বাংলাদেশের রাজনীতিতে ছাত্রলীগের নাম একটি উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো। কিন্তু সেই নক্ষত্র কি আজ ধূসর হয়ে যাচ্ছে? স্বাধীনতা সংগ্রামের অগ্রদূত থেকে শুরু করে বর্তমানের বিতর্কিত অবস্থান – এই দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় ছাত্রলীগের উত্থান-পতনের গল্প যেন বাংলাদেশের রাজনীতির এক জীবন্ত ইতিহাস। আজ আমরা সেই ইতিহাসের পাতা উল্টে দেখব, কীভাবে একটি মহান আদর্শ নিয়ে যাত্রা শুরু করা সংগঠন আজ নানা প্রশ্নের মুখোমুখি হচ্ছে।
ছাত্রলীগের জন্ম: স্বাধীনতার স্বপ্ন
১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি, পাকিস্তান আমলে জন্ম নেয় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ। পরবর্তীতে এই সংগঠনই বাংলাদেশ ছাত্রলীগ নামে পরিচিত হয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে এই সংগঠন বাঙালি জাতির মুক্তির স্বপ্ন বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
স্বাধীনতা সংগ্রামে ছাত্রলীগের অবদান:
– ১৯৫২: ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ
– ১৯৬৬: ৬ দফা আন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদান
– ১৯৬৯: গণঅভ্যুত্থানে মূল চালিকাশক্তি
– ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ ও সমর্থন
স্বাধীনতা-উত্তর কাল: নতুন চ্যালেঞ্জ
স্বাধীনতার পর ছাত্রলীগ নতুন বাংলাদেশ গঠনে মনোনিবেশ করে। কিন্তু ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর শাহাদাতের পর সংগঠনটি বড় ধাক্কা খায়। পরবর্তী সময়ে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে ছাত্রলীগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে ছাত্রলীগের ভূমিকা:
– ১৯৮৩: একুশে ফেব্রুয়ারি আন্দোলন
– ১৯৯০: এরশাদ বিরোধী আন্দোলন
নব্বইয়ের দশক: পুনরুজ্জীবন ও নতুন চ্যালেঞ্জ
১৯৯১ সালে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার পর ছাত্রলীগ নতুন করে সংগঠিত হয়। কিন্তু এই সময় থেকেই সংগঠনটির ভাবমূর্তিতে ভাটা পড়তে শুরু করে।
বিতর্কিত ঘটনাবলী:
– ক্যাম্পাসে সহিংসতা ও হল দখল
– অবৈধ টোল আদায়
– পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁস
২০০৯-বর্তমান: ক্ষমতার মোহ
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর ছাত্রলীগের প্রভাব ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। কিন্তু এই প্রভাবের সাথে সাথে বাড়তে থাকে নানা অভিযোগও।
বিতর্কিত কর্মকাণ্ড:
– শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ
– টেন্ডারবাজি ও চাঁদাবাজি
– সরকারি প্রকল্পে অবৈধ কমিশন আদায়
– বিরোধী মতের উপর হামলা
ছাত্রলীগের বর্তমান অবস্থা: পরিসংখ্যানে
বিষয় | সংখ্যা/তথ্য |
---|---|
সদস্য সংখ্যা | প্রায় ২৫ লক্ষ |
শাখা সংখ্যা | ৬৪ জেলা + ৪৯২ উপজেলা |
বিশ্ববিদ্যালয় কমিটি | ৪৬টি |
কলেজ কমিটি | ২৭০০+ |
ছাত্রলীগের বাড়বাড়ন্তের কারণ
১. রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা:
আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতায় থাকার কারণে ছাত্রলীগ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সুবিধা ভোগ করছে।
২. প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা:
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে স্বাধীন ছাত্র সংসদ না থাকায় ছাত্রলীগের প্রভাব বৃদ্ধি পেয়েছে।
৩.আর্থিক লোভ:
সরকারি প্রকল্প ও টেন্ডারে অবৈধ সুবিধা পাওয়ার সুযোগ অনেককে ছাত্রলীগে যোগ দিতে উৎসাহিত করেছে।
৪. কর্মসংস্থানের অভাব:
বেকারত্বের কারণে অনেকে রাজনৈতিক সুবিধা পাওয়ার আশায় ছাত্রলীগে যোগ দিচ্ছে।
৫. দায়মুক্তির সংস্কৃতি:
ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলেও শাস্তি না হওয়ায় দায়মুক্তির সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে।
ছাত্রলীগের বাড়বাড়ন্তের প্রভাব
ইতিবাচক প্রভাব:
– সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ (যেমন: রক্তদান শিবির, বৃক্ষরোপণ)
– দুর্যোগ মোকাবেলায় স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ
– শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উন্নয়নমূলক কাজে অংশগ্রহণ
নেতিবাচক প্রভাব:
– শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শান্ত পরিবেশ নষ্ট
– মেধাবী শিক্ষার্থীদের রাজনীতি বিমুখ হওয়া
– সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়
– আইনের শাসনের প্রতি অবজ্ঞা
সমাধানের উপায়
১. স্বাধীন ছাত্র সংসদ নির্বাচন:
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত ও নিরপেক্ষ ছাত্র সংসদ নির্বাচন আয়োজন।
২. রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ:
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সরাসরি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করা।
৩. আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা:
অপরাধীদের দলীয় পরিচয় নির্বিশেষে শাস্তি নিশ্চিত করা।
৪. মূল্যবোধ শিক্ষা:
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নৈতিকতা ও মূল্যবোধ শিক্ষার উপর জোর দেওয়া।
৫. কর্মসংস্থান সৃষ্টি:
যুব সমাজের জন্য পর্যাপ্ত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে শুরু করে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার – প্রতিটি ঐতিহাসিক মুহূর্তে ছাত্রলীগের অবদান অনস্বীকার্য। কিন্তু বর্তমানে সংগঠনটির যে অবস্থা, তা নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক। ছাত্রলীগকে তার মূল আদর্শে ফিরে যেতে হবে। শুধু ক্ষমতার মোহ নয়, দেশপ্রেম ও মানবতাবোধই হোক তাদের মূল চালিকাশক্তি। তবেই ছাত্রলীগ আবার হয়ে উঠবে দেশের যুব সমাজের প্রেরণার উৎস।
আজ যদি বঙ্গবন্ধু জীবিত থাকতেন, তিনি কি এই ছাত্রলীগকে দেখে গর্বিত হতেন? এই প্রশ্নটি প্রতিটি ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীকে ভাবিয়ে তুলুক। কারণ তাদের হাতেই রয়েছে ছাত্রলীগের ভবিষ্যৎ, আর ছাত্রলীগের ভবিষ্যতের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ।