B-2 Spirit stealth bomber: সম্প্রতি বিশ্বজুড়ে আলোড়ন তুলেছে যুক্তরাষ্ট্রের এক নজিরবিহীন সামরিক অভিযান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের সবচেয়ে গোপন ও শক্তিশালী বোমারু বিমান ‘B-2 স্পিরিট’ ব্যবহার করে ইরানের তিনটি প্রধান পরমাণুকেন্দ্রে হামলা চালিয়েছে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই অভিযানকে “অত্যন্ত সফল” বলে ঘোষণা করেন এবং জানান, ইরানের সবচেয়ে সুরক্ষিত ফোর্ডো পরমাণুকেন্দ্রটি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়েছে। এই অভিযানে ‘B-2 স্পিরিট’ কেমন ভূমিকা রেখেছে, কীভাবে এত গভীর ও সুরক্ষিত স্থাপনা ধ্বংস করা সম্ভব হয়েছে, আজকের ব্লগে থাকছে তারই বিস্তারিত বিশ্লেষণ।
B-2 স্পিরিট: আধুনিক যুদ্ধবিমানের চূড়ান্ত নিদর্শন
বিশ্বের সবচেয়ে গোপন ও ব্যয়বহুল বোমারু
‘B-2 স্পিরিট’ (B-2 Spirit) হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি সবচেয়ে উন্নত স্টেলথ বোমারু বিমান। নর্থরপ গ্রুম্যান কোম্পানির তৈরি এই বিমানটি মূলত শীতল যুদ্ধের সময়ে গভীর শত্রু অঞ্চলে প্রবেশ করে গোপনে বোমা ফেলার জন্য ডিজাইন করা হয়। মাত্র ২১টি ‘B-2 স্পিরিট’ তৈরি হয়েছে, প্রতিটির দাম ২.১ বিলিয়ন ডলার—যা বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল সামরিক বিমান হিসেবে পরিচিত।
স্টেলথ প্রযুক্তি: রাডারেও অদৃশ্য
‘B-2 স্পিরিট’-এর সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো এর স্টেলথ প্রযুক্তি। বিমানের বিশেষ আকৃতি ও রাডার-শোষণকারী উপাদান ব্যবহার করার ফলে এটি শত্রুর রাডারে ধরা পড়ে না বললেই চলে। এর রাডার সিগনেচার এতটাই কম যে, অনেক সময় এটি একটি ছোট পাখির মতোই রাডারে ধরা পড়ে।
দূরপাল্লার ক্ষমতা ও বিপুল অস্ত্রবহনের সামর্থ্য
‘B-2 স্পিরিট’ একটানা ১১,১১২ কিলোমিটার (৬,০০০ নটিক্যাল মাইল) উড়তে পারে, মাঝপথে আকাশে জ্বালানি ভরার সুবিধা থাকলে পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে পৌঁছাতে পারে। এটি সর্বোচ্চ ৪০,০০০ পাউন্ড (১৮,১৪৪ কেজি) পর্যন্ত অস্ত্র বহন করতে পারে, যার মধ্যে রয়েছে কনভেনশনাল ও পারমাণবিক বোমা, জয়েন্ট ডাইরেক্ট অ্যাটাক মিউনিশন (JDAM), জয়েন্ট স্ট্যান্ডঅফ উইপন (JSOW), এবং দীর্ঘপাল্লার JASSM-ER মিসাইল।
অভিযান: ইরানের পরমাণুকেন্দ্রে ‘B-2 স্পিরিট’-এর আঘাত
৩৭ ঘণ্টার টানা উড়ান ও গোপন হামলা
২০২৫ সালের ২১ জুন যুক্তরাষ্ট্রের মিসৌরির হুইটম্যান এয়ার ফোর্স বেস থেকে ‘B-2 স্পিরিট’ বোমারু বিমানগুলো ১৩,০০০ কিলোমিটার দূরে ইরানের দিকে রওনা দেয়। টানা ৩৭ ঘণ্টা উড়ে, একাধিকবার আকাশে জ্বালানি ভরার পর, তারা ইরানের সবচেয়ে সুরক্ষিত ও গভীর ভূগর্ভস্থ পরমাণুকেন্দ্রগুলোতে হামলা চালায়। এই অভিযানে প্রধান লক্ষ্য ছিল ফোর্ডো, নাতাঞ্জ ও ইসফাহান কেন্দ্র।
‘বাঙ্কার বাস্টার’ বোমার বিধ্বংসী শক্তি
এই অভিযানে ‘B-2 স্পিরিট’ ব্যবহার করে ছয়টি GBU-57 ‘Massive Ordnance Penetrator’ (MOP) বাঙ্কার বাস্টার বোমা ফেলা হয়। প্রতিটি বোমার ওজন ১৩,৬০০ কেজি এবং এগুলো ৬০ মিটার (প্রায় ২০০ ফুট) পুরু কংক্রিট বা পাথরের নিচে বিস্ফোরণ ঘটাতে সক্ষম। ফলে ফোর্ডো’র মতো পাহাড়ের নিচে থাকা কেন্দ্রও সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়।
নিখুঁত লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত
‘B-2 স্পিরিট’ অত্যাধুনিক জিপিএস-নির্ভর প্রযুক্তি এবং অটোমেশন সিস্টেমের মাধ্যমে নির্ভুলভাবে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানে। দুইজন পাইলটের ক্রু নিয়ে পরিচালিত এই বিমানগুলো একসঙ্গে একাধিক লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে, যা এই অভিযানে সফলভাবে প্রমাণিত হয়েছে।
কেন ‘B-2 স্পিরিট’ ছিল এই অভিযানের জন্য অপরিহার্য?
