বাংলাদেশে সেনা-সরকার সংঘাত: শেখ হাসিনার প্রত্যাবর্তনের জল্পনা

বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে নতুন জল্পনা শুরু হয়েছে। নিকট অতীতে শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ সহযোগী রাব্বি আলম দাবি করেছেন যে, হাসিনা আবারও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ফিরে আসবেন। এই দাবি এমন সময়ে…

Srijita Chattopadhay

 

বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে নতুন জল্পনা শুরু হয়েছে। নিকট অতীতে শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ সহযোগী রাব্বি আলম দাবি করেছেন যে, হাসিনা আবারও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ফিরে আসবেন। এই দাবি এমন সময়ে এসেছে যখন দেশে সেনাবাহিনীর কার্যকলাপ নিয়ে নানা গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে এবং জরুরি অবস্থা জারির সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি রাব্বি আলম সম্প্রতি বলেছেন, “ডঃ ইউনুস, আপনি বাংলাদেশে থাকার যোগ্য নন। বাংলাদেশের জনগণের প্রতি এটাই বার্তা যে, শেখ হাসিনা ফিরে আসছেন, তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ফিরে আসছেন।” তিনি ভারত সরকার এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে শেখ হাসিনাকে নিরাপদ যাত্রাপথ প্রদানের জন্য ধন্যবাদ জানিয়েছেন।

গত বছর অগাস্টে ছাত্র আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা ছাড়তে হয়েছিল। চাকরির কোটা নিয়ে শুরু হওয়া আন্দোলন পরে হাসিনা-বিরোধী আন্দোলনে রূপ নেয়। দীর্ঘ সংঘর্ষে ৩০০ জনেরও বেশি মানুষ মারা যান এবং সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপে তিনি পদত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নেন।

বর্তমানে ডঃ মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তী সরকার দেশ পরিচালনা করছে। এই সরকার ২০২৫ সালের শেষের দিকে বা ২০২৬ সালের শুরুতে নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু সম্প্রতি দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা বেড়েছে।

বিশেষ করে সেনাবাহিনীর সক্রিয়তা নিয়ে বিভিন্ন গুঞ্জন উঠেছে। ঢাকায় সেনাবাহিনীর ৯ম ডিভিশনের সৈন্যদের ক্রমশ প্রবেশের খবর পাওয়া গেছে। সূত্র অনুযায়ী, সেনাবাহিনী বিশেষ করে ঢাকায় নিয়ন্ত্রণ জোরদার করতে চায়।

তবে এই জল্পনা-কল্পনাকে সোমবার খারিজ করে দিয়েছেন বাংলাদেশের সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে “অফিসার্স অ্যাড্রেস” অনুষ্ঠানে তিনি সেনাবাহিনীর আনুগত্য, পেশাদারিত্ব ও সহনশীলতার প্রশংসা করেন এবং গুজবে কান না দেওয়ার আহ্বান জানান।

জেনারেল ওয়াকার বলেন, “দেশ ও জনগণই সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার।” তিনি সৈন্যদের উস্কানিতে পা না দেওয়ার নির্দেশ দেন এবং বলেন, “দেশের স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে আমাদের দায়িত্ব পালনে মনোযোগী থাকতে হবে। আপনাদের সৈনিকদেরও একই কাজ করতে নির্দেশ দিন। বুদ্ধিমত্তার সাথে কাজ করুন। জাতি আমাদের কাছ থেকে অনেক কিছু আশা করে, এবং সেই প্রত্যাশা পূরণ করাই আমাদের পবিত্র দায়িত্ব।”

ইতিমধ্যে, অন্তর্বর্তী সরকারের কিছু পদক্ষেপ নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। সরকার জামাতে ইসলামী সহ ইসলামপন্থী দলগুলির উপর থেকে ২০১৩ সালের নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছে এবং ইসলামপন্থী নেতাদের মুক্তি দিয়েছে। এছাড়া, দুর্নীতি ও ভারত-বিরোধী বিদ্রোহী গোষ্ঠীদের সাহায্য করার অভিযোগে কারাবন্দী একজন প্রাক্তন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীকেও মুক্তি দেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশের অর্থনীতি হাসিনার শাসনামলের ফলাফল নিয়েও আলোচনা হচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকারের কমিশন করা একটি শ্বেতপত্রে উন্মোচিত হয়েছে যে, হাসিনার শাসনামলে (২০০৯-২০২৩) ব্যাপক দুর্নীতি, নিয়ন্ত্রক ব্যর্থতা এবং ২৪০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অবৈধ আর্থিক পাচার হয়েছে।

