Asia power index 2024 India Russia Japan: অস্ট্রেলিয়ার লোয়ি ইনস্টিটিউট প্রকাশিত এশিয়া পাওয়ার ইনডেক্স ২০২৪-এ ভারত এশিয়ার তৃতীয় শক্তিধর দেশ হিসেবে স্থান পেয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের পরেই রয়েছে ভারতের অবস্থান। এই সূচকে রাশিয়া ও জাপানকে পিছনে ফেলে ভারত এই অবস্থানে উঠে এসেছে।
লোয়ি ইনস্টিটিউটের এই বার্ষিক সূচক এশিয়ার ২৭টি দেশ ও অঞ্চলের সামরিক ক্ষমতা, কূটনৈতিক প্রভাব, অর্থনৈতিক সক্ষমতা, সাংস্কৃতিক প্রভাব, স্থিতিস্থাপকতা এবং ভবিষ্যৎ সম্পদের মতো ৮টি মানদণ্ডের ভিত্তিতে দেশগুলোর আপেক্ষিক ক্ষমতা মূল্যায়ন করে। এই সূচকে পাকিস্তান থেকে শুরু করে রাশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলের দেশগুলো অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
২০২৪ সালের এশিয়া পাওয়ার ইনডেক্সে ভারতের সামগ্রিক স্কোর বেড়েছে ৪.২ পয়েন্ট। বিশেষ করে অর্থনৈতিক সক্ষমতা, কূটনৈতিক প্রভাব এবং সামরিক ক্ষমতার ক্ষেত্রে ভারতের অবস্থান শক্তিশালী হয়েছে। করোনা মহামারি পরবর্তী সময়ে ভারতের দ্রুত অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বৈশ্বিক নেতৃত্ব ও কৌশলগত উচ্চাকাঙ্ক্ষা এই অগ্রগতির পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি রেকর্ড উচ্চতায়: জনগণের জীবনযাত্রা কঠিন হচ্ছে
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “ভারতের শক্তি এশিয়ায় বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভারত জাপানকে পিছনে ফেলে প্রথমবারের মতো এশিয়ায় সামগ্রিক শক্তির দিক থেকে তৃতীয় স্থান অর্জন করেছে।” তবে প্রতিবেদনে এও উল্লেখ করা হয়েছে যে ভারত এখনও তার সম্পূর্ণ সম্ভাবনা অর্জন করতে পারেনি। ভারতের প্রভাব তার সম্পদের তুলনায় এখনও অনেক কম, যা ইঙ্গিত করে যে একটি বড় শক্তি হিসেবে আরও বৃদ্ধির জন্য প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে।
ভারতের জনসংখ্যা, ভূখণ্ড এবং অর্থনীতির আকার এশিয়ায় তার শক্তি বৃদ্ধির পেছনে মূল চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করছে। ভারতের যুব জনসংখ্যা আগামী দশকগুলোতে জনসংখ্যাগত লভ্যাংশ প্রদান করতে পারে, যা চীনসহ এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোর জন্য সম্ভব নয় যেখানে জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধ হচ্ছে এবং কর্মক্ষম জনসংখ্যা কমে যাচ্ছে।
কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হরদীপ সিং পুরি এই অর্জনকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির “দূরদর্শী নেতৃত্বের” ফল হিসেবে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন, “এটা কোনো কাকতালীয় ঘটনা নয়, বরং প্রধানমন্ত্রী মোদির নেতৃত্বে ভারতের আক্রমণাত্মক আন্তর্জাতিক সম্পৃক্ততার ফলাফল।” পুরি আরও বলেন যে মোদির নেতৃত্বে ভারত “এশিয়ার কিংমেকার” হয়ে উঠতে চলেছে।
লোয়ি ইনস্টিটিউটের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে চীনের প্রভাব স্থির হয়ে আসছে, অন্যদিকে ভারত গতি অর্জন করছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “চীনের শক্তি বাড়ছেও না, কমছেও না, বরং স্থির হয়ে আসছে। ধীর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং দীর্ঘমেয়াদী কাঠামোগত চ্যালেঞ্জের কারণে চীনের অর্থনৈতিক প্রভাব, যদিও এখনও প্রভাবশালী, আর বাড়ছে না।”
অন্যদিকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এশিয়া পাওয়ার ইনডেক্সের ৮টি ব্যাপক মানদণ্ডের মধ্যে ৬টিতে চীনের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে। তবে সামরিক ক্ষমতার ক্ষেত্রে চীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ব্যবধান কমিয়ে এনেছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন যে এশিয়ায় আন্তঃরাষ্ট্রীয় সংঘর্ষের ক্ষেত্রে বেইজিং এখন দ্রুত সামরিক বাহিনী মোতায়েন করতে ভালো অবস্থানে রয়েছে।
ভারতের উত্থানের পাশাপাশি, জাপানের অবস্থান পিছিয়ে যাওয়াও লক্ষণীয়। যদিও জাপানের সামগ্রিক স্কোর ১.৬ পয়েন্ট বেড়েছে, তবুও ভারত প্রথমবারের মতো জাপানকে পিছনে ফেলে তৃতীয় স্থানে উঠে এসেছে। জাপানের অর্থনৈতিক প্রভাব কমে যাওয়া এবং দক্ষিণ কোরিয়া, চীন ও তাইওয়ানের সাথে প্রযুক্তিগত প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়া এর পেছনে কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
তবে জাপান প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা ক্ষেত্রে অধিক সক্রিয় ভূমিকা নিচ্ছে। ওয়াশিংটন এবং অন্যান্য আঞ্চলিক অংশীদারদের সাথে সহযোগিতা বৃদ্ধি করছে জাপান। ফিলিপাইনের সাথে পারস্পরিক প্রবেশাধিকার চুক্তি স্বাক্ষর করা এর একটি উদাহরণ।
এশিয়া পাওয়ার ইনডেক্সে ভারতের এই অবস্থান অঞ্চলে তার বর্ধমান প্রভাব এবং বৈশ্বিক শক্তি হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের সম্ভাবনাকে তুলে ধরেছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) অনুমান করছে যে ২০২৭ সালের মধ্যে ভারত বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হয়ে উঠবে।
তবে প্রতিবেদনে ভারতের সামনে কিছু চ্যালেঞ্জের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। ভারতের প্রতিরক্ষা নেটওয়ার্কের স্কোর টানা তৃতীয় বছরের মতো কমেছে, যার ফলে দেশটি ৯ম স্থানে নেমে এসেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “ভারতের জোটনিরপেক্ষ অবস্থান এবং মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোট নেটওয়ার্কের সাথে নিরাপত্তা সহযোগিতা বাড়ানো নিয়ে সতর্কতার কারণে” এমনটি হয়েছে।
এছাড়া, ভারতের “পাওয়ার গ্যাপ” বা শক্তির ব্যবধান – অর্থাৎ সম্পদের ভিত্তিতে প্রত্যাশিত প্রভাব এবং প্রকৃত প্রভাবের মধ্যে পার্থক্য – রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়া ব্যতীত অঞ্চলের সবচেয়ে বড়। এটি ইঙ্গিত করে যে ভারতের কাছে “বিশেষ করে নিজের ভারত মহাসাগরীয় প্রতিবেশীর বাইরে এশিয়ায় তার প্রভাব বাড়ানোর জন্য প্রচুর সুপ্ত সম্ভাবনা রয়েছে।”
সামগ্রিকভাবে, এশিয়া পাওয়ার ইনডেক্স ২০২৪ প্রতিবেদন এশিয়ার ক্রমবর্ধমান ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্বকে তুলে ধরেছে। যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন প্রধান দুই শক্তি হিসেবে অবস্থান করছে, সেখানে ভারতের উত্থান অঞ্চলের শক্তি ভারসাম্যে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
ভারতের চ্যালেঞ্জ হবে তার বর্তমান গতি বজায় রাখা এবং তার সম্পদ ও সম্ভাবনাকে পূর্ণ প্রভাবে রূপান্তর করা।
এই প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভারতের অর্থনৈতিক সক্ষমতা ও কূটনৈতিক প্রভাব উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২৪ সালে ভারতের অর্থনৈতিক সক্ষমতার স্কোর ৮৩.৮ পয়েন্টে উন্নীত হয়েছে, যা গত বছরের তুলনায় ৩.২ পয়েন্ট বেশি। এই বৃদ্ধির পেছনে রয়েছে ভারতের দ্রুত অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার এবং বৈশ্বিক মূল্যশৃঙ্খলে তার বর্ধমান গুরুত্ব।
কূটনৈতিক প্রভাবের ক্ষেত্রেও ভারত উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। ২০২৪ সালে এই খাতে ভারতের স্কোর দাঁড়িয়েছে ৭২.৫ পয়েন্ট, যা আগের বছরের তুলনায় ২.৮ পয়েন্ট বেশি। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে ভারতের বর্ধিত আন্তর্জাতিক সম্পৃক্ততা এবং জি-২০ সভাপতিত্ব এই অগ্রগতির পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
তবে সামরিক ক্ষমতার ক্ষেত্রে ভারতের অবস্থান তুলনামূলকভাবে দুর্বল। যদিও এই খাতে ভারতের স্কোর ৬৮.১ পয়েন্ট, যা আগের বছরের তুলনায় ১.৭ পয়েন্ট বেশি, তবুও এটি এখনও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপান ও রাশিয়ার পিছনে রয়েছে। ভারতের সামরিক আধুনিকায়ন প্রক্রিয়া চলমান থাকলেও, প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন ও সামরিক শিল্পের ক্ষেত্রে এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে।
