কেন্দ্রীয় সরকার বাংলা ভাষাকে ধ্রুপদী ভাষার মর্যাদা দিয়েছে। ৩ অক্টোবর ২০২৪ তারিখে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বাংলার পাশাপাশি মারাঠি, পালি, প্রাকৃত এবং অসমীয়া ভাষাকেও ধ্রুপদী ভাষার মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। এর ফলে ভারতের ধ্রুপদী ভাষার সংখ্যা ৬ থেকে বেড়ে ১১ হলো।
কেন্দ্রীয় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব জানিয়েছেন, “প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সবসময় ভারতীয় ভাষাগুলির উপর গুরুত্ব দিয়েছেন। আজ ৫টি ভাষা – মারাঠি, পালি, প্রাকৃত, অসমীয়া এবং বাংলাকে ধ্রুপদী ভাষার মর্যাদা দেওয়া হয়েছে।” তিনি আরও বলেন, “এর আগে তামিল, সংস্কৃত, তেলুগু, কন্নড়, মালায়ালম এবং ওড়িয়া ভাষা ধ্রুপদী ভাষার মর্যাদা পেয়েছিল। সরকার এই ধ্রুপদী ভাষাগুলির সংরক্ষণ ও প্রচারের জন্য নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে।”
ভারত সরকার ২০০৪ সালের ১২ অক্টোবর “ধ্রুপদী ভাষা” শ্রেণি প্রবর্তন করে। প্রথমে তামিল ভাষাকে এই মর্যাদা দেওয়া হয়। পরে ২০০৫ সালে সংস্কৃত, ২০০৮ সালে কন্নড় ও তেলুগু, ২০১৩ সালে মালায়ালম এবং ২০১৪ সালে ওড়িয়া ভাষা এই তালিকায় যুক্ত হয়।
একটি ভাষাকে ধ্রুপদী হিসেবে বিবেচনা করার জন্য কয়েকটি মানদণ্ড রয়েছে। যেমন – ১৫০০-২০০০ বছরের প্রাচীন ইতিহাস ও সাহিত্য ঐতিহ্য থাকতে হবে, প্রাচীন গ্রন্থের একটি উল্লেখযোগ্য সংগ্রহ থাকতে হবে যা আজও মূল্যবান বলে বিবেচিত হয়, স্বতন্ত্র সাহিত্যিক ঐতিহ্য থাকতে হবে যা অন্য কোনো ভাষা থেকে উদ্ভূত নয়। এছাড়াও ধ্রুপদী ভাষা ও সাহিত্যের সঙ্গে আধুনিক রূপের মধ্যে একটি বিচ্ছিন্নতা থাকতে পারে।
শব্দের জাদুকর: নবারুণ ভট্টাচার্যের কবিতায় বাঙালি জীবনের প্রতিচ্ছবি
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন। তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম X-এ লিখেছেন, “আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি যে ভারত সরকার অবশেষে বাংলা ভাষাকে ধ্রুপদী ভাষার মর্যাদা দিয়েছে। আমরা কেন্দ্রীয় সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের কাছে এই স্বীকৃতি আদায়ের চেষ্টা করছিলাম এবং আমাদের দাবির সমর্থনে তিন খণ্ডে গবেষণার ফলাফল জমা দিয়েছিলাম।”
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন। তিনি X-এ লিখেছেন, “আমি খুবই আনন্দিত যে মহান বাংলা ভাষাকে ধ্রুপদী ভাষার মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। এটি বাংলা ভাষার সমৃদ্ধ ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক গুরুত্বের প্রতি একটি উপযুক্ত স্বীকৃতি। এই সিদ্ধান্ত বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উন্নয়নে একটি নতুন অধ্যায় সূচনা করবে।”
বাংলা ভাষার ইতিহাস অত্যন্ত প্রাচীন। ৭ম শতাব্দী থেকে বাংলা ভাষার উদ্ভব হয়েছে বলে মনে করা হয়। ১১শ শতাব্দী থেকে বাংলা সাহিত্যের নিদর্শন পাওয়া যায়। চর্যাপদ হল বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন। এরপর থেকে বাংলা সাহিত্য ক্রমাগত সমৃদ্ধ হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কাজী নজরুল ইসলাম প্রমুখ সাহিত্যিকরা বাংলা সাহিত্যকে বিশ্বদরবারে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
ধ্রুপদী ভাষার মর্যাদা পাওয়ার ফলে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের গবেষণা ও উন্নয়নের জন্য বিশেষ সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যাবে। সরকার এই ভাষাগুলির জন্য বিশেষ অনুদান দেয়। প্রতি বছর ধ্রুপদী ভারতীয় ভাষায় উৎকৃষ্ট পণ্ডিতদের জন্য দুটি আন্তর্জাতিক পুরস্কার দেওয়া হয়। এছাড়া ধ্রুপদী ভাষা অধ্যয়নের জন্য একটি উৎকর্ষ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে প্রফেশনাল চেয়ার প্রতিষ্ঠা করা হয়।
অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা অসমীয়া ভাষাকে ধ্রুপদী মর্যাদা দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভাকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। তিনি X-এ লিখেছেন, “অসমের জনগণের পক্ষ থেকে আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদিজি এবং সমগ্র কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভাকে অসমীয়া ভাষাকে ধ্রুপদী ভাষার মর্যাদা দেওয়ার ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তের জন্য কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। অসমীয়া এখন এই মর্যাদা পাওয়া নির্বাচিত ভাষাগুলির মধ্যে যুক্ত হলো।”
মস্তিষ্কের মহাকাব্য: আপনার সন্তানের প্রতিভা বিকাশের ১০টি অমোঘ কৌশল
মহারাষ্ট্রের উপমুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফড়নবিস মারাঠি ভাষাকে ধ্রুপদী মর্যাদা দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, “এটা একটি সোনালি দিন। মহারাষ্ট্রের ১২ কোটি মানুষের পক্ষ থেকে আমি এই সিদ্ধান্তের জন্য প্রধানমন্ত্রী মোদিকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।”
ভাষাবিদরা মনে করেন, ধ্রুপদী ভাষার মর্যাদা পাওয়ার ফলে এই ভাষাগুলির গবেষণা ও উন্নয়নের জন্য নতুন সুযোগ সৃষ্টি হবে। বিশেষ করে শিক্ষা ও গবেষণা ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে। এছাড়া এই ভাষাগুলির প্রাচীন গ্রন্থ সংরক্ষণ, নথিভুক্তকরণ ও ডিজিটাইজেশনের কাজে আর্কাইভিং, অনুবাদ, প্রকাশনা ও ডিজিটাল মিডিয়ার ক্ষেত্রে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।
সরকারি বিবৃতি অনুযায়ী, এই সিদ্ধান্তের ফলে মূলত মহারাষ্ট্র (মারাঠি), বিহার, উত্তর প্রদেশ ও মধ্যপ্রদেশ (পালি ও প্রাকৃত), পশ্চিমবঙ্গ (বাংলা) এবং অসম (অসমীয়া) উপকৃত হবে। তবে এর সাংস্কৃতিক ও শিক্ষাগত প্রভাব জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিস্তৃত হবে।
সামগ্রিকভাবে, বাংলাসহ পাঁচটি ভাষাকে ধ্রুপদী মর্যাদা দেওয়ার এই সিদ্ধান্ত ভারতের ভাষা বৈচিত্র্য ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতি সরকারের শ্রদ্ধা ও গুরুত্বের প্রতিফলন। এর ফলে এই ভাষাগুলির সংরক্ষণ ও উন্নয়নের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নেও ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে আশা করা হচ্ছে।
বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে এই স্বীকৃতি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ বাংলা ভাষা শুধু ভারতেই নয়, বাংলাদেশের জাতীয় ভাষা এবং বিশ্বের সপ্তম সর্বাধিক কথিত ভাষা। প্রায় ২৬ কোটি মানুষ বাংলায় কথা বলেন। বাংলা ভাষার সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিশ্বের দরবারে সম্মানিত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেনের মতো চলচ্চিত্র নির্মাতারা বাংলা চলচ্চিত্রকে আন্তর্জাতিক খ্যাতি এনে দিয়েছেন।
বাংলা ভাষার প্রাচীনত্ব ও ঐতিহ্য সম্পর্কে ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, “বাংলা ভাষার জন্ম হয়েছে খ্রিস্টীয় ৬ষ্ঠ-৭ম শতাব্দীতে। তখন থেকে এই ভাষা ক্রমাগত বিকশিত হয়েছে। ১১শ শতাব্দীর চর্যাপদ থেকে শুরু করে আধুনিক যুগ পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের ধারাবাহিক ইতিহাস রয়েছে।”
বাংলা ভাষার বিকাশের ইতিহাস বিশ্লেষণ করে ভাষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছেন, “বাংলা ভাষার বিকাশ মূলত তিনটি পর্যায়ে হয়েছে – প্রাচীন বাংলা (৯৫০-১৩৫০ খ্রিস্টাব্দ), মধ্য বাংলা (১৩৫০-১৮০০ খ্রিস্টাব্দ) এবং আধুনিক বাংলা (১৮০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে বর্তমান)।”
বাংলা ভাষার ধ্রুপদী মর্যাদা পাওয়ার ফলে এই ভাষার গবেষণা ও উন্নয়নের জন্য নতুন সুযোগ সৃষ্টি হবে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এর ফলে নিম্নলিখিত ক্ষেত্রগুলিতে উল্লেখযোগ্য প্রভাব পড়বে:
১. গবেষণা ও শিক্ষা: বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উপর উচ্চতর গবেষণার জন্য বিশেষ অনুদান পাওয়া যাবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উপর নতুন গবেষণা কেন্দ্র স্থাপিত হবে।
২. প্রাচীন গ্রন্থ সংরক্ষণ: বাংলা ভাষার প্রাচীন পাণ্ডুলিপি ও গ্রন্থ সংরক্ষণের জন্য বিশেষ প্রকল্প গ্রহণ করা হবে। এর ফলে হারিয়ে যাওয়া অনেক মূল্যবান গ্রন্থ পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হবে।
৩. ডিজিটাইজেশন: বাংলা ভাষার প্রাচীন ও আধুনিক গ্রন্থগুলি ডিজিটাল ফরম্যাটে রূপান্তরিত করা হবে। এর ফলে এই গ্রন্থগুলি সহজে সংরক্ষণ ও বিতরণ করা যাবে।
৪. অনুবাদ: বাংলা থেকে অন্যান্য ভাষায় এবং অন্যান্য ভাষা থেকে বাংলায় অনুবাদের কাজ বৃদ্ধি পাবে। এর ফলে বাংলা সাহিত্য আন্তর্জাতিক পাঠকদের কাছে পৌঁছাবে।
৫. ভাষা প্রযুক্তি: বাংলা ভাষার জন্য নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনের সুযোগ সৃষ্টি হবে। যেমন – স্পিচ রিকগনিশন, মেশিন ট্রান্সলেশন, ন্যাচারাল ল্যাঙ্গুয়েজ প্রসেসিং ইত্যাদি।
৬. সাংস্কৃতিক বিনিময়: বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রচার ও প্রসারের জন্য আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নতুন সুযোগ সৃষ্টি হবে।
৭. কর্মসংস্থান: ভাষা গবেষণা, অনুবাদ, প্রকাশনা, ডিজিটাল মিডিয়া ইত্যাদি ক্ষেত্রে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।
বাংলা ভাষার এই স্বীকৃতি নিয়ে বিশিষ্ট সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেছেন, “বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জন্য এটা একটা বড় পাওনা। এর ফলে আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি নতুন করে মনোযোগ আকর্ষিত হবে। তবে এই স্বীকৃতির সাথে সাথে আমাদের দায়িত্বও বেড়েছে। আমাদের ভাষা ও সাহিত্যকে আরও সমৃদ্ধ করতে হবে।”
বিশিষ্ট ভাষাবিদ ড. পবিত্র সরকার মন্তব্য করেছেন, “বাংলা ভাষার ধ্রুপদী মর্যাদা পাওয়া একটি যুগান্তকারী ঘটনা। এর ফলে বাংলা ভাষার গবেষণা ও উন্নয়নের জন্য নতুন সুযোগ সৃষ্টি হবে। বিশেষ করে প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের উপর গবেষণা, বাংলা ভাষার ঐতিহাসিক বিবর্তন, উপভাষা চর্চা ইত্যাদি ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে।”
তবে এই স্বীকৃতির পাশাপাশি কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। যেমন:
১. অর্থায়ন: ধ্রুপদী ভাষার মর্যাদা পাওয়ার পর এই ভাষার উন্নয়নের জন্য পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ করা।
২. দক্ষ জনবল: বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উপর উচ্চতর গবেষণার জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যক দক্ষ গবেষক তৈরি করা।
৩. প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জ: বাংলা ভাষার জন্য আধুনিক প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও প্রয়োগ।
৪. আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি: বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আরও বেশি পরিচিত করা।
৫. ভাষা সংরক্ষণ: বাংলা ভাষার বিভিন্ন উপভাষা ও আঞ্চলিক রূপগুলি সংরক্ষণ করা।
সামগ্রিকভাবে, বাংলা ভাষার ধ্রুপদী মর্যাদা পাওয়া একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। এর ফলে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উন্নয়ন ও প্রসারের জন্য নতুন সুযোগ সৃষ্টি হবে। তবে এই সুযোগকে কাজে লাগাতে হলে সরকার, শিক্ষাবিদ, গবেষক ও সাধারণ মানুষকে একযোগে কাজ করতে হবে। বাংলা ভাষার সমৃদ্ধ ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ করার পাশাপাশি এই ভাষাকে আধুনিক যুগের উপযোগী করে তোলার চ্যালেঞ্জ রয়েছে। আশা করা যায়, এই স্বীকৃতির ফলে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নতুন উচ্চতায় পৌঁছাবে এবং বিশ্ব দরবারে আরও সম্মানিত হবে