স্টাফ রিপোর্টার
১৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮:০১ পূর্বাহ্ণ
অনলাইন সংস্করণ

বাবরের হাতিশাল: মুঘল সম্রাটের রহস্যময় অবদান বর্ধমানের এক গ্রামে!

Mughal heritage in Bardhaman:n বর্ধমান জেলার একটি ছোট্ট গ্রাম হাতিশাল, যা মুঘল সম্রাট বাবরের নামের সাথে জড়িত। এই গ্রামের নামকরণের পিছনে একটি রোমাঞ্চকর ইতিহাস রয়েছে, যা শতাব্দী ধরে মানুষের মনে কৌতূহল সৃষ্টি করে আসছে। বাবরের হাতিশাল নামটি শুনলেই মনে হয় যে এখানে হয়তো বাবরের হাতির শালা বা আস্তাবল ছিল। কিন্তু আসল ইতিহাস কি তাই?গ্রামটি বর্ধমান জেলার কাটোয়া মহকুমার অন্তর্গত কেতুগ্রাম থানার অধীনে অবস্থিত। এটি কাটোয়া শহর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। হাতিশাল গ্রামের জনসংখ্যা প্রায় ৫,০০০ জন।

এখানকার অধিকাংশ মানুষ কৃষিকাজের সাথে জড়িত।ইতিহাসের পাতা ঘাঁটলে জানা যায়, ১৫২৬ সালে পানিপথের প্রথম যুদ্ধে জয়লাভের পর বাবর ভারতে মুঘল সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপন করেন। তিনি দিল্লি থেকে বাংলার দিকে অভিযান চালানোর সময় এই অঞ্চল দিয়ে যাতায়াত করেছিলেন। সেই সময় তিনি এই গ্রামে কিছুদিন অবস্থান করেছিলেন বলে স্থানীয় কিংবদন্তি রয়েছে।বাবরের হাতিশাল নামকরণের পিছনে দুটি তত্ত্ব রয়েছে। প্রথম তত্ত্ব অনুযায়ী, বাবর যখন এই অঞ্চলে এসেছিলেন, তখন তাঁর সেনাবাহিনীর হাতিগুলোকে রাখার জন্য এখানে একটি বিশাল শালা বা আস্তাবল নির্মাণ করা হয়েছিল। সেই থেকেই এই জায়গাটি হাতিশাল নামে পরিচিত হয়ে ওঠে।দ্বিতীয় তত্ত্বটি একটু ভিন্ন। এই তত্ত্ব অনুসারে, বাবর যখন এই অঞ্চলে এসেছিলেন, তখন তিনি এখানে একটি বিশাল শাল গাছের নীচে বিশ্রাম নিয়েছিলেন। সেই গাছটি এত বড় ছিল যে একটি হাতি সহজেই তার নীচে দাঁড়াতে পারত। এই কারণে স্থানীয় লোকেরা জায়গাটিকে ‘হাতির শাল’ বলে ডাকত, যা পরবর্তীতে হাতিশালে রূপান্তরিত হয়।যাই হোক না কেন, বাবরের হাতিশাল নামটি এখন ইতিহাসের অংশ হয়ে গেছে। এই গ্রামটি এখন একটি ঐতিহাসিক স্থান হিসেবে পরিচিত। প্রতি বছর বহু পর্যটক এই গ্রাম পরিদর্শন করে থাকেন।

