জ্যোতিষ শাস্ত্রের জন্মছক বা কুণ্ডলী (Kundli) হলো একজন ব্যক্তির জন্মের মুহূর্তের আকাশের একটি মানচিত্র। এই ছকের বিভিন্ন খোপে লেখা ১ থেকে ১২ পর্যন্ত সংখ্যাগুলি আসলে ১২টি রাশির (Zodiac Signs) প্রতীক। এই সংখ্যাগুলি (যেমন ১=মেষ, ২=বৃষ) কোন ঘরে বসবে তা নির্ভর করে ব্যক্তির জন্ম সময় এবং জন্ম স্থানের ওপর, যা দিয়ে লগ্ন (Ascendant) নির্ধারিত হয়। পৃথিবীর আহ্নিক গতির ফলে প্রতি মুহূর্তে পূর্ব দিগন্তে উদিত রাশি পরিবর্তিত হয়; প্রায় প্রতি দুই ঘণ্টায় লগ্ন পাল্টে যায়। একারণেই, একই দিনে জন্ম হলেও, ভিন্ন ভিন্ন সময়ে জন্মানো দুই ব্যক্তির জন্মছকের প্রথম ঘরে (প্রথম ভাব) ভিন্ন সংখ্যা বা রাশি থাকতে পারে এবং সেই অনুযায়ী বাকি সংখ্যাগুলিও ভিন্ন ঘরে বিন্যস্ত হয়। এই সংখ্যাগুলি বা রাশির অবস্থানই ব্যক্তির জীবন, চরিত্র এবং ভবিতব্যের ভিত্তি রচনা করে বলে জ্যোতিষশাস্ত্রে বিশ্বাস করা হয়।
জ্যোতিষ শাস্ত্রের জন্মছক: একটি প্রাথমিক ধারণা
জ্যোতিষ শাস্ত্র, বিশেষ করে বৈদিক জ্যোতিষ (Vedic Astrology), হাজার হাজার বছরের পুরানো একটি জ্ঞানকাণ্ড। এর মূল ভিত্তি হলো গ্রহ, নক্ষত্র এবং মহাজাগতিক বস্তুর অবস্থান কীভাবে পৃথিবীর জীবজগৎ এবং মানুষের জীবনের ওপর প্রভাব ফেলে, তার বিশ্লেষণ। এই বিশ্লেষণের প্রধান হাতিয়ার হলো জন্মছক বা কোষ্ঠী (Birth Chart/Horoscope)।
সহজ কথায়, জন্মছক হলো একটি মহাজাগতিক ‘স্ন্যাপশট’। যখন একটি শিশু জন্মগ্রহণ করে, সেই নির্দিষ্ট মুহূর্তে (তারিখ, সময় এবং স্থান অনুযায়ী) মহাকাশে গ্রহগুলি (রবি, চন্দ্র, মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতি, শুক্র, শনি, রাহু ও কেতু) কোন কোন রাশিতে এবং কোন অবস্থানে ছিল, তার একটি চিত্র।
একটি জন্মছকের তিনটি প্রধান উপাদান থাকে:
১. ১২টি ভাব (Houses): এগুলি হলো ছকের ১২টি খোপ বা ঘর, যা জীবনের ১২টি ভিন্ন ভিন্ন দিককে (যেমন শরীর, ধন, পরাক্রম, সুখ, সন্তান, শত্রু, বিবাহ, আয়ু, ভাগ্য, কর্ম, লাভ, ব্যয়) প্রতিনিধিত্ব করে।
২. ১২টি রাশি (Signs): এগুলি হলো মেষ থেকে মীন পর্যন্ত ১২টি রাশি, যেগুলি সংখ্যা (১ থেকে ১২) দ্বারা চিহ্নিত থাকে।
৩. ৯টি গ্রহ (Planets): এই গ্রহগুলি ছকের বিভিন্ন ঘরে (ভাবে) এবং বিভিন্ন রাশিতে অবস্থান করে।
এই নিবন্ধে আমাদের মূল আলোচ্য বিষয় হলো ছকের খোপে লেখা সেই সংখ্যাগুলি—অর্থাৎ রাশিগুলি—কেন এবং কীভাবে তাদের স্থান পরিবর্তন করে।
ছকের সংখ্যাগুলি কী? (What are the numbers in the chart?)
