ভাষার জন্য প্রাণ দেওয়ার ইতিহাস বাঙালির জীবনে একবার নয়, দুবার ঘটেছে। ১৯৬১ সালের ১৯ মে ভারতের আসাম রাজ্যের বরাক উপত্যকার শিলচর রেলস্টেশনে বাংলা ভাষার স্বীকৃতি আদায়ের আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে ১১ জন ভাষাপ্রেমী শহীদ হয়েছিলেন। এই ঘটনা বাঙালির ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ১৯৫২ সালে ঢাকায় ভাষা আন্দোলনের ঘটনার মাত্র নয় বছর পর আবারও বাঙালিকে নিজের ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য রক্ত দিতে হয়েছিল। বিশ্বের ইতিহাসে একই ভাষার জন্য দুটি আলাদা রাষ্ট্রে এবং আলাদা সময়ে প্রাণ দেওয়ার এমন নজির আর নেই।
শিলচর ভাষা আন্দোলনের পটভূমি
১৯৬১ সালে আসাম রাজ্য সরকার বরাক উপত্যকা বা বরাক ভ্যালির কাছাড় জেলার বাঙালি অধ্যুষিত শিলচর, করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দির বাংলাভাষীদের মাতৃভাষা বাংলাকে উপেক্ষা করে শুধু অসমীয়া ভাষাকে রাজ্যের একমাত্র সরকারি ভাষা হিসেবে ঘোষণা করে। এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বাঙালিরা প্রতিবাদে ফুঁসে ওঠে এবং তা ক্রমে আন্দোলনে রূপ নেয়। বরাক উপত্যকার বাঙালিরা দাবি তোলে যে, যেখানে বাঙালিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, সেখানে বাংলাকেও দ্বিতীয় রাজ্য ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে।
১৯ মে: আন্দোলনের চূড়ান্ত দিন
১৯৬১ সালের ১৯ মে ছিল এই আন্দোলনের মূল দিন। সেদিন সকাল থেকেই শিলচর, হাইলাকান্দি এবং করিমগঞ্জ জেলায় হরতাল শুরু হয়। আন্দোলনকারীরা সরকারি অফিস, আদালত, ডাকঘরসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পিকেটিং করেন। সকাল ভোর থেকেই শিলচর রেল স্টেশনে অবরোধ শুরু হয়। ভাষা আন্দোলনকারীরা শান্তিপূর্ণভাবে সত্যাগ্রহ চালাচ্ছিলেন এবং সকাল ৫টা ৪০ মিনিটের ট্রেনের একটি টিকিটও বিক্রি হয়নি। বিকেল ৪টার পর হরতাল শেষ করার পরিকল্পনা ছিল আন্দোলনকারীদের।
কিন্তু দুপুর আড়াইটার দিকে ঘটনার মোড় ঘুরে গেল। কাটিগোরা থেকে গ্রেপ্তার করা নয় জন সত্যাগ্রহীকে নিয়ে পুলিশের একটি ট্রাক শিলচর রেল স্টেশনের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। আন্দোলনকারীরা গ্রেপ্তার সহযোদ্ধাদের নিয়ে যেতে আপত্তি জানালে ট্রাকচালকসহ পুলিশ বন্দিদের নিয়ে পালিয়ে যায়। এরপর কোনো অজানা ব্যক্তি ট্রাকটি জ্বালিয়ে দেন, যিনি আন্দোলনকারী ছিলেন না বলে ধারণা করা হয়।
নির্মম গণহত্যা
দুপুর আড়াইটার সময় হঠাৎই আন্দোলনকারীদের উপর আক্রমণ চালায় আসাম রাইফেলস। প্রথমে আন্দোলনকারীদের লাঠিচার্জ ও বেয়নেট চার্জ করা হয়। এতে আন্দোলনকারীরা আরও উত্তেজিত হয়ে ওঠেন এবং স্টেশনের বাইরে যারা দাঁড়িয়ে ছিলেন, তারাও আন্দোলনে যোগ দেন। মাত্র সাত মিনিটের মধ্যেই আসাম রাইফেলস ও পুলিশ ব্রাশফায়ার শুরু করে। মুহূর্তেই নয় জন আন্দোলনকারী ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান, তিন জন গুরুতর আহত হন। পরবর্তীতে সেই আহত তিন জনের মধ্যে আরও দু’জন মৃত্যুবরণ করেন।
১১ জন ভাষা শহীদ
বরাক উপত্যকার মাটি যে দিন রক্তে লাল হল, সেদিন বাংলা ভাষার জন্য নিজের প্রাণ উৎসর্গ করলেন যে এগারো জন, তাঁরা হলেন:
- কানাইলাল নিয়োগী
- চন্ডীচরণ সূত্রধর
- হীতেশ বিশ্বাস
- সত্যেন্দ্র দেব
- কুমুদরঞ্জন দাস
- সুনীল সরকার
- তরণী দেবনাথ
- শচীন্দ্র চন্দ্র পাল
- বীরেন্দ্র সূত্রধর
- সুকোমল পুরকায়স্থ
- কমলা ভট্টাচার্য (পৃথিবীর একমাত্র নারী ভাষা শহীদ)
এই শহীদদের বেশিরভাগেরই বয়স ছিল ২৫ বছরের নিচে। অল্প বয়সেই তাঁরা মাতৃভাষার জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করেছিলেন।
আন্দোলনের ফলাফল
