বেটাকরোনাভাইরাস নামটি শুনলেই এখন অনেকের মনে ভয় জাগে। এই ভাইরাসটি শ্বাসতন্ত্রের মাধ্যমে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে এবং দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, এটি একটি গুরুতর সংক্রামক রোগের কারণ হতে পারে, যার উপসর্গ সময়মতো না চিনলে পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠতে পারে। জ্বর, কাশি, শ্বাসকষ্টের মতো সাধারণ লক্ষণ থেকে শুরু করে নিউমোনিয়ার মতো গুরুতর সমস্যা পর্যন্ত এর প্রভাব দেখা যায়। তাই এই ভাইরাস সম্পর্কে সঠিক ধারণা থাকা এবং উপসর্গ চেনা অত্যন্ত জরুরি।
এই ভাইরাসের গল্প শুরু হয়েছিল ২০১৯ সালের শেষ দিকে, চীনের উহান শহরে। প্রথমে এটি একটি অজানা রোগ হিসেবে আবির্ভূত হয়, যার উৎস ছিল স্থানীয় একটি সামুদ্রিক খাদ্য বাজার। বিজ্ঞানীরা পরে জানতে পারেন, এটি বেটাকরোনাভাইরাস পরিবারের একটি নতুন ধরন, যার নাম দেওয়া হয় SARS-CoV-2। এই ভাইরাসের কারণে সৃষ্ট রোগটির নাম কোভিড-১৯। খুব অল্প সময়ের মধ্যে এটি চীনের গণ্ডি পেরিয়ে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। ২০২০ সালের মার্চে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এটিকে মহামারী হিসেবে ঘোষণা করে। বাংলাদেশেও ২০২০ সালের ৮ মার্চ প্রথম কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হয়। তারপর থেকে এই ভাইরাসের বিভিন্ন ধরন বা ভ্যারিয়েন্ট, যেমন ডেল্টা এবং ওমিক্রন, বিশ্বজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়েছে।
বেটাকরোনাভাইরাসের উপসর্গগুলো সাধারণত সংক্রমণের ২ থেকে ১৪ দিনের মধ্যে প্রকাশ পায়। সবচেয়ে সাধারণ লক্ষণগুলো হলো জ্বর, শুকনো কাশি এবং ক্লান্তি। অনেকের ক্ষেত্রে গন্ধ বা স্বাদ গ্রহণের ক্ষমতা হারিয়ে যাওয়াও দেখা যায়। কিছু রোগীর শ্বাসকষ্ট, গলা ব্যথা, মাথাব্যথা বা শরীর ব্যথার মতো সমস্যাও হয়। তবে সবচেয়ে বিপজ্জনক দিক হলো, এটি ফুসফুসে সংক্রমণ ঘটিয়ে নিউমোনিয়ার কারণ হতে পারে। বয়স্ক মানুষ বা যাদের ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগের মতো পূর্বের রোগ আছে, তাদের জন্য এটি বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, প্রায় ৮০% মানুষের ক্ষেত্রে উপসর্গ মৃদু থাকে, কিন্তু বাকি ২০%-এর মধ্যে গুরুতর সমস্যা দেখা দিতে পারে।
এই ভাইরাস সম্পর্কে আরও গভীরভাবে জানতে গেলে বোঝা যায়, এটি শুধু শারীরিক সমস্যাই নয়, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষতিও ডেকে এনেছে। মহামারীর সময় লকডাউন, ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা এবং ব্যবসা বন্ধের কারণে কোটি কোটি মানুষের জীবনযাত্রা বদলে গেছে। বাংলাদেশে লকডাউনের সময় স্কুল-কলেজ বন্ধ, দোকানপাটে তালা এবং হাসপাতালে রোগীর চাপ বেড়ে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কোভিড-১৯-এর কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতি ২০২০ সালে বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছে। তবে ভ্যাকসিন আবিষ্কারের পর পরিস্থিতি অনেকটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশে ভ্যাকসিন প্রদান শুরু হয়, যা এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে।
সহজ কথায় বলতে গেলে, বেটাকরোনাভাইরাস থেকে বাঁচতে হলে সতর্কতা জরুরি। হাত ধোয়া, মাস্ক পরা এবং সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা এখনও সবচেয়ে কার্যকর উপায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, সাবান-পানি দিয়ে ৪০ সেকেন্ড হাত ধোয়া বা অ্যালকোহলযুক্ত স্যানিটাইজার ব্যবহার করলে ভাইরাস নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। এছাড়া ভিড় এড়িয়ে চলা এবং অসুস্থ বোধ হলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। বাংলাদেশে সরকারও জনগণকে সচেতন করতে বিভিন্ন প্রচারণা চালিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, “করোনা থেকে বাঁচতে হলে মাস্ক পরতেই হবে” স্লোগানটি ব্যাপকভাবে প্রচার করা হয়েছে।
বিষয়টির গুরুত্ব আরও বাড়ে যখন আমরা দেখি, এই ভাইরাসের নতুন ধরন এখনও আবির্ভূত হচ্ছে। ওমিক্রনের মতো ভ্যারিয়েন্ট দ্রুত ছড়ায়, যদিও এটি তুলনামূলকভাবে কম মারাত্মক। বিজ্ঞানীরা বলছেন, ভাইরাসের বিবর্তন ঠেকানো কঠিন, তাই প্রতিরোধই প্রধান অস্ত্র। বাংলাদেশে ২০২৫ সালের মার্চ পর্যন্ত ভ্যাকসিনের ডোজ দেওয়া হয়েছে প্রায় ১৫ কোটিরও বেশি, যা জনসংখ্যার বড় অংশকে সুরক্ষা দিয়েছে। তবে উপসর্গ দেখা দিলে দেরি না করে পরীক্ষা করানো এবং চিকিৎসা নেওয়া এখনও অত্যন্ত জরুরি।
শেষ কথা হলো, বেটাকরোনাভাইরাস আমাদের জীবনে বড় পরিবর্তন এনেছে। এটি শুধু একটি রোগ নয়, একটি শিক্ষাও বটে। নিজেকে ও পরিবারকে সুরক্ষিত রাখতে সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ নেওয়াই এখন মূল কাজ। তাই উপসর্গ চিনে, সতর্ক থেকে এবং প্রয়োজনে চিকিৎসকের কাছে যেতে দ্বিধা করবেন না। এই ভাইরাসের সঙ্গে লড়াইয়ে আমরা জিতবই, যদি একসঙ্গে সচেতনভাবে এগিয়ে যাই।