বিশ্বের ধনকুবেরদের মানচিত্রে ভারত দ্রুত উত্থান করছে। সাম্প্রতিক ‘ইউবিএস বিলিয়নেয়ার অ্যাম্বিশন্স রিপোর্ট’ অনুযায়ী, ২০২৪ সালে ভারতে বিলিয়নেয়ারের সংখ্যা ১৮৫ ছাড়িয়েছে, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (৮৩৫) এবং চীনের (৪২৭) পরে বিশ্বে তৃতীয় সর্বোচ্চ। বিশেষ করে যখন চীনের ধনকুবেরদের সংখ্যা কমছে, তখন ভারতে তাদের সংখ্যা গত বছরে ২১% বেড়েছে এবং গত ১০ বছরে ১২৩% বৃদ্ধি পেয়েছে।
গত এক বছরে ভারতে নতুন করে ৩২ জন বিলিয়নেয়ার যোগ হয়েছেন, যা দেশের অর্থনীতির প্রবল গতিশীলতার ইঙ্গিত দেয়। ধনকুবেরদের মোট সম্পদের পরিমাণও উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। ২০২৪ সালে ভারতীয় বিলিয়নেয়ারদের সম্পদ ৪২.১% বেড়ে ৯০৫.৬ বিলিয়ন ডলার হয়েছে, যা দশ বছর আগের তুলনায় প্রায় তিনগুণ (২৬৩%)। এ সময়ে বিশ্বব্যাপী বিলিয়নেয়ারদের সম্পদ ১২১% বেড়েছে, ৬.৩ ট্রিলিয়ন থেকে ১৪ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে।
পাশাপাশি, চীনের দিকে তাকালে দেখা যায় একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র। ২০২৩ সালে চীনে ৫২০ জন বিলিয়নেয়ার ছিলেন, যা ২০২৪ সালে কমে ৪২৭ জনে পৌঁছেছে। মূলত অর্থনৈতিক মন্দা এবং সরকারি নিয়ন্ত্রণের কারণে এই সংখ্যা কমেছে। চীনের মোট বিলিয়নেয়ার সম্পদও ২০২০ সালের ২.১ ট্রিলিয়ন ডলার থেকে ২০২৪ সালে ১.৮ ট্রিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে।
‘নাইট ফ্র্যাঙ্ক’ নামক বৈশ্বিক সম্পত্তি পরামর্শক সংস্থার ‘দ্য ওয়েলথ রিপোর্ট ২০২৫’ অনুসারে, ভারতে উচ্চ-নেট-মূল্যের ব্যক্তিদের (১০ মিলিয়ন ডলারের বেশি সম্পদের মালিক) সংখ্যাও ২০২৪ সালে ৬% বেড়ে ৮৫,৬৯৮ পৌঁছেছে। আরও চমকপ্রদ ব্যাপার হলো, ২০১৯ সালে যেখানে মাত্র ৭ জন নতুন বিলিয়নেয়ার যোগ হয়েছিলেন, ২০২৪ সালে সেই সংখ্যা বেড়ে ২৬ জনে পৌঁছেছে।
ভারতের এই উত্থানের পেছনে রয়েছে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কারণ। পারিবারিক ব্যবসার শক্তিশালী উপস্থিতি এর অন্যতম প্রধান কারণ। ভারত বিশ্বে পাবলিকলি লিস্টেড পারিবারিক ব্যবসার সংখ্যায় তৃতীয় স্থানে রয়েছে। এসব ব্যবসা শুধু ঐতিহ্যবাহী খাতেই নয়, বর্তমানে ফার্মাসিউটিক্যাল, অনলাইন শিক্ষা, ফিনটেক এবং ফুড ডেলিভারি সহ নতুন ক্ষেত্রেও সফলভাবে বিস্তার লাভ করছে।
দ্রুত নগরায়ণ, ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার, উৎপাদন ক্ষমতার বৃদ্ধি এবং নবায়নযোগ্য শক্তির দিকে ঝুঁকে পড়া ভারতীয় ধনকুবেরদের সংখ্যা বৃদ্ধির অন্যতম চালিকা শক্তি। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে গত ১০ বছরে বাস্তবায়িত বিভিন্ন কাঠামোগত সংস্কার ভারতকে বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত করতে সাহায্য করেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারত আগামী দশকে বিলিয়নেয়ারদের সংখ্যায় আরও বৃদ্ধি দেখতে পারে, ঠিক যেভাবে চীন ২০২০ সাল পর্যন্ত প্রবৃদ্ধি দেখেছিল। ভারতের অর্থনৈতিক গতিশীলতা, অভিনব উদ্যোক্তাদের উত্থান এবং সরকারি নীতিগত সমর্থন এই প্রবণতাকে আরও ত্বরান্বিত করবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
ভারতের উদীয়মান শক্তির প্রমাণ মেলে দেশের শীর্ষ ধনকুবেরদের তালিকায়। বর্তমানে রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান মুকেশ আম্বানি ৯৫.৪ বিলিয়ন ডলার সম্পদের মালিক হয়ে ভারতের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি এবং বিশ্বে ১৮তম স্থানে রয়েছেন। তার পরেই রয়েছেন গৌতম আদানি (৬২.৩ বিলিয়ন ডলার), শিব নাদার (৪২.১ বিলিয়ন ডলার) এবং সাবিত্রী জিন্দাল (৩৮.৫ বিলিয়ন ডলার)। উল্লেখযোগ্যভাবে, সাবিত্রী জিন্দাল একমাত্র ভারতীয় মহিলা বিলিয়নেয়ার যিনি দেশের শীর্ষ ১০ ধনী তালিকায় স্থান পেয়েছেন।
ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হলো, হুরুন ইন্ডিয়া রিচ লিস্টের মতে, চীনের বিলিয়নেয়ারদের সংখ্যা ২৫% কমেছে, অন্যদিকে ভারতে তা ২৯% বেড়ে রেকর্ড ৩৩৪ জনে পৌঁছেছে। তবে এখনো চীনের মোট বিলিয়নেয়ার সংখ্যা ৭৫৩ জন, যা ভারতের চেয়ে বেশি। চীনা বিলিয়নেয়ারদের মোট সম্পদ ৩ ট্রিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে, যা আগের বছরের তুলনায় ১০% কম।
সামগ্রিকভাবে, ভারতীয় বিলিয়নেয়ারদের সংখ্যা বৃদ্ধি একটি নতুন অর্থনৈতিক ভূগোল তৈরি করছে, যেখানে দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশটি সম্পদ সৃষ্টির একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। এর প্রভাব শুধু অর্থনৈতিক নয়, বৈশ্বিক রাজনৈতিক প্রভাবও বাড়াচ্ছে। যেখানে একদিকে চীনের অর্থনীতিতে স্থবিরতা দেখা যাচ্ছে, সেখানে ভারত তার উদ্যোক্তাদের মাধ্যমে নতুন অর্থনৈতিক সম্ভাবনা তৈরি করছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আগামী দশকে ভারত বিশ্ব অর্থনীতিতে আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে এবং বিলিয়নেয়ারদের সংখ্যা বৃদ্ধির এই ধারা অব্যাহত থাকবে।