শিলচরের এই নির্মম ঘটনার পরদিনই, ২০ মে সকালে, শোকার্ত আন্দোলনকারীরা আসাম সরকারের জারি করা ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে শহীদদের মরদেহ নিয়ে শিলচর শহরে স্মরণকালের বৃহত্তম শোকমিছিল বের করে। গোটা বরাক উপত্যকা শোক ও ক্ষোভে ফেটে পড়ে।
শিলচরে ভাষা আন্দোলনে শহীদদের রক্তের বিনিময়ে আসাম রাজ্য সরকার বাধ্য হয় বরাক উপত্যকায় বাংলাকে সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে। এই আন্দোলন ও ত্যাগের ফলে বাংলা ভাষা আসামের দ্বিতীয় সরকারি ভাষার মর্যাদা পায়।
শিলচর ভাষা শহীদ স্টেশন
২০০৫ সালে বরাক উপত্যকার মানুষ দাবি তোলেন যে, যে রেল স্টেশনে বাংলা ভাষার আন্দোলনের জন্য একাদশ ভাষা সৈনিক প্রাণ দিয়েছিলেন, সেই শিলচর স্টেশনের নাম পরিবর্তন করে “ভাষা শহীদ স্টেশন” রাখা হোক। জনগণের এই দাবির মুখে শেষ পর্যন্ত স্টেশনটির নাম পরিবর্তন করে “ভাষা শহীদ স্টেশন” রাখা হয়।
শহীদ দিবস উদযাপন
প্রতি বছর ১৯ মে বরাক উপত্যকায় ভাষা শহীদ দিবস পালিত হয়। এছাড়া, শিলচরের গান্ধিবাগে অবস্থিত কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে প্রতি বছর ১৯ মে তারিখে ভাষা আন্দোলনের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করা হয়। আসাম, ত্রিপুরা ও পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলে এই দিনটি ভাষা শহীদ দিবস হিসেবে পালিত হয়ে থাকে।
বাঙালির অনন্য সাহসের গাথা
বিশ্বের কোনো জাতি নিজের ভাষার জন্য বাঙালিদের মতো এত ত্যাগ স্বীকার করেনি। নিজের ভাষার জন্য, মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকারের জন্য যে প্রাণ দেওয়া যায়, নিজের সবটুকু উৎসর্গ করা যায়, বাঙালিরা তা দু’বার প্রমাণ করে দিয়েছে।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার দাবিতে ঢাকায় পুলিশের গুলিতে শহীদ হয়েছিলেন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউরসহ আরও অনেকে। ৯ বছর পর ১৯৬১ সালের ১৯ মে ভারতের আসামের বরাক উপত্যকায় একই কারণে আরও এগারো জন প্রাণ উৎসর্গ করেছিলেন। এটি বিশ্ব ইতিহাসে এক অনন্য ঘটনা যে, একই ভাষার জন্য দুই ভিন্ন দেশে এবং দুই ভিন্ন সময়ে বাঙালিকে রক্ত দিতে হয়েছে।
বিস্মৃত ইতিহাস
দুঃখজনক হলেও সত্য যে, শিলচর ভাষা আন্দোলনের এই গৌরবময় অধ্যায়টি বাঙালির ভাষা-আন্দোলনের ইতিহাসে একটি উপেক্ষিত এবং অনেকটাই বিস্মৃত অধ্যায়। বাংলাদেশের অনেক বাঙালিই জানেন না যে, বাংলা ভাষার জন্য শুধু ঢাকাতেই নয়, ভারতের আসামেও বাঙালিকে রক্ত দিতে হয়েছে।
শিলচর থেকে বিশ্বভাষা দিবস
১৯৫২ ও ১৯৬১ সালে বাংলা ভাষার জন্য উৎসর্গীকৃত প্রাণের স্বীকৃতি স্বরূপ ইউনেস্কো ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছে। কিন্তু ১৯ মে-র শিলচরের ভাষা শহীদদের অবদান এখনো আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে যথাযথ স্বীকৃতি পায়নি।
আজ শিলচর ভাষা শহীদ দিবসের গুরুত্ব এখানেই যে, মাতৃভাষার জন্য আত্মত্যাগ শুধু একটি দেশের ইতিহাস নয়, বাঙালি জাতির অবিচ্ছেদ্য সাংস্কৃতিক চেতনার অংশ। ১৯৬১ সালের ১৯ মে শিলচরে যে এগারো জন প্রাণ দিয়েছিলেন, তাঁদের আত্মত্যাগ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, ভাষা শুধু যোগাযোগের মাধ্যম নয়, এটি একটি জাতির পরিচয় ও অস্তিত্বের প্রতীক।
প্রতি বছর ১৯ মে আমরা যখন শিলচর ভাষা শহীদ দিবস পালন করি, তখন শুধু শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই না, বরং আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি অঙ্গীকারও নবায়ন করি। যে সকল বীর মাতৃভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছেন, তাঁদের স্মৃতি চিরজীবী হোক। শিলচর ভাষা শহীদ দিবস আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার সংগ্রাম অব্যাহত রাখতে হবে, কারণ ভাষা শুধু কথা বলার মাধ্যম নয়, ভাষা হল আমাদের আত্মার প্রকাশ, আমাদের অস্তিত্বের অবিচ্ছেদ্য অংশ।