প্রায়শই যারা প্রথমবার জন্মছক দেখেন, তারা ছকের ১২টি খোপে লেখা ১, ২, ৩ থেকে ১২ পর্যন্ত সংখ্যাগুলি দেখে বিভ্রান্ত হন। অনেকেই ভাবেন এগুলি হয়তো “ভাব সংখ্যা” (House Number)। কিন্তু তা নয়।
ছকের ১২টি খোপ সর্বদাই ১২টি ভাবকে বোঝায়, যা একটি নির্দিষ্ট ক্রমে থাকে। কিন্তু খোপের ভেতরে লেখা সংখ্যাগুলি হলো রাশি সংখ্যা (Rashi Number)। বৈদিক জ্যোতিষে রাশিচক্রকে ১২টি ভাগে ভাগ করা হয়েছে এবং প্রতিটিকে একটি সংখ্যা দেওয়া হয়েছে।
রাশিচক্রের ১২টি সংখ্যা (The 12 Numbers of the Zodiac)
এই সংখ্যাগুলি এবং তাদের সংশ্লিষ্ট রাশি ও অধিপতি গ্রহের তালিকা নিচে দেওয়া হলো। এই ক্রমটি স্থির এবং অপরিবর্তনীয়।
| সংখ্যা (Number) | রাশি (Zodiac Sign – Bengali) | রাশি (Zodiac Sign – English) | অধিপতি গ্রহ (Ruling Planet) |
| ১ | মেষ | Aries | মঙ্গল (Mars) |
| ২ | বৃষ | Taurus | শুক্র (Venus) |
| ৩ | মিথুন | Gemini | বুধ (Mercury) |
| ৪ | কর্কট | Cancer | চন্দ্র (Moon) |
| ৫ | সিংহ | Leo | রবি (Sun) |
| ৬ | কন্যা | Virgo | বুধ (Mercury) |
| ৭ | তুলা | Libra | শুক্র (Venus) |
| ৮ | বৃশ্চিক | Scorpio | মঙ্গল (Mars) |
| ৯ | ধনু | Sagittarius | বৃহস্পতি (Jupiter) |
| ১০ | মকর | Capricorn | শনি (Saturn) |
| ১১ | কুম্ভ | Aquarius | শনি (Saturn) |
| ১২ | মীন | Pisces | বৃহস্পতি (Jupiter) |
ভাব (House) এবং রাশি (Sign): পার্থক্য কী?
এটি জ্যোতিষের সবচেয়ে মৌলিক এবং গুরুত্বপূর্ণ ধারণাগুলির মধ্যে একটি।
- ভাব (House): ভাব হলো ‘ক্ষেত্র’ বা ‘মঞ্চ’। এগুলি জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রকে বোঝায়। যেমন, সপ্তম ভাব (7th House) বিবাহের ক্ষেত্র। এই ভাবগুলি ছকে স্থির। উত্তর ভারতীয় ছকে প্রথম ভাব (First House) সর্বদা শীর্ষে থাকে।
- রাশি (Sign): রাশি হলো ‘শক্তি’ বা ‘চরিত্র’। এই রাশিগুলি (সংখ্যা দ্বারা চিহ্নিত) ওই ভাবগুলিতে বা ক্ষেত্রগুলিতে অবস্থান করে এবং সেই ক্ষেত্রের ফলাফলকে প্রভাবিত করে।
উদাহরণস্বরূপ, যদি কারো সপ্তম ভাবে ( বিবাহের ঘরে) ‘৭’ সংখ্যাটি (তুলা রাশি) থাকে, তবে তার বিবাহ বা জীবনসঙ্গী তুলা রাশির মতো বৈশিষ্ট্য (ভারসাম্য, সৌন্দর্য, অংশীদারিত্ব) দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে। আবার যদি সেখানে ‘১’ সংখ্যাটি (মেষ রাশি) থাকে, তবে সম্পর্কটি মেষের মতো (আবেগপ্রবণ, স্বাধীন, সংঘাতপূর্ণ) হতে পারে।
সংখ্যাগুলি কেন পাল্টায়? প্রধান কারণ – লগ্ন (Why do the numbers change? The Main Reason – The Ascendant)
এবার আমরা মূল প্রশ্নে আসি: কেন আমার ছকের প্রথম ঘরে ‘৫’ (সিংহ) লেখা, কিন্তু আমার বন্ধুর ছকের প্রথম ঘরে ‘৯’ (ধনু) লেখা?
