বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ শাহাবুদ্দিনের পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভকারীরা বঙ্গভবনের সামনে জমায়েত হয়েছেন। স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা কমিটি (শারক) নামক একটি সংগঠনের ব্যানারে বিক্ষোভকারীরা দুপুর ১২টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্য থেকে বঙ্গভবনের দিকে মিছিল শুরু করে।
পুলিশ হাইকোর্ট মাজার সংলগ্ন এলাকায় বিক্ষোভকারীদের বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলেও তারা এগিয়ে যায়। বঙ্গভবনের ভেতরে প্রবেশের চেষ্টা করলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের বাধা দেয়। এরপর বিক্ষোভকারীরা বঙ্গভবনের বাইরে সমাবেশ করে বক্তৃতা দেন।
বিক্ষোভকারীরা ঘোষণা করেছেন যে তাদের দাবি পূরণ না হলে আগামীকাল বিকেল ৪টায় আবারও বঙ্গভবনের কাছে জমায়েত হবেন। এছাড়া “রক্তিম জুলাই ২৪” নামে আরেকটি গ্রুপ সাম্প্রতিক গণঅভ্যুত্থানে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের কল্যাণে কাজ করছে। তারাও রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের দাবিতে আহত ব্যক্তিদের নিয়ে আলাদা অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছে।
গণভবনে বিক্ষোভকারীদের প্রবেশ: বাংলাদেশে শ্রীলঙ্কার স্মৃতি ফিরল
এই ঘটনার পর ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) যুগ্ম কমিশনার ফারুক হোসেন জানিয়েছেন, বঙ্গভবন এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, “বড় সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। গোয়েন্দারাও সাদা পোশাকে কাজ করছেন। স্থানীয় থানাগুলোর সঙ্গে সেনাবাহিনী ও র্যাবের সদস্যরাও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে সহযোগিতা করছেন।”মতিঝিল বিভাগের ডেপুটি কমিশনার (ডিসি) মোঃ শাহরিয়ার আলী জানিয়েছেন, “এলাকায় কিছু লোক বিক্ষোভ করছে। তাদের থামানো হয়নি, তবে আমরা সতর্ক আছি যাতে কোনো অঘটন না ঘটে।” এলাকায় বর্মী বাহিনীর গাড়ি (এপিসি) ও পানির কামানও মোতায়েন করা হয়েছে।
এই বিক্ষোভ শুরু হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের মাত্র দুই দিন পর। গত ৫ আগস্ট ২০২৪ তারিখে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ত্যাগ করেন। তার পদত্যাগের পর দেশজুড়ে হিংসাত্মক বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। বিক্ষোভকারীরা প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবন দখল করে নেয় এবং আওয়ামী লীগের অফিস ও নেতাদের বাড়িঘরে হামলা চালায়।
শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর থেকে এখন পর্যন্ত মোট ৪৪০ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে স্থানীয় মিডিয়া সূত্রে জানা গেছে। এর মধ্যে ১০০ জনের মৃত্যু হয়েছে শেখ হাসিনার পদত্যাগের পরবর্তী সময়ে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সোমবার সকাল ১১টা থেকে রাত ৮টার মধ্যে ৩৭টি মৃতদেহ আনা হয়েছে। হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, সোমবার ৫০০ জন আহত হয়ে হাসপাতালে এসেছেন, যাদের অনেকেরই বুলেটের আঘাত রয়েছে।
বর্তমানে সেনাবাহিনী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করছে। সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে বিক্ষোভকারীদের শান্ত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, “আমি পুরো দায়িত্ব নিচ্ছি। যদি পরিস্থিতি ভালো হয়, তাহলে জরুরি অবস্থার প্রয়োজন নেই। আমরা আশা করি একসাথে একটি ভালো পরিস্থিতির দিকে যাব। দেশ অনেক ক্ষতি সহ্য করেছে, অর্থনীতি আঘাত পেয়েছে এবং অনেক মানুষ মারা গেছে। এখন সহিংসতা বন্ধ করার সময় এসেছে।”
জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান আরও জানিয়েছেন যে তিনি অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের জন্য রাষ্ট্রপতির সঙ্গে কথা বলবেন। তিনি ইতিমধ্যে প্রধান বিরোধী দলগুলো ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করেছেন, তবে আওয়ামী লীগের সঙ্গে কোনো আলোচনা করেননি। সেনাপ্রধান বিক্ষোভরত ছাত্র নেতাদের সঙ্গেও বৈঠক করবেন।
এদিকে বিক্ষোভকারীরা নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে প্রস্তাব করেছেন। ছাত্র নেতা নাহিদ ইসলাম জানিয়েছেন, ইউনূস এই প্রস্তাবে সম্মতি দিয়েছেন। বর্তমানে প্যারিসে অলিম্পিক উপলক্ষে অবস্থানরত ইউনূস শেখ হাসিনার পদত্যাগকে দেশের “দ্বিতীয় মুক্তি দিবস” হিসেবে অভিহিত করেছেন।
বিক্ষোভকারী নেতা সারজিস আলম সাংবাদিকদের বলেছেন, “আমরা মুহাম্মদ ইউনূসের নাম প্রস্তাব করেছি তার সম্মতি নিয়ে। এখন যদি সংসদ সদস্যদের মধ্য থেকে অন্য কেউ আসে, আমরা তা হতে দেব না।” তিনি আরও জানিয়েছেন যে বিক্ষোভকারীরা মন্ত্রিসভার জন্য আরও নাম প্রস্তাব করবেন এবং ক্ষমতাসীনদের পক্ষে তাদের ইচ্ছা উপেক্ষা করা কঠিন হবে।
উল্লেখ্য, শেখ হাসিনা ২০০৯ সাল থেকে টানা চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় ছিলেন। তার শাসনামলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন হলেও গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের অবস্থা নিয়ে সমালোচনা ছিল। বিরোধী দলগুলো অভিযোগ করত যে সরকার তাদের দমন করছে এবং নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করছে।
শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার গঠন এবং নতুন নির্বাচনের মাধ্যমে দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া পুনরুজ্জীবিত করার চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু হওয়ায় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠেছে।
বর্তমানে দেশের অর্থনীতি ও জনজীবন ব্যাপকভাবে ব্যাহত হয়েছে। স্কুল-কলেজ বন্ধ রয়েছে, ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তারা সহিংসতা বন্ধ করে শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সংকট সমাধানের আহ্বান জানিয়েছে।