এশিয়া কাপ ২০২৫: নতুন মোড়কে পুরনো লড়াই, ভারত-পাকিস্তান মহারণে কে এগিয়ে?

২২ গজের যুদ্ধে আবারও সেই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারত ও পাকিস্তান। এশিয়া কাপ ২০২৫ (Asia Cup 2025)-এর মঞ্চে আজ দুবাই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে মুখোমুখি হচ্ছে এই দুই ক্রিকেট পরাশক্তি। পরিসংখ্যানের খাতা ভারতের…

Ani Roy

 

২২ গজের যুদ্ধে আবারও সেই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারত ও পাকিস্তান। এশিয়া কাপ ২০২৫ (Asia Cup 2025)-এর মঞ্চে আজ দুবাই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে মুখোমুখি হচ্ছে এই দুই ক্রিকেট পরাশক্তি। পরিসংখ্যানের খাতা ভারতের পক্ষে কথা বললেও, দুই শিবিরেই নতুন অধিনায়ক ও একঝাঁক তরুণ তুর্কিদের উপস্থিতি এই ম্যাচকে এক ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে। একদিকে সূর্যকুমার যাদবের আগ্রাসী ভারত, অন্যদিকে সালমান আঘার নেতৃত্বে থাকা পাকিস্তান—কারা হাসবে শেষ হাসি, সেই অপেক্ষাতেই ক্রিকেট বিশ্ব।

এশিয়া কাপের ইতিহাসে ভারত ও পাকিস্তানের লড়াই মানেই টানটান উত্তেজনা আর শেষ মুহূর্তের নাটকীয়তা। যদিও সামগ্রিক পরিসংখ্যান এবং সাম্প্রতিক পারফরম্যান্সের নিরিখে ‘মেন ইন ব্লু’ বেশ কিছুটা এগিয়ে, তবে টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটের অনিশ্চয়তা এবং পাকিস্তানের ঘুরে দাঁড়ানোর ইতিহাসকে উপেক্ষা করার কোনো সুযোগ নেই। এই হাই-ভোল্টেজ ম্যাচের আগে দুই দলের শক্তি-দুর্বলতা, সাম্প্রতিক ফর্ম এবং ঐতিহাসিক পরিসংখ্যান নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে সর্বত্র।

এক নজরে মহারণ

  • মুখোমুখি লড়াইয়ে এগিয়ে ভারত: এশিয়া কাপে দুই দল এখনও পর্যন্ত ১৮ বার মুখোমুখি হয়েছে। ভারত জিতেছে ১০টি ম্যাচে, আর পাকিস্তান জিতেছে ৬টি ম্যাচে। দুটি ম্যাচের কোনো ফলাফল আসেনি। (সূত্র: হিন্দুস্তান টাইমস)
  • T20 ফরম্যাটেও ভারতের দাপট: এশিয়া কাপের টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে দুই দল তিনবার মুখোমুখি হয়েছে, যেখানে ভারত ২-১ ব্যবধানে এগিয়ে। (সূত্র: দি ইকোনমিক টাইমস)
  • নতুন অধিনায়ক, নতুন দল: এই এশিয়া কাপে দুই দলেই নতুন নেতৃত্ব। ভারতের অধিনায়ক সূর্যকুমার যাদব এবং পাকিস্তানের অধিনায়ক সালমান আলি আঘা। রোহিত শর্মা, বিরাট কোহলি, বাবর আজম, মহম্মদ রিজওয়ানের মতো সিনিয়রদের অনুপস্থিতি দুই দলের চেহারাতেই এনেছে তারুণ্যের ছোঁয়া।
  • উড়ন্ত সূচনা দুই দলেরই: টুর্নামেন্টে ভারত নিজেদের প্রথম ম্যাচে সংযুক্ত আরব আমিরশাহিকে ৯ উইকেটে উড়িয়ে দিয়েছে। অন্যদিকে, পাকিস্তানও ওমানকে ৯৩ রানের বড় ব্যবধানে হারিয়েছে।

প্রেক্ষাপট: তারুণ্য বনাম ঐতিহ্য

২০২৪ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পর ভারতীয় দলে এক নতুন যুগের সূচনা হয়েছে। রোহিত শর্মার অবসরের পর টি-টোয়েন্টি দলের নেতৃত্বের ভার এখন সূর্যকুমার যাদবের কাঁধে। তাঁর নেতৃত্বে ভারত এখনও পর্যন্ত ২২টি ম্যাচের মধ্যে ১৭টিতেই জয়লাভ করেছে। এশিয়া কাপের মতো বহু-দেশীয় টুর্নামেন্টে এটাই তাঁর প্রথম বড় পরীক্ষা। অন্যদিকে, পাকিস্তান দলেও ব্যাপক রদবদল ঘটেছে। বাবর আজম ও মহম্মদ রিজওয়ানের মতো অভিজ্ঞদের বাইরে রেখে তরুণদের নিয়ে দল সাজিয়েছে পিসিবি। সালমান আঘার নেতৃত্বে এই দলটি কতটা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে পারে, তার প্রমাণ মিলবে আজকের ম্যাচে।