এর একমাত্র উত্তর হলো লগ্ন (Lagna) বা Ascendant।
লগ্ন (Ascendant) কী?
কোনো ব্যক্তির জন্মের সময়, সেই নির্দিষ্ট স্থান থেকে পূর্ব দিগন্তে যে রাশিটি উদিত হচ্ছিল (The Zodiac Sign rising on the Eastern Horizon), তাকেই সেই ব্যক্তির লগ্ন বা লগ্ন রাশি বলা হয়।
জন্মছকের প্রথম ভাব (First House) হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভাব। এটি ব্যক্তিকে নিজেই বোঝায় (তার শরীর, স্বাস্থ্য, ব্যক্তিত্ব, সামগ্রিক জীবন)। এই প্রথম ভাবকেই ‘লগ্ন’ বলা হয়।
সুতরাং, জন্মের সময় পূর্ব দিগন্তে যদি মীন রাশি (সংখ্যা ১২) উদিত হয়, তবে সেই ব্যক্তির লগ্ন হবে মীন। তার জন্মছকের প্রথম ভাবে ‘১২’ সংখ্যাটি লেখা হবে। এবং তারপর ঘড়ির কাঁটার বিপরীত দিকে (উত্তর ভারতীয় ছকে) ক্রমানুসারে বাকি রাশিগুলি (১, ২, ৩…) বাকি ভাবগুলিতে (দ্বিতীয় ভাব, তৃতীয় ভাব…) বসে যাবে।
পৃথিবীই কারণ! (The Earth is the Reason!)
এই লগ্ন কেন এত দ্রুত পরিবর্তিত হয়, তার একটি বৈজ্ঞানিক এবং জ্যোতির্বিদ্যাগত ব্যাখ্যা রয়েছে।
১. আহ্নিক গতি: আমরা জানি, পৃথিবী তার নিজের অক্ষের ওপর পশ্চিম থেকে পূর্বে ঘুরছে। এই একবার সম্পূর্ণ ঘুরতে প্রায় ২৪ ঘন্টা সময় লাগে।
২. রাশিচক্রের অবস্থান: জ্যোতিষ শাস্ত্র অনুযায়ী, পৃথিবীকে কেন্দ্র করে একটি কাল্পনিক বৃত্তাকার পথ (Ecliptic) রয়েছে, যা ৩৬০ ডিগ্রী। এই ৩৬০ ডিগ্রীকে ১২টি সমান ভাগে (প্রতিটি ৩০ ডিগ্রী) ভাগ করা হয়েছে, যাদের প্রত্যেকটি এক একটি রাশি (মেষ, বৃষ ইত্যাদি)।
৩. উদীয়মান রাশি: পৃথিবীর এই আহ্নিক গতির কারণেই আমাদের কাছে মনে হয় সমগ্র রাশিচক্রটি পূর্ব দিক থেকে উদিত হয়ে পশ্চিমে অস্ত যাচ্ছে।
৪. সময় গণনা: সম্পূর্ণ ৩৬০ ডিগ্রী রাশিচক্রটি ২৪ ঘন্টায় পূর্ব দিগন্ত অতিক্রম করে।
* $২৪ \text{ ঘন্টা} / ১২ \text{ রাশি} = \text{প্রায় } ২ \text{ ঘন্টা প্রতি রাশি}$
এর অর্থ হলো, পূর্ব দিগন্তে একটি রাশির উদয় থেকে অস্ত যেতে (অর্থাৎ লগ্ন হিসেবে থাকতে) গড়ে প্রায় দুই ঘন্টা সময় লাগে। এই কারণেই, জন্ম সময়ের সামান্য তারতম্য (কখনও কখনও কয়েক মিনিটের) লগ্ন পরিবর্তন করে দিতে পারে। আর লগ্ন পরিবর্তিত হওয়া মানেই হলো ছকের প্রথম ঘরের সংখ্যাটি পাল্টে যাওয়া এবং ফলস্বরূপ, বাকি ১১টি ঘরের সংখ্যাও (রাশি) পাল্টে যাওয়া।
নাসা (NASA)-এর মতো মহাকাশ গবেষণা সংস্থাগুলি পৃথিবীর এই আহ্নিক গতি এবং গ্রহণপথ (Ecliptic) সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সরবরাহ করে, যা এই জ্যোতিষীয় গণনার জ্যোতির্বিদ্যাগত ভিত্তি স্থাপন করে। (NASA – Earth’s Rotation)
একটি উদাহরণ (An Example)
ধরুন, কলকাতায় আজ সকাল ৬টায় একজন শিশু জন্মগ্রহণ করলো। সেই সময় পূর্ব দিগন্তে কর্কট রাশি (সংখ্যা ৪) উদিত হচ্ছিল।
- তার লগ্ন হবে কর্কট। তার ছকের প্রথম ভাবে ‘৪’ লেখা থাকবে।
- তার দ্বিতীয় ভাবে ‘৫’ (সিংহ), তৃতীয় ভাবে ‘৬’ (কন্যা), সপ্তম ভাবে ‘১০’ (মকর) এবং দশম ভাবে ‘১’ (মেষ) লেখা থাকবে।
এবার, ধরুন ওই একই দিনে, একই হাসপাতালে সকাল ৯টায় আরেকটি শিশু জন্মগ্রহণ করলো। এই ৩ ঘন্টার মধ্যে পৃথিবী ঘুরে যাওয়ার ফলে পূর্ব দিগন্তে তখন তুলা রাশি (সংখ্যা ৭) উদিত হচ্ছে।
- এই দ্বিতীয় শিশুর লগ্ন হবে তুলা। তার ছকের প্রথম ভাবে ‘৭’ লেখা থাকবে।
- তার দ্বিতীয় ভাবে ‘৮’ (বৃশ্চিক), তৃতীয় ভাবে ‘৯’ (ধনু), সপ্তম ভাবে ‘১’ (মেষ) এবং দশম ভাবে ‘৪’ (কর্কট) লেখা থাকবে।
দেখুন, মাত্র ৩ ঘন্টার ব্যবধানে দুটি শিশুর জন্মছকের সমস্ত ঘরের রাশি (সংখ্যা) সম্পূর্ণ পাল্টে গেলো। প্রথম শিশুর দশম (কর্ম) ভাবে যেখানে মেষ (১) রাশি, দ্বিতীয় শিশুর সেখানে কর্কট (৪) রাশি। এর ফলে, জ্যোতিষ শাস্ত্র মতে, এই দুই শিশুর চরিত্র, ভাগ্য এবং কর্মজীবন সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির হবে।
১২টি ভাব এবং তাদের তাৎপর্য (The 12 Houses and Their Significance)
যখন একটি লগ্ন নির্ধারিত হয় এবং ১২টি রাশি (সংখ্যা) ১২টি ভাবে বসে যায়, তখন জ্যোতিষীরা প্রতিটি ভাব বিশ্লেষণ করেন। এখানে সংক্ষেপে ১২টি ভাবের তাৎপর্য বর্ণনা করা হলো, যা এই বিষয়ের গভীরতা বুঝতে সাহায্য করবে।
প্রথম ভাব (লগ্ন): ‘আমি’ (1st House: ‘I’)
- মূল বিষয়: এটি ‘তনু ভাব’ নামে পরিচিত। এটি সামগ্রিকভাবে ব্যক্তিকে বোঝায়।
- বিচার্য বিষয়: ব্যক্তির শারীরিক গঠন, বর্ণ, আকৃতি, স্বাস্থ্য, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, ব্যক্তিত্ব, স্বভাব, খ্যাতি, আত্মসম্মান এবং জীবনের সামগ্রিক সূচনা। লগ্ন এবং লগ্নপতি (লগ্নের অধিপতি গ্রহ) শক্তিশালী হলে ব্যক্তি জীবনে অনেক বাধা অতিক্রম করতে পারে।
দ্বিতীয় ভাব: ‘আমার’ (2nd House: ‘Mine’)
- মূল বিষয়: এটি ‘ধন ভাব’ বা ‘কুটুম্ব ভাব’। এটি ব্যক্তির অধিকার বা সঞ্চয়কে বোঝায়।
