বাংলাদেশে এখন একটি নামই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে—আওয়ামী লীগ। এই রাজনৈতিক দলটিকে নিষিদ্ধ করার দাবি নিয়ে দেশজুড়ে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে। ছাত্র-জনতার একটি বড় অংশ রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ জানাচ্ছে, যখন সরকার এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে চাপের মুখে পড়েছে। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে এই দাবি জোরালো হয়ে উঠেছে, এবং সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহে এটি আরও তীব্র আকার ধারণ করেছে। কেউ কেউ বলছেন, এটি দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্ধারণে একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় হতে পারে।
গত বছরের আগস্টে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকেই এই দলটির বিরুদ্ধে ক্ষোভ বাড়তে শুরু করে। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারবিরোধী একটি বড় গণঅভ্যুত্থান ঘটে, যার ফলে শেখ হাসিনাকে দেশ ছাড়তে হয়। এই আন্দোলনের অন্যতম দাবি ছিল আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিকভাবে নিষিদ্ধ করা। আন্দোলনকারীদের অভিযোগ, দীর্ঘ ১৫ বছরের শাসনকালে এই দলটি গণতন্ত্রকে হত্যা করেছে, দুর্নীতিতে জড়িয়েছে এবং বিরোধীদের ওপর নির্যাতন চালিয়েছে। এরপর থেকে বিভিন্ন সময়ে এই দাবি উঠলেও, সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ তীব্রতর হয়েছে। ২০ মার্চ মধ্যরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের বিক্ষোভ এই আন্দোলনের সর্বশেষ উদাহরণ।
এই ঘটনার পেছনে রয়েছে কিছু নির্দিষ্ট প্রেক্ষাপট। গত ২৩ অক্টোবর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ছাত্রলীগ, যিনি আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন হিসেবে পরিচিত, তার বিরুদ্ধে হত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণ এবং টেন্ডারবাজির মতো অভিযোগ ছিল। এই পদক্ষেপকে অনেকে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বড় ধরনের পদক্ষেপের প্রথম ধাপ হিসেবে দেখেছিলেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ নিজেকে নিষিদ্ধ করার বিষয়ে সরকার এখনও কোনো স্পষ্ট সিদ্ধান্ত জানায়নি। এর মধ্যে ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কারী আসিফ মাহমুদ গত ফেব্রুয়ারিতে বলেছিলেন, “আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার বিষয়ে জনগণ ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য রয়েছে।” তবে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, নিষেধাজ্ঞার বদলে অভিযুক্ত নেতাদের বিচারই হবে মূল পদক্ষেপ।
এই বিষয়টি আরও জটিল হয়ে উঠেছে ভারতের সম্পৃক্ততার অভিযোগে। অনেকে দাবি করছেন, ভারত “রিফাইন্ড আওয়ামী লীগ” নামে একটি নতুন রূপে এই দলটিকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে। ছাত্র নেতা হাসনাত আব্দুল্লাহ সম্প্রতি বলেছেন, “ভারতের ষড়যন্ত্রে আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের চেষ্টা চলছে, যা জনগণের রায়ের অবমাননা।” সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই অভিযোগ ছড়িয়ে পড়ায় বিক্ষোভ আরও তীব্র হয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামানের ভূমিকা নিয়ে গুঞ্জন, যিনি কথিতভাবে এই পরিকল্পনায় জড়িত থাকতে পারেন বলে দাবি করা হচ্ছে। তবে এসব অভিযোগের কোনো সুস্পষ্ট প্রমাণ এখনও পাওয়া যায়নি।
আওয়ামী লীগের ইতিহাস এই আলোচনায় আরও গভীরতা যোগ করে। ১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠিত এই দলটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিল এবং দীর্ঘ সময় ধরে দেশের রাজনীতিতে প্রভাবশালী ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দলটির বিরুদ্ধে কর্তৃত্ববাদী শাসন, নির্বাচনে কারচুপি এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে। ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এই দলটি ক্ষমতায় ছিল, যদিও এই সময়ে বিরোধী দলগুলোকে দমন করা এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্বল করার অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধে বারবার উঠেছে। এই পটভূমিতে অনেকে মনে করছেন, আওয়ামী লীগের নিষেধাজ্ঞা দেশের রাজনীতিতে নতুন দিগন্ত খুলতে পারে।
জনগণের মধ্যে এই দাবির প্রতি সমর্থনও কম নয়। সামাজিক মাধ্যমে #BanAwamiLeague হ্যাশট্যাগ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। অনেকে বলছেন, “গণহত্যাকারী সন্ত্রাসী সংগঠনকে নিষিদ্ধ না করা পর্যন্ত দেশে কোনো নির্বাচন হতে দেওয়া হবে না।” এই দাবির পেছনে ২০২৪ সালের আন্দোলনে শত শত মানুষের প্রাণহানির ঘটনাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। আন্দোলনকারীরা মনে করেন, আওয়ামী লীগের হাতে রক্ত লেগে আছে, এবং তাদের রাজনীতিতে ফিরতে দেওয়া হলে দেশে অস্থিরতা বাড়বে।
তবে এই বিষয়ে ভিন্ন মতও আছে। আওয়ামী লীগের সমর্থকরা বলছেন, দলটি নিষিদ্ধ হলে দেশের রাজনৈতিক ভারসাম্য নষ্ট হবে। তারা দাবি করছেন, তাদের দলের ভুল থাকলেও এটি পুরোপুরি নিষিদ্ধ করার বদলে সংস্কারের সুযোগ দেওয়া উচিত। এছাড়া, রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশ মনে করেন, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করলে অন্যান্য দলগুলোর মধ্যে ক্ষমতার শূন্যতা তৈরি হতে পারে, যা দীর্ঘমেয়াদে দেশের জন্য ক্ষতিকর হবে।
সরকার এখন দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়েছে। একদিকে জনগণের চাপ, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ভারসাম্য রক্ষার চ্যালেঞ্জ। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কও এই সিদ্ধান্তের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে, কারণ শেখ হাসিনা বর্তমানে ভারতে অবস্থান করছেন। এই পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তিনি এখনও এ বিষয়ে স্পষ্ট কোনো মন্তব্য করেননি, তবে জনগণের দাবির প্রতি সংবেদনশীল থাকার ইঙ্গিত দিয়েছেন।
এই মুহূর্তে বাংলাদেশ একটি সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হবে, নাকি এর বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নিয়ে বিচারের মাধ্যমে সমাধান খোঁজা হবে—এই প্রশ্নের উত্তর এখনও অজানা। তবে একটি বিষয় স্পষ্ট, জনগণের কণ্ঠ এখন আর দমিয়ে রাখা সম্ভব নয়। দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ কোন পথে যাবে, তা সময়ই বলে দেবে।