গ্রামের মধ্যে একটি প্রাচীন মসজিদ রয়েছে, যা বাবরের সময়কালের বলে মনে করা হয়। এছাড়াও একটি পুরনো দীঘি রয়েছে, যা বাবরের সৈন্যদের জন্য খনন করা হয়েছিল বলে স্থানীয়রা বিশ্বাস করেন।হাতিশাল গ্রামের অর্থনীতি মূলত কৃষিভিত্তিক। এখানে ধান, পাট, আলু ও সবজি চাষ করা হয়। গ্রামের কিছু মানুষ কুটির শিল্পের সাথেও জড়িত। তাঁতশিল্প এখানকার একটি উল্লেখযোগ্য কুটির শিল্প। এছাড়া মৃৎশিল্পও এখানে জনপ্রিয়।বাবরের হাতিশাল শুধু একটি ঐতিহাসিক স্থান নয়, এটি বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যেরও একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এখানে প্রতি বছর বাবরের স্মৃতিতে একটি মেলার আয়োজন করা হয়। এই মেলায় স্থানীয় শিল্পীরা তাদের হস্তশিল্প প্রদর্শন করেন এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।গ্রামটির শিক্ষা ব্যবস্থাও উল্লেখযোগ্য। এখানে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় রয়েছে।

এছাড়া একটি মাদ্রাসাও রয়েছে, যেখানে ইসলামি শিক্ষার পাশাপাশি আধুনিক শিক্ষাও দেওয়া হয়।বাবরের হাতিশাল গ্রামের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল এখানকার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি। হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ এখানে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করে। উভয় সম্প্রদায়ের লোকেরা একে অপরের ধর্মীয় উৎসবে অংশগ্রহণ করে থাকেন।গ্রামটির প্রাকৃতিক সৌন্দর্যও উল্লেখযোগ্য। এখানে বেশ কয়েকটি পুকুর রয়েছে, যেগুলো গ্রামের জলজ পরিবেশকে সমৃদ্ধ করেছে। এছাড়া গ্রামের চারপাশে সবুজ ধানক্ষেত ও বাগান রয়েছে, যা গ্রামটিকে একটি মনোরম পরিবেশ দান করেছে।বর্তমানে বাবরের হাতিশাল গ্রামটি পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে বিকশিত হচ্ছে। স্থানীয় প্রশাসন এখানে পর্যটন সুবিধা বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে। একটি পর্যটন কেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছে, যেখানে বাবর ও মুঘল সাম্রাজ্যের ইতিহাস সম্পর্কে তথ্য প্রদর্শন করা হবে।

গ্রামের যুব সমাজও এখন শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের জন্য আগ্রহী হয়ে উঠেছে। অনেকে উচ্চশিক্ষার জন্য কাটোয়া বা বর্ধমান শহরে যাচ্ছেন। কিছু যুবক কৃষি ব্যবসায় নতুন প্রযুক্তি প্রয়োগ করছেন, যা গ্রামের অর্থনীতিকে আরও শক্তিশালী করছে।বাবরের হাতিশাল গ্রামের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সংরক্ষণের জন্য স্থানীয় সরকার ও বেসরকারি সংস্থাগুলি বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। গ্রামের প্রাচীন স্থাপত্যগুলি সংরক্ষণ করা হচ্ছে এবং একটি ছোট জাদুঘর স্থাপনের পরিকল্পনা করা হয়েছে, যেখানে বাবরের সময়কালের বিভিন্ন নিদর্শন প্রদর্শিত হবে।গ্রামের মহিলারাও এখন বিভিন্ন আত্মনির্ভরশীল প্রকল্পে যুক্ত হচ্ছেন। স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মাধ্যমে তারা হস্তশিল্প, মৎস্যচাষ, মুরগি পালন ইত্যাদি কাজে নিযুক্ত হচ্ছেন। এটি গ্রামের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।বাবরের হাতিশাল গ্রামের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল বলে মনে করা হচ্ছে। গ্রামটি ধীরে ধীরে একটি আধুনিক গ্রামে পরিণত হচ্ছে, যেখানে ঐতিহ্য ও আধুনিকতার সমন্বয় ঘটছে।