- বিচার্য বিষয়: অর্জিত ধন, ব্যাংক ব্যালেন্স, পারিবারিক সম্পত্তি, বাকশক্তি (মিষ্টি বা কর্কশ), প্রাথমিক শিক্ষা, খাদ্যাভ্যাস এবং পরিবারের সদস্যদের (বিশেষ করে পৈতৃক পরিবার) সঙ্গে সম্পর্ক।
তৃতীয় ভাব: ‘আমার প্রচেষ্টা’ (3rd House: ‘My Efforts’)
- মূল বিষয়: এটি ‘সহজ ভাব’ বা ‘পরাক্রম ভাব’।
- বিচার্য বিষয়: ব্যক্তির সাহস, পরাক্রম, মানসিক শক্তি, ছোট ভাইবোন, স্বল্প দূরত্বের ভ্রমণ, যোগাযোগ (লেখালেখি, সাংবাদিকতা, সোশ্যাল মিডিয়া), শখ এবং শারীরিক বল। এই ভাবটি দেখায় ব্যক্তি তার লক্ষ্য পূরণের জন্য কতটা প্রচেষ্টা করতে ইচ্ছুক।
চতুর্থ ভাব: ‘আমার শান্তি’ (4th House: ‘My Peace’)
- মূল বিষয়: এটি ‘সুখ ভাব’ বা ‘মাতৃ ভাব’। এটি জীবনের অভ্যন্তরীণ সুখ এবং নিরাপত্তাকে বোঝায়।
- বিচার্য বিষয়: মা, মায়ের সাথে সম্পর্ক, মানসিক শান্তি, গৃহসুখ, বাড়ি, স্থাবর সম্পত্তি (জমি, বাড়ি), যানবাহন, প্রাথমিক বা স্কুল স্তরের শিক্ষা এবং জীবনের স্বাচ্ছন্দ্য।
পঞ্চম ভাব: ‘আমার সৃষ্টি’ (5th House: ‘My Creation’)
- মূল বিষয়: এটি ‘পুত্র ভাব’ বা ‘বিদ্যা ভাব’। এটি ব্যক্তির সৃজনশীলতা এবং বুদ্ধিমত্তাকে বোঝায়।
- বিচার্য বিষয়: সন্তান, উচ্চ শিক্ষা (কলেজ/বিশ্ববিদ্যালয়), বুদ্ধিমত্তা, সৃজনশীল কাজ (শিল্প, অভিনয়), প্রেম-রোমান্স, ফটকা বা শেয়ার বাজারের লাভ (Speculation) এবং পূর্বজন্মের পুণ্য।
ষষ্ঠ ভাব: ‘আমার বাধা’ (6th House: ‘My Obstacles’)
- মূল বিষয়: এটি ‘রিপু ভাব’ বা ‘রোগ ভাব’। এটি জীবনের সংঘাত এবং বাধাগুলিকে বোঝায়।
- বিচার্য বিষয়: শত্রু, ঋণ, রোগ, প্রতিযোগিতা, মামলা-মোকদ্দমা, দৈনন্দিন রুটিনের কাজ (চাকরি), পোষা প্রাণী এবং জীবনের চ্যালেঞ্জ। একটি শক্তিশালী ষষ্ঠ ভাব ব্যক্তিকে প্রতিযোগী পরীক্ষায় সাফল্য দেয়।
সপ্তম ভাব: ‘আমরা’ (7th House: ‘We’)
- মূল বিষয়: এটি ‘জায়া ভাব’ বা ‘অংশীদার ভাব’। এটি ‘আমি’ (প্রথম ভাব)-এর ঠিক বিপরীত।
- বিচার্য বিষয়: বিবাহ, জীবনসঙ্গী (স্বামী বা স্ত্রী), ব্যবসায়িক অংশীদার, জনসাধারণের সাথে সম্পর্ক (Public Image), চুক্তি এবং আইনি বন্ধন। এটি সরাসরি সম্পর্ক এবং অংশীদারিত্বের গুণমান নির্ধারণ করে।
অষ্টম ভাব: ‘গোপনীয়তা’ (8th House: ‘Secrecy’)
- মূল বিষয়: এটি ‘আয়ু ভাব’ বা ‘মৃত্যু ভাব’। এটি জীবনের গভীর, লুকানো এবং আকস্মিক ঘটনাগুলিকে বোঝায়।
