সেনা পাহারায় বাংলাদেশের দুর্গাপুজো: ভয়ে কাঁপছে সংখ্যালঘুরা, উৎসবের আনন্দ নিস্তেজ!

বাংলাদেশে এবার দুর্গাপুজোর আয়োজন হচ্ছে অভূতপূর্ব নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যে। গত অগাস্টে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর হামলার ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় এবারের পুজো উদযাপন হচ্ছে আতঙ্কের মধ্যে।…

Avatar

 

বাংলাদেশে এবার দুর্গাপুজোর আয়োজন হচ্ছে অভূতপূর্ব নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যে। গত অগাস্টে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর হামলার ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় এবারের পুজো উদযাপন হচ্ছে আতঙ্কের মধ্যে। সেনাবাহিনীর কড়া নজরদারি ও পুলিশি পাহারার মধ্যেও হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে রয়েছে গভীর উদ্বেগ ও আশঙ্কা।

গত ৯ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া দুর্গাপুজো চলবে ১৩ অক্টোবর পর্যন্ত। কিন্তু এবারের উৎসব আগের বছরগুলোর মতো আনন্দঘন হচ্ছে না। সরকারি হিসাবে এবার বাংলাদেশে ৩২,৬৬৬টি পুজো মণ্ডপ স্থাপন করা হয়েছে, যা গত বছরের তুলনায় সামান্য বেশি। কিন্তু অনেক জায়গায় পুজো কমিটিগুলো হুমকি ও চাঁদাবাজির শিকার হচ্ছে।

বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের (BHBCUC) হিসাবে, গত ৫ অগাস্ট থেকে ২০ অগাস্টের মধ্যে দেশজুড়ে হিন্দুদের উপর ২,০১০টি হামলার ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে রয়েছে হত্যা, শারীরিক নির্যাতন, যৌন নিপীড়ন এবং মন্দিরে হামলার মতো ঘটনা। এই পরিস্থিতিতে অনেক পুজো কমিটি এবার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বাতিল করে শুধুমাত্র ধর্মীয় রীতি পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের হিন্দুদের উপর বাড়ছে হামলা, উদ্বেগ প্রকাশ ছাত্রছাত্রীদের

BHBCUC-এর একজন সদস্য রঞ্জন কর্মকার জানিয়েছেন, “এবার আমরা শুধু দুর্গাপুজোর আয়োজন করছি, কোনো উৎসব করছি না। এটা হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতিবাদের একটি রূপ। আগস্ট থেকে আমাদের সম্প্রদায়ের উপর যে ক্রমাগত হামলা হচ্ছে, তার পর হিন্দুরা কোনো উৎসবে অংশ নেওয়ার মানসিকতায় নেই।”

অনেক জায়গায় পুজো কমিটিগুলো বেনামি চিঠি পেয়েছে যেখানে ৩ থেকে ৫ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করা হয়েছে। এই টাকা না দিলে পুজো বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়েছে। এছাড়া কয়েকটি জায়গায় দুর্গা প্রতিমা ভাঙচুর এবং দান বাক্স লুটের ঘটনাও ঘটেছে।

সরকার অবশ্য পুজো উপলক্ষে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দিয়েছে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মোঃ জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী জানিয়েছেন, পুজো মণ্ডপগুলোতে সশস্ত্র বাহিনীর টহল, সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন এবং বিশেষ নজরদারি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

কিন্তু সরকারের এই আশ্বাস সত্ত্বেও হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে উদ্বেগ কাটছে না। BHBCUC-এর নেতা কাজল দেবনাথ বলেছেন, “সরকার শুধু এই পাঁচদিনের জন্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করছে কেন? বাকি ৩৬০ দিনের কী হবে? হিন্দুরাও তো বাংলাদেশের নাগরিক, তাদের ভয় ও আতঙ্ক ছাড়া বাঁচার অধিকার আছে।”