হাসিনার ভারতে উপস্থিতি দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক টানাপোড়ন বাড়িয়েছে। বাংলাদেশ ছাত্র আন্দোলনের সময় দমনপীড়নের বিচারের জন্য তাকে ফেরত চেয়েছে, কিন্তু ভারত এ বিষয়ে নীরব আছে। ফেব্রুয়ারি মাসে হাসিনার একটি বক্তব্য বাংলাদেশে ব্যাপক প্রতিবাদের সৃষ্টি করে, যার প্রতিক্রিয়ায় ভারত বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত হাই কমিশনারকে তলব করে পরিষ্কার করে যে, হাসিনার মন্তব্য তার ব্যক্তিগত সক্ষমতায় করা হয়েছিল এবং তা ভারতের সরকারি অবস্থান প্রতিফলিত করে না।

বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর আক্রমণ বৃদ্ধি পেয়েছে, যাদের হাসিনার মিত্র হিসেবে দেখা হয়। ভারত-বিরোধী মনোভাব এবং ভুল তথ্য প্রচারের ফলে এই পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে। জনসংখ্যার আট শতাংশ হিন্দু হাসিনার শাসনামলে সম্পূর্ণ নিরাপদ না থাকলেও, তার দলের ধর্মনিরপেক্ষ অবস্থান তাদের কিছুটা সুরক্ষা দিয়েছিল।

অর্থনৈতিক দিক থেকে, বাংলাদেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের কিছু লক্ষণ দেখা যাচ্ছে, বিশেষ করে পোশাক শিল্পে। ২০২৪ সালের জুন থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত রপ্তানি ২০২৩ সালের একই সময়ের তুলনায় ১৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। মুদ্রাস্ফীতি এখনও উচ্চ থাকলেও কমতে শুরু করেছে, নভেম্বর ২০২৪-এর ১১.৩৮ শতাংশ থেকে জানুয়ারি ২০২৫-এ ৯.৯৪ শতাংশে নেমে এসেছে।

এই পরিস্থিতিতে হাসিনার প্রত্যাবর্তনের দাবি কতটা বাস্তবসম্মত, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ইতিহাস দেখায় যে, বাংলাদেশে সেনাবাহিনী ঐতিহ্যগতভাবে রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করেছে, যদিও সম্প্রতি তারা আওয়ামী লীগের দৃঢ় সমর্থক ছিল। তবে বর্তমান সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান স্পষ্টভাবে বলেছেন যে সেনাবাহিনী “সবসময় জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছে”।

নির্বাচনের সময়সূচী নিয়েও মতপার্থক্য রয়েছে। বিএনপি এবং ছাত্র নেতারা ২০২৫ সালের ডিসেম্বরে নির্বাচন চাইছেন, আর তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম নিশ্চিত করেছেন যে নির্ধারিত সময়ে ডিসেম্বরে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

বাংলাদেশে এখন রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা চলছে। সেনাবাহিনী, অন্তর্বর্তী সরকার এবং ছাত্র আন্দোলনকারীদের মধ্যে উত্তেজনা বাড়ছে। হাসিনার প্রত্যাবর্তনের দাবি এই জটিল পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। আগামী দিনগুলিতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেয়, তা নিয়ে বিশ্ব রাজনীতিতে নজর রাখা হচ্ছে।

About Author
Srijita Chattopadhay

সৃজিতা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতক। তিনি একজন প্রতিশ্রুতিশীল লেখক এবং সাংবাদিক, যিনি তার লেখা দ্বারা বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির সমৃদ্ধি তুলে ধরতে সদা উদ্যমী। সৃজিতার লেখার ধারা মূলত সাহিত্য, সমাজ এবং সংস্কৃতির বিভিন্ন দিককে ঘিরে আবর্তিত হয়, যেখানে তিনি তার গভীর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা ও বিশ্লেষণী দক্ষতার পরিচয় দেন। তাঁর নিবন্ধ ও প্রতিবেদনগুলি পাঠকদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে, যা তার বস্তুনিষ্ঠতা ও সংবেদনশীলতার পরিচয় বহন করে। সৃজিতা তার কর্মজীবনে ক্রমাগত নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে বদ্ধপরিকর, যা তাকে বাংলা সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।