ। এতে শিক্ষার্থীরা একটি গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক ভাষা শিখতে পারবে। তবে এটি যেন অন্যান্য বিষয়ের শিক্ষার ক্ষেত্রে বাধা না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।”
অন্যদিকে, বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির সভাপতি জিয়াউল হক বলেন, “পাঠ্যক্রম পরিবর্তনের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। হঠাৎ করে বড় ধরনের পরিবর্তন আনলে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের সমস্যায় পড়তে হতে পারে।”
তবে অভিভাবকদের মধ্যে এ নিয়ে দ্বিমত রয়েছে। ঢাকার একজন অভিভাবক মোঃ আব্দুল্লাহ বলেন, “আরবি ভাষা শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা ভালো সিদ্ধান্ত। এতে আমাদের সন্তানেরা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভাষা শিখতে পারবে।” অন্যদিকে, অপর একজন অভিভাবক সুমনা আক্তার মনে করেন, “শিক্ষার্থীদের উপর অতিরিক্ত চাপ পড়বে। বরং ইংরেজি ভাষা শিক্ষার উপর আরও জোর দেওয়া উচিত।”
এনসিটিবি সূত্রে জানা গেছে, পাঠ্যবই পরিবর্তনের কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে। ডিসেম্বরের মধ্যে সব কাজ শেষ করে জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে নতুন বই ছাপানোর লক্ষ্য রয়েছে। এনসিটিবির চেয়ারম্যান প্রফেসর এ কে এম রেজাউল হাসান বলেন, “আমরা চেষ্টা করছি যাতে শিক্ষার্থীরা যথাসময়ে নতুন বই পায়। তবে এত অল্প সময়ে বড় পরিবর্তন আনা চ্যালেঞ্জিং হবে।”
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, পাঠ্যক্রম পরিবর্তনের এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে দেশের বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনা করে। একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, “আমরা চাই শিক্ষার্থীরা দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে সঠিক ধারণা পাক। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে প্রতিযোগিতা করতে পারে এমন দক্ষতাও অর্জন করুক।”
তবে এই পরিবর্তন নিয়ে রাজনৈতিক মহলেও প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। বিরোধী দলগুলো অভিযোগ করেছে, সরকার ইতিহাস বিকৃত করছে। অন্যদিকে সরকার দাবি করেছে, তারা কেবল ভারসাম্যপূর্ণ শিক্ষা নিশ্চিত করতে চায়।
মস্তিষ্কের মহাকাব্য: আপনার সন্তানের প্রতিভা বিকাশের ১০টি অমোঘ কৌশল
শিক্ষাবিদরা মনে করছেন, পাঠ্যক্রম পরিবর্তনের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। তাঁরা পরামর্শ দিয়েছেন, এ ব্যাপারে সকল পক্ষের মতামত নেওয়া এবং বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ গ্রহণ করা জরুরি।
বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবু সাঈদ ভূঁইয়া বলেন, “পাঠ্যক্রম পরিবর্তন একটি জটিল প্রক্রিয়া। এটি করতে হলে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা প্রয়োজন। হঠাৎ করে বড় পরিবর্তন আনলে তা শিক্ষার মান ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।”
শিক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, তারা এই বিষয়ে সকলের মতামত গ্রহণ করছে। একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে যারা পাঠ্যক্রম পরিবর্তনের প্রস্তাবগুলো খতিয়ে দেখবে। কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
এদিকে, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) পরিচালক (পাঠ্যপুস্তক) ফারুক আহমেদ জানিয়েছেন, “আমরা চেষ্টা করছি যাতে নতুন পাঠ্যবইগুলো সময়মতো ছাপিয়ে শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছে দিতে পারি। এজন্য দিন-রাত কাজ চলছে।”
তিনি আরও জানান, “নতুন পাঠ্যবইগুলোতে দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রতিফলন থাকবে। পাশাপাশি আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিষয়গুলোও যথাযথভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হবে।”
এই পরিবর্তনের ফলে শিক্ষার্থীদের উপর কী প্রভাব পড়বে, সে বিষয়ে শিক্ষাবিদরা বিভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। অনেকে মনে করছেন, আরবি ভাষা শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করায় শিক্ষার্থীরা একটি গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক ভাষা শিখতে পারবে। অন্যদিকে কেউ কেউ উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন যে, এতে শিক্ষার্থীদের উপর অতিরিক্ত চাপ পড়তে পারে।