- বিচার্য বিষয়: আয়ু, মৃত্যু বা মৃত্যুর কারণ, আকস্মিক দুর্ঘটনা, উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তি, লটারি, গভীর গবেষণা, গুপ্তবিদ্যা (জ্যোতিষ, তন্ত্র), গোপনীয়তা এবং জীবনের বড় পরিবর্তন বা রূপান্তর।
নবম ভাব: ‘আমার বিশ্বাস’ (9th House: ‘My Beliefs’)
- মূল বিষয়: এটি ‘ভাগ্য ভাব’ বা ‘ধর্ম ভাব’। এটি ব্যক্তির ভাগ্য, উচ্চ জ্ঞান এবং দর্শনকে বোঝায়।
- বিচার্য বিষয়: ভাগ্য, পিতা, গুরু বা শিক্ষক, উচ্চতর দর্শন, ধর্মীয় বিশ্বাস, আধ্যাত্মিকতা, দীর্ঘ দূরত্বের ভ্রমণ (বিদেশ ভ্রমণ), এবং উচ্চতর শিক্ষা বা প্রজ্ঞা। এটি জীবনের আশীর্বাদ স্বরূপ।
দশম ভাব: ‘আমার কর্ম’ (10th House: ‘My Karma/Career’)
- মূল বিষয়: এটি ‘কর্ম ভাব’ বা ‘রাজ্য ভাব’। এটি সমাজের প্রতি ব্যক্তির কর্ম এবং তার স্ট্যাটাসকে বোঝায়।
- বিচার্য বিষয়: পেশা, কর্মজীবন, সামাজিক মর্যাদা, খ্যাতি, প্রতিপত্তি, সরকার বা কর্তৃপক্ষের সাথে সম্পর্ক, পদোন্নতি এবং জীবনের লক্ষ্য। এটি ব্যক্তির ‘কর্ম’ বা কাজকে নির্দেশ করে।
একাদশ ভাব: ‘আমার লাভ’ (11th House: ‘My Gains’)
- মূল বিষয়: এটি ‘আয় ভাব’ বা ‘লাভ ভাব’। এটি জীবনের সমস্ত ধরণের প্রাপ্তি এবং আকাঙ্ক্ষা পূরণকে বোঝায়।
- বিচার্য বিষয়: আয়, লাভ, আর্থিক বৃদ্ধি, বড় ভাইবোন, বন্ধু-বান্ধব, সামাজিক নেটওয়ার্ক, ইচ্ছা বা আকাঙ্ক্ষা পূরণ এবং পুরস্কার। এটি দশম ভাবের (কর্ম) ফলাফল।
দ্বাদশ ভাব: ‘আমার মুক্তি’ (12th House: ‘My Liberation’)
- মূল বিষয়: এটি ‘ব্যয় ভাব’ বা ‘মোক্ষ ভাব’। এটি জীবনের শেষ, ক্ষতি এবং মুক্তিকে বোঝায়।
- বিচার্য বিষয়: ব্যয় বা খরচ, ক্ষতি, হাসপাতালবাস, কারাবাস, বিচ্ছিন্নতা, বিদেশ বা দূরবর্তী স্থানে বসবাস, গোপন শত্রু, দানধ্যান এবং আধ্যাত্মিক মুক্তি বা মোক্ষ।
জন্মছকের বিভিন্ন শৈলী (Different Styles of Birth Charts)
জন্মছক বা কুণ্ডলী প্রধানত তিনটি ভিন্ন শৈলীতে আঁকা হয়: উত্তর ভারতীয় (North Indian), দক্ষিণ ভারতীয় (South Indian) এবং পূর্ব ভারতীয় (East Indian/Bengali)।
- উত্তর ভারতীয় (ডায়মন্ড) শৈলী: এই শৈলীতে ভাবগুলি (Houses) স্থির থাকে, কিন্তু রাশিগুলি (সংখ্যা) লগ্নের উপর ভিত্তি করে ঘোরে। প্রথম ভাব সর্বদা শীর্ষে থাকে। এটিই এই নিবন্ধে ব্যবহৃত উদাহরণের ভিত্তি।
- দক্ষিণ ভারতীয় (বর্গক্ষেত্র) শৈলী: এই শৈলীতে রাশিগুলি (Signs) স্থির থাকে। ১২টি খোপ সর্বদা মেষ, বৃষ, মিথুন… এভাবে নির্দিষ্ট থাকে। লগ্ন (Lagna) এবং গ্রহগুলি সেই রাশিগুলিতে গিয়ে বসে।