বর্তমান পরিস্থিতিতে অনেক হিন্দু পরিবার নিরাপত্তার অভাবে বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছে। কয়েকটি জেলায় হিন্দুদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান লুট ও ভাঙচুরের খবরও পাওয়া গেছে। এই পরিস্থিতিতে পুজো উদযাপনের জন্য অনেক পরিবার এবার বাড়িতেই পুজোর আয়োজন করছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র আবরার ফৈয়াজ (২৬) জানিয়েছেন, “আমরা সম্প্রতি যে অশান্তি দেখেছি, তার পর থেকেই মন্দিরগুলো পাহারা দিচ্ছি। প্রয়োজনে আবারও তা করব। আমরা আশা করি উৎসবটি শান্তিপূর্ণভাবে পালিত হবে।”

নেতাজির প্রিয় রেস্তোরাঁ: ১০০ বছর ধরে ঐতিহ্যবাহী খাবার পরিবেশন করছে স্বাধীন ভারত হিন্দু হোটেল

বাংলাদেশের ধর্ম বিষয়ক উপদেষ্টা ড. এএফএম খালিদ হোসেন সম্প্রতি বলেছেন, “যারা শান্তি ভঙ্গ করবে, তাদের আইনের আওতায় আনা হবে এবং শান্তি নিশ্চিত করা হবে।” তিনি হিন্দু সম্প্রদায়কে নির্ভয়ে পুজো উদযাপনের আহ্বান জানিয়েছেন।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান ঢাকেশ্বরী মন্দির পরিদর্শন করে দুর্গাপুজো উপলক্ষে নিরাপত্তা ব্যবস্থা পর্যালোচনা করেছেন। তিনি হিন্দু সম্প্রদায়কে দুর্গাপুজো উদযাপনের জন্য নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়েছেন।

তবে এসব আশ্বাস সত্ত্বেও হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে উদ্বেগ কাটছে না। বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের চেয়ারম্যান বাসুদেব ধর বলেছেন, “সরকার আমাদের নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়েছে, কিন্তু আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি এবার উৎসব না করে শুধু ধর্মীয় রীতি পালন করব। আমরা প্রতিবাদ হিসেবে শান্তিপূর্ণভাবে পোস্টার লাগাব যেখানে আমাদের ৮টি দাবি তুলে ধরা হবে।”

এই ৮টি দাবির মধ্যে রয়েছে সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়ন, সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠন, নির্যাতনের শিকার পরিবারগুলোকে ক্ষতিপূরণ প্রদান, দুর্গাপুজোর জন্য তিন দিনের সরকারি ছুটি ঘোষণা, ধর্মীয় স্থাপনা রক্ষণাবেক্ষণ আইন প্রণয়ন ইত্যাদি।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার সাংবাদিকদের বলেছেন, “আমরা অবশ্যই চাই বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষা করা হোক, যেমনটা বিশ্বের সর্বত্র হওয়া উচিত।”

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রায় ২২% ছিল হিন্দু। কিন্তু সামাজিক-রাজনৈতিক প্রান্তিকীকরণ এবং সময়ে সময়ে সহিংসতার কারণে বর্তমানে তা কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৮% এর কাছাকাছি। এই পরিস্থিতিতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক সংগঠন ও সুরক্ষার প্রয়োজনীয়তা আরও বেড়ে গেছে।

বর্তমান পরিস্থিতিতে হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেকেই মনে করছেন, তাদের অস্তিত্ব বিপন্ন। তারা চাইছেন সরকার শুধু উৎসবের সময় নয়, সারা বছর ধরেই তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করুক। পাশাপাশি তারা আশা করছেন সমাজের সব স্তরের মানুষ এগিয়ে আসবেন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও শান্তি বজায় রাখতে।

বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্ম নিরপেক্ষতা ও সকল ধর্মের সমান অধিকারের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে তা কতটা প্রতিফলিত হচ্ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।

About Author
Avatar

বাংলাদেশ প্রতিনিধি থেকে সঠিক ও নির্ভরযোগ্য খবর পেতে আমাদের সংবাদ ওয়েবসাইট দেখুন। তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণের বিস্তারিত জানুন।