লোয়ি ইনস্টিটিউটের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে ভারতের সাংস্কৃতিক প্রভাব ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বলিউড চলচ্চিত্র, ভারতীয় সংগীত ও নৃত্য, যোগ এবং আয়ুর্বেদের মতো ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসা পদ্ধতি বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তা অর্জন করছে। এছাড়া, ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্যক্তিদের বিশ্বের বিভিন্ন প্রভাবশালী পদে অধিষ্ঠিত হওয়া দেশটির নরম ক্ষমতা (soft power) বৃদ্ধিতে সহায়তা করছে।
ভারতের স্থিতিস্থাপকতা বা রেজিলিয়েন্স স্কোরও উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২৪ সালে এই খাতে ভারতের স্কোর দাঁড়িয়েছে ৭৫.২ পয়েন্ট, যা আগের বছরের তুলনায় ২.৫ পয়েন্ট বেশি। করোনা মহামারি মোকাবিলায় ভারতের সফলতা, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় গৃহীত পদক্ষেপ এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় উন্নতি এই স্কোর বৃদ্ধির পেছনে কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
ভবিষ্যৎ সম্পদের দিক থেকেও ভারতের অবস্থান শক্তিশালী। দেশটির বিশাল যুব জনসংখ্যা, ক্রমবর্ধমান শিক্ষার হার এবং প্রযুক্তি খাতে দ্রুত অগ্রগতি ভবিষ্যতে ভারতকে আরও শক্তিশালী করবে বলে প্রতিবেদনে আশা প্রকাশ করা হয়েছে।
তবে ভারতের সামনে কিছু গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জও রয়েছে। দারিদ্র্য, বেকারত্ব, অসমতা এবং পরিবেশগত সমস্যাগুলি মোকাবিলা করা ভারতের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এছাড়া, প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন এবং আঞ্চলিক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করাও ভারতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
এশিয়া পাওয়ার ইনডেক্স ২০২৪-এ ভারতের এই অবস্থান বিশ্ব রাজনীতিতে দেশটির বর্ধমান গুরুত্বকে প্রতিফলিত করে। বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র হিসেবে ভারত এখন শুধু অর্থনৈতিক শক্তি নয়, বরং একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূ-রাজনৈতিক অংশীদার হিসেবেও আত্মপ্রকাশ করছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, আগামী দশকে ভারতের এই উত্থান আরও স্পষ্ট হবে। তবে এর জন্য ভারতকে তার অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জগুলি মোকাবিলা করতে হবে এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কে আরও সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে। বিশেষ করে, চীনের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং পাকিস্তানের সাথে দীর্ঘমেয়াদী উত্তেজনা নিরসন করা ভারতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হবে।
সামগ্রিকভাবে, এশিয়া পাওয়ার ইনডেক্স ২০২৪ প্রতিবেদন ভারতের জন্য একটি ইতিবাচক চিত্র তুলে ধরেছে। এটি দেখিয়েছে যে ভারত ক্রমশ একটি প্রভাবশালী বৈশ্বিক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছে। তবে এই অবস্থান ধরে রাখা এবং আরও উন্নতি করার জন্য ভারতকে তার সম্পদ ও সম্ভাবনাকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে হবে এবং চ্যালেঞ্জগুলি মোকাবিলা করতে হবে।
ভারতের এই উত্থান শুধু দেশটির জন্যই নয়, সমগ্র এশিয়া ও বিশ্বের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। একটি শক্তিশালী ও স্থিতিশীল ভারত আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক শান্তি, নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধির জন্য অপরিহার্য। তাই, আগামী বছরগুলোতে ভারতের অগ্রগতি ও চ্যালেঞ্জগুলি বিশ্ব সম্প্রদায়ের নজরে থাকবে।