- পূর্ব ভারতীয় (বৃত্তাকার) শৈলী: এটি উত্তর ভারতীয় শৈলীর মতোই, তবে এটি বৃত্তাকার বা আয়তক্ষেত্রাকার হতে পারে এবং গণনা পদ্ধতিতেও সামান্য পার্থক্য দেখা যায়।
গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, শৈলী যাই হোক না কেন, মূল নীতি একই। লগ্নের ভিত্তিতেই নির্ধারিত হয় কোন ভাবে কোন রাশি পড়ছে।
সংখ্যাগুলি অপরিবর্তনীয়, কিন্তু গ্রহগুলি পরিবর্তনশীল
একটি বিষয় স্পষ্ট হওয়া দরকার: একজন ব্যক্তির জন্মছকের (Birth Chart) সংখ্যাগুলি বা রাশিগুলি স্থির এবং অপরিবর্তনীয়। এটি জীবনের একটি ব্লুপ্রিন্ট। আপনার লগ্নে যদি ‘৫’ (সিংহ) থাকে, তবে তা সারাজীবনের জন্য ‘৫’ (সিংহ)-ই থাকবে।
তাহলে জ্যোতিষীরা প্রতিদিনের, মাসিক বা বার্ষিক ভবিষ্যদ্বাণী করেন কীভাবে?
এর উত্তর হলো গোচর (Gochar) বা Transits।
- জন্মছক (Fixed): এটি আপনার জন্মের মানচিত্র।
- গোচর (Changing): এটি হলো বর্তমান আকাশে গ্রহগুলির অবস্থান।
উদাহরণস্বরূপ, শনি গ্রহ (Saturn) বর্তমানে (২০২৫ সালে) কুম্ভ রাশিতে (Aquarius) বিচরণ করছে। আপনার জন্মছকে (আপনার স্থির মানচিত্র) কুম্ভ রাশি (সংখ্যা ১১) যে ভাবটিতে (ঘরে) পড়েছে, শনি বর্তমানে সেই ভাবটিকে প্রভাবিত করছে।
এই গোচরের গ্রহগুলি আপনার স্থির জন্মছকের ওপর দিয়ে চলার সময় বিভিন্ন ঘটনা ঘটায়। তাই, আপনার ছকের সংখ্যা (রাশি) পাল্টায় না, বরং সেই সংখ্যাগুলির ওপর দিয়ে চলমান গ্রহগুলি পাল্টায়। গ্রহগুলির এই দৈনিক অবস্থান নাসা-এর জেপিএল হরাইজন সিস্টেম (JPL Horizons System) এর মতো জ্যোতির্বিদ্যা সংক্রান্ত ডেটাবেস থেকে সুনির্দিষ্টভাবে জানা যায়, যা জ্যোতিষীরা তাদের গণনার জন্য ব্যবহার করেন।
পরিশেষে বলা যায়, জন্মছকের খোপে লেখা ১ থেকে ১২ পর্যন্ত সংখ্যাগুলি হলো মেষ থেকে মীন পর্যন্ত ১২টি রাশির সাংকেতিক চিহ্ন। এই সংখ্যাগুলির অবস্থান বা বিন্যাস কেন পাল্টায় বা একেকজনের একেকরকম হয়, তার মূল কারণ হলো লগ্ন (Ascendant)।
জন্মের সময় পূর্ব দিগন্তে কোন রাশি উদিত হচ্ছে, তার ওপর ভিত্তি করে লগ্ন নির্ধারিত হয়। পৃথিবীর দ্রুত আহ্নিক গতির ফলে প্রতি দুই ঘন্টায় এই লগ্ন রাশি পাল্টে যায়। লগ্ন পাল্টে যাওয়ার অর্থ হলো, প্রথম ঘরের রাশি (সংখ্যা) পাল্টে যাওয়া, যার ফলে পুরো ছকের বিন্যাসই নতুন করে তৈরি হয়। এই লগ্ন এবং ১২টি ভাবে অবস্থিত ১২টি রাশিই জ্যোতিষ বিচারে একজন ব্যক্তির জীবনের মূল ভিত্তি রচনা করে।