স্থানীয় প্রশাসন গ্রামের অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নিয়েছে। রাস্তাঘাট উন্নত করা হচ্ছে, বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা হচ্ছে এবং স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা উন্নত করা হচ্ছে।সামগ্রিকভাবে, বাবরের হাতিশাল একটি অনন্য গ্রাম, যেখানে ইতিহাস, ঐতিহ্য ও আধুনিকতার সংমিশ্রণ ঘটেছে। এই গ্রামটি শুধু বর্ধমান জেলার নয়, সমগ্র পশ্চিমবঙ্গের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। বাবরের স্মৃতি বহনকারী এই গ্রামটি আগামী দিনে আরও বেশি পর্যটক ও গবেষকদের আকর্ষণ করবে বলে আশা করা যাচ্ছে।

মন্তব্য করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ইউনুসের ‘নতুন’ বাংলাদেশে ধর্ষণের ঊর্ধ্বগতি: রাজপথে প্রতিবাদের ঝড় ছাত্রদের

ভারতে ইন্টারনেট বিপ্লবের নতুন দিগন্ত: স্টারলিঙ্কের সঙ্গে এয়ারটেলের ঐতিহাসিক চুক্তি

অস্ত্র আমদানির দৌড়ে শীর্ষে ইউক্রেন, ভারতের স্থান দ্বিতীয়: বিশ্বে কী বার্তা?

মুসলিম ভোট ব্যাঙ্কে নজর! বঙ্গের সব আসনে লড়তে প্রস্তুত আইএমআইএম

হোলির রঙে ব্যাঙ্ক বন্ধ: আগামীকাল থেকে টানা ৪ দিন ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে ব্যাঙ্ক ছুটি, তালিকা দেখে নিন

কেকেআরের প্রস্তুতি শুরু: কলকাতায় নাইটদের ক্যাপ্টেন-কোচের সঙ্গে প্রকাশিত হল প্র্যাক্টিস সূচি

শিক্ষামন্ত্রীর বাড়ির সামনে ‘ক্রিমিনাল’ পোস্টার: সিপিএম নেতার থানায় তলব!

কলকাতার Zakaria Street-এর মাস্ট ভিজিট ফুড স্টল: একটি খাদ্যপ্রেমীর স্বর্গভূমি

অলক্ষ্যে ঋত্বিক: ঋত্বিক ঘটকের জীবনালেখ্য নিয়ে আসছে বাঙালির প্রতীক্ষিত চলচ্চিত্র

আইপিএল-এ তামাকের বিজ্ঞাপন বন্ধ! স্বাস্থ্যমন্ত্রকের কড়া নির্দেশ জারি!

১০

দেওয়ালের কোন দিকে কোন রঙ শুভ? বাস্তুশাস্ত্রের চোখে একটি গভীর দৃষ্টিপাত

১১

ডিএলএফ-এমআরএফ-আমূল-পেটিএম: সংক্ষিপ্ত নামেই ভারত বিখ্যাত, এবার জেনে নিন এই ব্র্যান্ডগুলোর পুরো নাম!

১২

সেক্সসমনিয়া: ঘুমের মধ্যে লুকিয়ে থাকা এক বিরল রহস্য

১৩

ভীষণ ক্ষতিকর Non-Stick প্যানে রান্না করছেন না তো? জেনে নিন সেরা বিকল্পগুলো

১৪

কাক ডাকার ফলাফল: ইসলাম ও হিন্দু শাস্ত্রে কী বলা আছে?

১৫

দিনে ৮ ঘণ্টা AC চালালে মাসে কত ‘Electric Bill’ আসবে? সহজ হিসেবে নিশ্চিন্তে থাকুন

১৬

প্রাক্তনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা কি বুদ্ধিমানের কাজ? একটি গভীর বিশ্লেষণ

১৭

চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জয়ের জাদু: কীভাবে ভারত হয়ে উঠল অপ্রতিরোধ্য?

১৮

বাংলার প্রথম এসি লোকাল ট্রেন শিয়ালদা-কৃষ্ণনগর রুটে, ভাড়া কত জানেন?

১৯

ভারতে রাজ্যভিত্তিক হীরার মজুদ: কোন রাজ্য হীরা উৎপাদনে সেরা?

২০
close