ঐতিহাসিকভাবে, ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ মানেই স্নায়ুর চাপ। তবে দুই দলের নতুন অধিনায়কই মাঠের বাইরের আলোচনাকে গুরুত্ব না দিয়ে আগ্রাসী ক্রিকেট খেলার বার্তা দিয়েছেন। সূর্যকুমার যাদব ম্যাচের আগে সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, “মাঠে নামলে আগ্রাসন তো থাকবেই। আগ্রাসন ছাড়া ক্রিকেট খেলা যায় না। আমি এই ম্যাচটি নিয়ে অত্যন্ত উত্তেজিত।” (সূত্র: টাইমস অফ ইন্ডিয়া)। একই সুর শোনা গেছে পাক অধিনায়ক সালমান আঘার গলাতেও। ওমানের বিরুদ্ধে জয়ের পর তিনি বলেন, “আমরা গত কয়েক মাস ধরে ভালো ক্রিকেট খেলছি। নিজেদের পরিকল্পনা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে পারলে আমরা যেকোনো দলকেই হারানোর ক্ষমতা রাখি।” (সূত্র: হিন্দুস্তান টাইমস)

পরিসংখ্যানের আয়নায় ভারত-পাকিস্তান

ঐতিহাসিক পরিসংখ্যান বিচার করলে, বড় টুর্নামেন্টে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের পাল্লাই ভারী।

১. এশিয়া কাপে সার্বিক ফলাফল (ওডিআই এবং টি-টোয়েন্টি):

দল ম্যাচ জয় পরাজয় ফলাফল হয়নি
ভারত ১৮ ১০
পাকিস্তান ১৮ ১০

২. শেষ পাঁচ বছরের টি-টোয়েন্টি লড়াই (সেপ্টেম্বর ২০২০ – সেপ্টেম্বর ২০২৫):

দুই দল এই সময়ে টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে ৫ বার মুখোমুখি হয়েছে, যেখানে ভারত ৩-২ ব্যবধানে সামান্য এগিয়ে আছে। শেষবার ২০২২ সালের এশিয়া কাপে সুপার ফোরের ম্যাচে পাকিস্তান ৫ উইকেটে জিতেছিল, যা ভারতের বিরুদ্ধে তাদের সর্বশেষ জয়। (সূত্র: দি ইকোনমিক টাইমস)

৩. ২০২৩ এশিয়া কাপের স্মৃতি:

শেষবার যখন দুই দল এশিয়া কাপের একদিনের ফরম্যাটে মুখোমুখি হয়েছিল (২০২৩), ভারত পাকিস্তানকে ২২৮ রানের বিশাল ব্যবধানে বিধ্বস্ত করেছিল। সেই ম্যাচে বিরাট কোহলি এবং কেএল রাহুলের শতরান ভারতের জয়ের ভিত গড়ে দিয়েছিল। যদিও সেই দলের অনেক সদস্যই বর্তমান টি-টোয়েন্টি দলে নেই। (সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন)

সাম্প্রতিক ফর্ম ও খেলোয়াড়দের ভূমিকা

উভয় দলই টুর্নামেন্টে দাপুটে জয় দিয়ে শুরু করেছে। ভারতের হয়ে সংযুক্ত আরব আমিরশাহির বিরুদ্ধে কুলদীপ যাদব (৪/৭) এবং শিবম দুবে (৩/৪) বল হাতে আগুন ঝরিয়েছেন। জবাবে ব্যাট করতে নেমে অভিষেক শর্মা (১৬ বলে ৩০) এবং শুভমান গিল (৯ বলে ২০ অপরাজিত) মাত্র ৪.৩ ওভারেই খেলা শেষ করে দেন। (সূত্র: ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২৫)

অন্যদিকে, পাকিস্তানও ওমানের বিরুদ্ধে প্রথমে ব্যাট করে মহম্মদ হারিসের (৪৩ বলে ৬৬) দুরন্ত ইনিংসে ভর করে ১৬০ রান তোলে। জবাবে ওমান মাত্র ৬৭ রানে অলআউট হয়ে যায়। পাকিস্তানের হয়ে সাইম আইয়ুব, ফাহিম আশরাফ এবং সুফিয়ান মুকিম দুটি করে উইকেট নেন। (সূত্র: টাইমস অফ ইন্ডিয়া, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৫)

নজরে থাকবেন যারা:

  • সূর্যকুমার যাদব (ভারত): অধিনায়কত্বের পাশাপাশি তাঁর ৩৬০-ডিগ্রি ব্যাটিং ভারতের প্রধান শক্তি।
  • জসপ্রীত বুমরাহ (ভারত): চোট সারিয়ে ফিরে আসার পর বুমরাহর ইয়র্কার এবং ডেথ ওভার বোলিং ভারতের বড় ভরসা।
  • মহম্মদ হারিস (পাকিস্তান): উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যান হারিস প্রথম ম্যাচেই নিজের আগ্রাসী ব্যাটিংয়ের পরিচয় দিয়েছেন।
  • শাহিন শাহ আফ্রিদি (পাকিস্তান): বাঁ-হাতি এই পেসার নতুন বলে ভারতের টপ-অর্ডারকে সমস্যায় ফেলার ক্ষমতা রাখেন।

বিশেষজ্ঞের মতামত

প্রাক্তন পাকিস্তানি অধিনায়ক রশিদ লতিফ মনে করেন, ভারতের বিরুদ্ধে ম্যাচে পাকিস্তান অতিরিক্ত আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে, যা তাদের হারের অন্যতম কারণ। তাঁর মতে, “আমরা ভারতের বিরুদ্ধে খেলার সময় আবেগতাড়িত হয়ে পড়ি এবং সবকিছু একবারে করে ফেলতে চাই। কিন্তু ভারতীয় দল পরিস্থিতি অনুযায়ী খেলে এবং সে কারণেই তারা সফল হয়।” (সূত্র: টাইমস অফ ইন্ডিয়া)

অন্যদিকে, ভারতীয় শিবিরে কোচ গৌতম গম্ভীরের বার্তা পরিষ্কার—বাইরের আলোচনা থেকে দূরে থেকে নিজেদের পেশাদারিত্ব বজায় রাখা। সাম্প্রতিক রাজনৈতিক উত্তেজনার আবহে ম্যাচ বয়কটের দাবি উঠলেও, বিসিসিআই সচিব দেবজিত সাইকিয়া জানিয়েছেন, এটি একটি বহুজাতিক টুর্নামেন্ট হওয়ায় ভারতের পক্ষে সরে আসা সম্ভব নয়। (সূত্র: মিন্ট)

ম্যাচের ভবিষ্যৎ এবং উপসংহার

কাগজে-কলমে এবং সাম্প্রতিক পারফরম্যান্সের নিরিখে সূর্যকুমার যাদবের নেতৃত্বাধীন ভারতীয় দল কিছুটা হলেও এগিয়ে থেকে এই ম্যাচ শুরু করবে। দলের ব্যাটিং গভীরতা এবং বোলিং বৈচিত্র্য তাদের শক্তিশালী প্রতিপক্ষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে। তবে পাকিস্তান বরাবরই ‘আনপ্রেডিক্টেবল’ দল হিসেবে পরিচিত। তাদের তরুণ ক্রিকেটাররা যদি স্নায়ুর চাপ সামলে নিজেদের সেরাটা দিতে পারেন, তবে দুবাইয়ের মাঠে এক রুদ্ধশ্বাস লড়াইয়ের সাক্ষী থাকতে চলেছে ক্রিকেট বিশ্ব।

পরিসংখ্যান হয়তো ভারতের পক্ষে, কিন্তু টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে একটি ওভারই ম্যাচের রং বদলে দিতে পারে। তাই ভবিষ্যদ্বাণী করা কঠিন। তবে একটা বিষয় নিশ্চিত, এশিয়া কাপের মঞ্চে ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ মানেই শুধুমাত্র একটি ক্রিকেট ম্যাচ নয়, তার চেয়েও অনেক বেশি কিছু।

About Author
Ani Roy

অনি বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এডুকেশনে স্নাতক ডিগ্রি সম্পন্ন করেছেন। শিক্ষার প্রতি গভীর অনুরাগ এবং আজীবন শেখার প্রতি প্রতিশ্রুতি নিয়ে অনি নতুন শিক্ষামূলক পদ্ধতি ও প্র্যাকটিসগুলি অন্বেষণ করতে নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। তার একাডেমিক যাত্রা তাকে শিক্ষার তত্ত্ব এবং ব্যবহারিক শিক্ষণ কৌশলগুলিতে দৃঢ় ভিত্তি প্রদান করেছে। অনি অন্তর্দৃষ্টি এবং দক্ষতা তার চিন্তাশীল লেখাগুলিতে প্রতিফলিত হয়, যা শিক্ষাবিদ এবং শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত ও তথ্যপূর্ণ করার উদ্দেশ্যে লেখা। তিনি তার আকর্ষণীয় এবং প্রভাবশালী কাজের মাধ্যমে শিক্ষা ক্ষেত্রে অবদান রাখতে থাকেন।