সুরক্ষিত ও গভীর কেন্দ্র ধ্বংসে অনন্য
ইরানের পরমাণুকেন্দ্রগুলো পাহাড়ের নিচে, পুরু কংক্রিটের আবরণে নির্মিত—যা সাধারণ বোমা বা ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে ধ্বংস করা সম্ভব নয়। ‘B-2 স্পিরিট’ স্টেলথ প্রযুক্তি ও বাঙ্কার বাস্টার বোমার সংমিশ্রণে গভীর ভূগর্ভস্থ লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানার জন্য আদর্শ।
শত্রু প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ফাঁকি
ইরানের উন্নত আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও, ‘B-2 স্পিরিট’ প্রায় অদৃশ্য থেকে প্রবেশ করতে পারে। ফলে শত্রুপক্ষের প্রতিরোধ গড়ে তোলার আগেই হামলা সম্পন্ন হয়।
অভিযান-পরবর্তী প্রতিক্রিয়া ও বৈশ্বিক বার্তা
এই অভিযানের পর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প জানান, “Fordow is gone”—অর্থাৎ ইরানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরমাণুকেন্দ্রটি আর নেই। মার্কিন সামরিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই অভিযান যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত সক্ষমতার এক অনন্য প্রদর্শনী। এটি শুধু ইরান নয়, বিশ্বের যেকোনো দেশের জন্যই একটি সতর্কবার্তা—যুক্তরাষ্ট্র চাইলে পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে, যেকোনো সুরক্ষিত স্থাপনা ধ্বংস করতে সক্ষম।
B-2 স্পিরিট (B-2 Spirit): প্রযুক্তিগত বৈশিষ্ট্য এক নজরে
বৈশিষ্ট্যতথ্যনির্মাতানর্থরপ গ্রুম্যানমোট সংখ্যা২১টিএকক মূল্য২.১ বিলিয়ন ডলারসর্বোচ্চ পাল্লা১১,১১২ কিমি (৬,০০০ নটিক্যাল মাইল)সর্বোচ্চ অস্ত্রবহন৪০,০০০ পাউন্ড (১৮,১৪৪ কেজি)স্টেলথ প্রযুক্তিরাডার-শোষণকারী উপাদান ও ডিজাইনক্রু২ জন পাইলটপ্রধান অস্ত্রGBU-57 MOP, JDAM, JASSM-ER
ইরানের পরমাণুকেন্দ্রে ‘B-2 স্পিরিট’-এর এই সফল অভিযান আধুনিক যুদ্ধের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় রচনা করেছে। স্টেলথ প্রযুক্তি, দূরপাল্লার ক্ষমতা, এবং বিধ্বংসী অস্ত্রবহনের সমন্বয়ে ‘B-2 স্পিরিট’ আজকের দিনে বিশ্বের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ও কার্যকর বোমারু বিমান। এই অভিযান প্রমাণ করেছে—গোপন প্রযুক্তি ও আধুনিক অস্ত্রের যুগে, নিরাপত্তার সংজ্ঞা প্রতিনিয়ত বদলে যাচ্ছে। ‘B-2 স্পিরিট’ (B-2 Spirit) এখন শুধু যুক্তরাষ্ট্রের নয়, গোটা বিশ্বের সামরিক কৌশলের অন্যতম আলোচিত নাম।