ভারতে রক্তচাপের সমস্যা একটি প্রধান জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে উদ্ভূত হয়েছে। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে এর প্রভাব উদ্বেগজনক। এই প্রতিবেদনে আমরা হাই প্রেসার ও লো প্রেসারের লক্ষণ, কারণ এবং প্রতিরোধের উপায় নিয়ে আলোচনা করব।
রক্তচাপ হল রক্তনালীর ভিতরে রক্তের চাপ। স্বাভাবিক রক্তচাপ 120/80 mmHg এর নিচে। 140/90 mmHg বা তার বেশি হলে তা উচ্চ রক্তচাপ হিসেবে বিবেচিত হয়। অন্যদিকে, 90/60 mmHg এর নিচে হলে তা নিম্ন রক্তচাপ হিসেবে গণ্য করা হয়।
ভারতে উচ্চ রক্তচাপের প্রাদুর্ভাব উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিকাল রিসার্চ (ICMR) এর একটি সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, ভারতে প্রায় 30% প্রাপ্তবয়স্ক উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন। এই হার শহরাঞ্চলে 33.8% এবং গ্রামাঞ্চলে 27.6%।
হাই প্রেসারের লক্ষণ:
- মাথাব্যথা: প্রায়শই সকালে ঘাড়ের পিছনে বা কপালে তীব্র ব্যথা অনুভূত হয়।
- বুকে ব্যথা: হৃদস্পন্দন বৃদ্ধি পায় এবং বুকে চাপ অনুভব হতে পারে।
- শ্বাসকষ্ট: সামান্য পরিশ্রমেই শ্বাসকষ্ট হতে পারে।
- চক্করভাব: হঠাৎ করে মাথা ঘোরা বা অস্থিরতা অনুভব হতে পারে।
- দৃষ্টি সমস্যা: চোখে ঝাপসা দেখা বা দৃষ্টিশক্তি কমে যাওয়া।
লো প্রেসারের লক্ষণ:
- দুর্বলতা ও ক্লান্তি: সারাদিন ধরে অস্বাভাবিক ক্লান্তি অনুভব করা।
- মাথা ঘোরা: হঠাৎ করে উঠে দাঁড়ালে মাথা ঘোরা।
- বমি বমি ভাব: মাঝে মাঝে বমি বমি ভাব বা বমি হওয়া।
- ত্বকের শুষ্কতা: ত্বক শুষ্ক ও ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া।
- মনোযোগের অভাব: কাজে মনোযোগ দিতে অসুবিধা হওয়া।
পশ্চিমবঙ্গে রক্তচাপের পরিস্থিতি:
পশ্চিমবঙ্গে রক্তচাপের সমস্যা বিশেষভাবে উদ্বেগজনক। রাজ্য স্বাস্থ্য দপ্তরের 2023 সালের একটি সমীক্ষা অনুযায়ী, রাজ্যের 35.5% প্রাপ্তবয়স্ক উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন। এই হার শহরাঞ্চলে 38.2% এবং গ্রামাঞ্চলে 33.7%।
বয়স অনুযায়ী বিশ্লেষণে দেখা যায়:
- 30-44 বছর: 22.4%
- 45-59 বছর: 38.6%
- 60+ বছর: 54.3%
লিঙ্গ অনুযায়ী:
- পুরুষ: 37.2%
- মহিলা: 33.8%
উল্লেখযোগ্যভাবে, পশ্চিমবঙ্গে উচ্চ রক্তচাপজনিত মৃত্যুর ঝুঁকি জাতীয় গড়ের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ।
ঝুঁকি কারণসমূহ:
- খাদ্যাভ্যাস: অত্যধিক লবণ ও চর্বিযুক্ত খাবার গ্রহণ উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বাড়ায়। ভারতীয় চিকিৎসা গবেষণা পরিষদের (ICMR) একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ভারতীয়রা প্রতিদিন গড়ে 11 গ্রাম লবণ গ্রহণ করে, যা WHO-এর সুপারিশকৃত 5 গ্রামের দ্বিগুণেরও বেশি।
- জীবনযাত্রার ধরন: অনিয়মিত জীবনযাপন, ব্যায়ামের অভাব, ধূমপান ও মদ্যপান রক্তচাপ বাড়াতে পারে। ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে-5 (2019-21) অনুযায়ী, ভারতে 15-49 বছর বয়সী পুরুষদের 38% ধূমপান করে।
- পারিবারিক ইতিহাস: জেনেটিক কারণেও উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি থাকে। ইন্ডিয়ান হার্ট অ্যাসোসিয়েশনের মতে, যাদের পরিবারে উচ্চ রক্তচাপের ইতিহাস আছে, তাদের এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা 2-3 গুণ বেশি।
- মানসিক চাপ: দীর্ঘমেয়াদী মানসিক চাপ রক্তচাপ বাড়াতে পারে। ন্যাশনাল মেন্টাল হেলথ সার্ভে (2015-16) অনুযায়ী, ভারতে প্রায় 14% প্রাপ্তবয়স্ক মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছেন।
প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের উপায়:
- নিয়মিত ব্যায়াম: প্রতিদিন অন্তত 30 মিনিট মাঝারি তীব্রতার ব্যায়াম করা উচিত। ভারতীয় মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের মতে, নিয়মিত ব্যায়াম রক্তচাপ 5-8 mmHg কমাতে পারে।
- স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস: DASH (Dietary Approaches to Stop Hypertension) ডায়েট অনুসরণ করা যেতে পারে। এতে প্রচুর পরিমাণে ফল, সবজি, হোলগ্রেইন এবং কম ফ্যাটযুক্ত দুগ্ধজাত খাবার অন্তর্ভুক্ত। ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিকাল রিসার্চের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, DASH ডায়েট অনুসরণ করলে রক্তচাপ 8-14 mmHg পর্যন্ত কমতে পারে।
- ধূমপান ত্যাগ: ধূমপান ত্যাগ করলে রক্তচাপ কমে এবং হৃদরোগের ঝুঁকি কমে। ভারত সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ধূমপান ত্যাগ করার পর প্রথম বছরেই হৃদরোগের ঝুঁকি 50% কমে যায়।
- নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা: বছরে অন্তত একবার সম্পূর্ণ স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা উচিত। ইন্ডিয়ান হার্ট অ্যাসোসিয়েশনের সুপারিশ অনুযায়ী, 18 বছর বয়স থেকে প্রতি দুই বছর অন্তর রক্তচাপ পরীক্ষা করা উচিত।
রক্তচাপের সমস্যা প্রতিরোধযোগ্য এবং নিয়ন্ত্রণযোগ্য। জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগের মাধ্যমে এই সমস্যা মোকাবেলা করা সম্ভব। নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা, সুষম খাদ্যাভ্যাস ও নিয়মিত ব্যায়ামের মাধ্যমে আমরা একটি সুস্থ জীবনযাপন করতে পারি।
