বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ শাহাবুদ্দিনের পদত্যাগের দাবিতে দেশজুড়ে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ চলছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র নিয়ে রাষ্ট্রপতির সাম্প্রতিক মন্তব্যের পর থেকে এই আন্দোলন শুরু হয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে বিভিন্ন শহরে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ অব্যাহত রয়েছে।
গত সোমবার রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ শাহাবুদ্দিন এক সাক্ষাৎকারে বলেন, শেখ হাসিনার পদত্যাগের কোনো দালিলিক প্রমাণ তাঁর কাছে নেই। এই মন্তব্যের পর থেকেই বিরোধী দলগুলো ও ছাত্র সংগঠনগুলো রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে সরব হয়ে ওঠে। তারা অভিযোগ করে, রাষ্ট্রপতি মিথ্যাচার করছেন এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে রক্ষা করার চেষ্টা করছেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে মঙ্গলবার থেকে ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে গণজমায়েত শুরু হয়েছে। এই আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ সোশ্যাল মিডিয়ায় সবাইকে এই জমায়েতে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি রাষ্ট্রপতিকে “ফ্যাসিবাদের দোসর” বলে অভিযোগ করেছেন এবং তাঁর পদত্যাগ দাবি করেছেন।
শুধু ঢাকাতেই নয়, দেশের অন্যান্য জেলাতেও বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। টাঙ্গাইল ও সিরাজগঞ্জে মশাল মিছিল হয়েছে। বিক্ষোভকারীরা রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ ছাড়াও ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়েছেন। তারা ছাত্রলীগকে “সন্ত্রাসী সংগঠন” হিসেবে অভিহিত করেছেন।
বিরোধী দলগুলোর মধ্যে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী এই ইস্যুতে সতর্ক অবস্থান নিয়েছে। তারা রাষ্ট্রপতির সমালোচনা করলেও সরাসরি তাঁর পদত্যাগের দাবি করেনি। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, “শিক্ষাজীবনে ছাত্রলীগ করা রাষ্ট্রপতি পলাতক শেখ হাসিনাকে পুনর্বাসিত করার চেষ্টা করছেন”।
অন্যদিকে, সরকার সমর্থক মহল এই বিক্ষোভকে “উসকানিমূলক” বলে অভিহিত করেছে। তারা বলছে, রাষ্ট্রপতি সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করছেন এবং তাঁর বিরুদ্ধে এই ধরনের আন্দোলন গণতন্ত্রের পরিপন্থী।
সাংবিধানিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রপতিকে সরিয়ে দেওয়া সংবিধান অনুযায়ী সম্ভব নয়। কারণ সংসদ বাতিল করা হয়েছে, যেখানে রাষ্ট্রপতিকে অভিশংসন করা যেত। আবার স্পিকার পদত্যাগ করেছেন এবং ডেপুটি স্পিকার কারাগারে থাকায় রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ গ্রহণের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাও নেই।
তবে সাংবিধানিক আইনজীবী শাহদীন মালিক মনে করেন, “স্বৈরাচারী সরকারের বিদায়ের পর সবকিছু তো সংবিধান অনুযায়ী হচ্ছে না। তাই নিয়ম বা সংবিধানের প্রশ্ন অবান্তর। বরং জনআকাঙ্ক্ষার আলোকে তাকে সরিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা সরকার চাইলে করতেই পারে।”
এই পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস এখনও কোনো সরাসরি মন্তব্য করেননি। তবে সরকারের আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে “মিথ্যাচারের” অভিযোগ এনেছেন। তিনি বলেছেন, রাষ্ট্রপতির মন্তব্য তাঁর শপথের লঙ্ঘন।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই পরিস্থিতি বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা করতে পারে। তারা বলছেন, রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের দাবি মেনে নেওয়া হলে তা অন্তর্বর্তী সরকারের জন্যও চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। কারণ নতুন রাষ্ট্রপতি নিয়োগের প্রক্রিয়া নিয়ে নতুন করে বিতর্ক সৃষ্টি হতে পারে।
অন্যদিকে, এই আন্দোলন দীর্ঘায়িত হলে তা দেশের অর্থনীতি ও স্থিতিশীলতার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ইতিমধ্যেই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন।
তবে বিক্ষোভকারীরা বলছেন, তারা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চালিয়ে যাবেন যতক্ষণ না তাদের দাবি পূরণ হয়। তারা বলছেন, রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ ছাড়াও তারা ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ করা, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন, সকল রাজবন্দীর মুক্তি এবং নতুন সংবিধান প্রণয়নের দাবি জানিয়েছেন।
গণভবনে বিক্ষোভকারীদের প্রবেশ: বাংলাদেশে শ্রীলঙ্কার স্মৃতি ফিরল
এই পরিস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সতর্ক অবস্থান নিয়েছে। ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। পুলিশ বলছে, তারা শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভের অধিকার মানে, তবে কোনো ধরনের সহিংসতা বরদাস্ত করা হবে না।
সামগ্রিকভাবে, রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের দাবিতে বাংলাদেশের রাজনীতি নতুন এক মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছে। এই আন্দোলন কতদূর গড়ায় এবং সরকার কীভাবে এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করে তার ওপর নির্ভর করছে দেশের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক গতিপথ।