Ashok Sashti vrat katha: বাসন্তীর আগমনে সজ্জিত হয়ে ওঠে প্রকৃতি, ফুল ফোটে অশোক গাছে আর সেই সময়ে আসে অশোক ষষ্ঠী – সন্তানের মঙ্গলকামনায় পালিত এক বিশেষ ব্রত। ২০২৫ সালে অশোক ষষ্ঠী পালিত হবে ৩ এপ্রিল, বৃহস্পতিবার (২০ চৈত্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ)। এই ব্রত মূলত বাংলার গ্রামীণ হিন্দু সমাজে বিশেষভাবে জনপ্রিয় এবং সন্তানের দীর্ঘায়ু ও মঙ্গলের জন্য পালিত হয়। আসুন জেনে নেওয়া যাক এই ব্রতের সময়সূচি, ইতিহাস, পূজাবিধি এবং তাৎপর্য সম্পর্কে।
অশোক ষষ্ঠী ২০২৫: তিথি ও সময়সূচি
২০২৫ সালে অশোক ষষ্ঠী ব্রতের ষষ্ঠী তিথি শুরু হবে ২ এপ্রিল, ২০২৫ (১৯ চৈত্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ) বুধবার রাত ১১:৫০ মিনিটে এবং শেষ হবে ৩ এপ্রিল, ২০২৫ বৃহস্পতিবার রাত ৯:৪১ মিনিটে। যদিও তিথি ২ এপ্রিল রাত থেকে শুরু হচ্ছে, তবে ব্রত পালন করা হবে ৩ এপ্রিল বৃহস্পতিবার। এই দিনটি চৈত্রমাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী তিথিতে পড়ে, যা বাসন্তী নবরাত্রির সময়কালে অনুষ্ঠিত হয়।
পূজার উত্তম সময়: সকাল থেকে শুরু করে দুপুরের মধ্যে পূজা সম্পন্ন করা শুভ। বিশেষ করে সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টার মধ্যে পূজা করা উত্তম
অশোক ষষ্ঠী কী এবং কেন পালন করা হয়?
অশোক ষষ্ঠী হল চৈত্রমাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী তিথিতে পালিত একটি বিশেষ ব্রত যা মূলত সন্তানের মঙ্গলকামনায় করা হয়। এই ব্রতে ষষ্ঠী দেবীর পূজা করা হয়, যিনি হিন্দু ধর্মে সন্তানের রক্ষাকর্তা হিসেবে পরিচিত। বিশ্বাস করা হয় যে এই ব্রত পালন করলে সন্তান সুস্থ থাকে, দীর্ঘায়ু লাভ করে এবং দম্পতির মধ্যে সম্পর্ক সুদৃঢ় হয়।
ষষ্ঠী দেবী বা ছঠী মাইয়া (যাকে দেবী প্রকৃতির ষষ্ঠ রূপ এবং সূর্যদেবের বোন হিসেবেও বলা হয়) সন্তানের মঙ্গলের দেবী। প্রাচীন হিন্দু শাস্ত্রে ষষ্ঠী দেবীর উল্লেখ ৮ম-৯ম শতাব্দীতেও পাওয়া যায়, যেখানে তাকে সন্তান এবং হিন্দু যুদ্ধদেবতা স্কন্দের সাথে সম্পর্কিত করা হয়েছে।
অশোক ষষ্ঠীর ঐতিহাসিক কাহিনী
অশোক ষষ্ঠীর উৎপত্তি সম্পর্কে একটি আকর্ষণীয় লোককথা প্রচলিত আছে। এক ঋষি তার আশ্রমের অশোক গাছের নীচে একটি কন্যা শিশুকে ক্রন্দনরত অবস্থায় পান। তিনি সেই শিশুকে আশ্রয় দেন এবং অশোক গাছের নীচে পাওয়ার কারণে তার নাম রাখেন ‘অশোকা’।
অন্য একটি কাহিনী অনুযায়ী, অশোকা নামের মেয়েটি বড় হয়ে একজন রাজপুত্রের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন এবং আট পুত্র ও এক কন্যার জননী হন। একদিন অশোকা যখন অশোক ষষ্ঠী ব্রত পালন করছিলেন, তখন অজান্তে তার ব্রতের খাবারে একটি চালের দানা পড়ে যায়। এর ফলে সকল পরিবার সদস্যদের মৃত্যু হয়। অশোকা কাঁদতে কাঁদতে ঋষির আশ্রমে যান এবং ঋষি তাকে জানান যে, অজান্তে ব্রতের নিয়ম ভঙ্গ করায় ষষ্ঠী দেবী রুষ্ট হয়েছেন। ঋষি তাকে পবিত্র জল দেন যা ছিটিয়ে তার পরিবারের সদস্যরা পুনর্জীবিত হন। এই ঘটনার পর থেকে সবাই ষষ্ঠী দেবীর পূজা শুরু করে।
অশোক ষষ্ঠী পূজার উপকরণ ও বিধি
পূজার উপকরণ:
- অশোক গাছের পাতা, ফুল এবং ফল
- একটি মাটির কলস (ঘট)
- নতুন কাপড় (লাল বর্ণের)
- মিষ্টি, ফল এবং প্রসাদ
- ছয়টি মুগ দানা, ছয়টি অশোক ফুল এবং দই
- ষষ্ঠী দেবীর প্রতিমা বা প্রতীক
পূজার বিধি:
- উপবাস: সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত উপবাস পালন করুন। কেউ কেউ নিরামিষ খাবার খেয়ে ব্রত পালন করেন।
- স্নান ও শুদ্ধি: সকালে সূর্যোদয়ের আগে স্নান করুন এবং পবিত্র হোন।
- পূজাস্থল প্রস্তুতি: ঘরের পবিত্র স্থানে একটি মাটির কলস স্থাপন করুন এবং তার ওপর অশোক পাতা রাখুন।
- ষষ্ঠী দেবীর আবাহন: মন্ত্র উচ্চারণ করে ষষ্ঠী দেবীকে আবাহন করুন।
- অশোক গাছের পূজা: অশোক গাছের পাতা, ফুল এবং অশোক গাছের ফল দিয়ে পূজা করুন।
- প্রসাদ নিবেদন: ছয়টি মুগ দানা, ছয়টি অশোক ফুল এবং দই দিয়ে প্রসাদ তৈরি করে নিবেদন করুন।
- ব্রতকথা পাঠ: ব্রতকথা পাঠ করুন বা শুনুন।
- অশোক গাছের পাতা খাওয়া: উত্তর ভারতে মহিলারা অশোক গাছের ছয়টি ফুলকুঁড়ি থেকে জল পান করেন সন্তানের মঙ্গলের জন্য।
অশোক গাছের গুরুত্ব ও তাৎপর্য
অশোক গাছ হিন্দু ধর্মে অত্যন্ত পবিত্র ও তাৎপর্যপূর্ণ একটি বৃক্ষ। এই গাছের নাম ‘অশোক’ শব্দের অর্থ ‘শোকহীন’ বা ‘যা হৃদয় থেকে দুঃখ দূর করে। অশোক গাছ আয়ুর্বেদে বিভিন্ন রোগের চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত হয়।
হিন্দু পুরাণে অশোক গাছের সাথে সীতা দেবীর একটি বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে। রামায়ণ অনুসারে, রাবণের বন্দী হিসেবে লঙ্কায় অবস্থানকালে সীতা দেবী অশোক বাটিকায় থাকতেন। অশোক গাছ ভালোবাসা এবং পবিত্রতার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়।
অশোক গাছ সৌন্দর্য, আশা এবং শান্তির প্রতীক হিসেবেও পরিচিত। এটি হিন্দু ও বৌদ্ধ মন্দিরে লাগানো হয় শান্তি ও সমৃদ্ধির প্রতীক হিসেবে।
অশোক ষষ্ঠী ব্রতের উপকারিতা
অশোক ষষ্ঠী ব্রত পালনের বিভিন্ন উপকারিতা রয়েছে বলে বিশ্বাস করা হয়:
- সন্তানের দীর্ঘায়ু: এই ব্রত পালন করলে সন্তানের দীর্ঘায়ু ও মঙ্গল হয়।
- দাম্পত্য সম্পর্ক: স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্ক সুদৃঢ় হয় এবং বিচ্ছেদ হয় না।
- সন্তান প্রাপ্তি: নিঃসন্তান দম্পতিদের সন্তান লাভের আশীর্বাদ পাওয়া যায়।
- রোগ নিরাময়: অশোক গাছের ঔষধি গুণাবলী বিভিন্ন রোগ নিরাময়ে সাহায্য করে।
- মানসিক শান্তি: ‘অশোক’ নামের অর্থ অনুযায়ী, এই ব্রত পালন করলে মন থেকে দুঃখ দূর হয় এবং মানসিক শান্তি লাভ হয়।
প্রদোষ ব্রত: পালনের নিয়ম, সময়সূচী এবং তাৎপর্য
বিভিন্ন অঞ্চলে অশোক ষষ্ঠীর পালন পদ্ধতি
ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে অশোক ষষ্ঠী বিভিন্ন নামে ও পদ্ধতিতে পালিত হয়:
পশ্চিমবঙ্গ: বাংলায় এটি অশোক ষষ্ঠী নামে পরিচিত এবং সন্তানের মঙ্গলকামনায় মহিলারা ব্রত পালন করেন।
উত্তর ভারত: উত্তর ভারতে অশোক ষষ্ঠীতে মহিলারা অশোক গাছের ছয়টি ফুলকুঁড়ি থেকে জল পান করেন সন্তানের মঙ্গলের জন্য। পৌষ মাসে খাস ষষ্ঠী ব্রত পালন করা হয় সন্তানের দীর্ঘায়ুর জন্য।
বিহার: বিহারে ষষ্ঠী তিথি “ছঠি” বা “ছাতি” নামে পরিচিত এবং ষষ্ঠী দেবীকে “ছাতি মাতা” নামে সম্বোধন করা হয়।
গয়া: গয়ায় একই দিনে স্কন্দ ষষ্ঠী পালিত হয়।
অশোক ষষ্ঠী ব্রত বাংলার গ্রামীণ সমাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় অনুষ্ঠান যা প্রাচীনকাল থেকে চলে আসছে। ২০২৫ সালে ৩ এপ্রিল এই পবিত্র ব্রত পালন করে মা ষষ্ঠীর আশীর্বাদ লাভ করতে পারেন। সন্তানের কল্যাণ ও দীর্ঘায়ুর জন্য এই ব্রত পালন করুন, পাশাপাশি অশোক গাছের সংরক্ষণেও সচেতন হোন, যা আমাদের প্রাকৃতিক এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
অশোক ষষ্ঠী শুধু একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, এটি প্রকৃতির সাথে মানুষের গভীর সম্পর্কের প্রতীকও বটে। ধর্ম এবং পরিবেশের সমন্বয়ে এই ব্রত আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, প্রকৃতির সংরক্ষণ ও সন্তানের মঙ্গলকামনা একসাথে চলতে পারে। আসুন, আমরা সবাই ঐতিহ্য বজায় রেখে এবং প্রকৃতির প্রতি শ্রদ্ধা রেখে অশোক ষষ্ঠী পালন করি।