কোটা সংস্কার আন্দোলনের পটভূমি
বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থার ইতিহাস দীর্ঘ। ১৯৭২ সালে স্বাধীনতার পর প্রথম এই ব্যবস্থা চালু হয়। তখন মেধা তালিকায় ২০% স্থান বরাদ্দ রাখা হয়, বাকি ৮০% বিভিন্ন কোটায় বণ্টন করা হয়। এর মধ্যে ছিল:
- ৪০% জেলাভিত্তিক কোটা
- ৩০% মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের জন্য
- ১০% যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত নারীদের জন্য
সময়ের সাথে সাথে এই ব্যবস্থায় পরিবর্তন আসে। ২০১৮ সালে যখন আন্দোলন শুরু হয়, তখন কোটার হার ছিল:
কোটার ধরন | শতকরা হার |
---|---|
মুক্তিযোদ্ধা | ৩০% |
মহিলা | ১০% |
জেলা | ১০% |
ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী | ৫% |
প্রতিবন্ধী | ১% |
মেধা তালিকা | ৪৪% |
২০১৮ সালের আন্দোলন
২০১৮ সালের জানুয়ারিতে কোটা ব্যবস্থা বাতিলের দাবিতে হাইকোর্টে একটি রিট পিটিশন দায়ের করা হয়। আবেদনকারীরা যুক্তি দেন, এই ব্যবস্থা বাংলাদেশের সংবিধানের মূলনীতির পরিপন্থী। এরপর থেকেই সোশ্যাল মিডিয়ায় আন্দোলনের সূত্রপাত হয়।ফেব্রুয়ারি মাসে শাহবাগে বিক্ষোভ শুরু হয়। ‘বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ’ নামে একটি সংগঠন গড়ে ওঠে। ধীরে ধীরে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে।মার্চ মাসে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। ১৪ মার্চ পুলিশের সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে আন্দোলনকারীরা। ৬৩ জন আটক হন। এর প্রতিবাদে দেশের বিভিন্ন স্থানে সড়ক অবরোধ করা হয়।
সরকারের প্রতিক্রিয়া
প্রথমদিকে সরকার কোটা ব্যবস্থায় কোনো পরিবর্তন আনতে অস্বীকৃতি জানায়। কিন্তু আন্দোলন তীব্র হওয়ার পর ২০১৮ সালের এপ্রিলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা করেন, সরকারি চাকরিতে সব ধরনের কোটা তুলে দেওয়া হবে।কিন্তু পরবর্তীতে সরকার এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে। ২০১৯ সালের ৩০ জুলাই সরকার জানায়:
- প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির পদে (৯ম থেকে ১৩তম গ্রেড) কোনো কোটা থাকবে না
- তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির পদে (১৪তম থেকে ২০তম গ্রেড) কোটা বহাল থাকবে
- তবে কোটায় যোগ্য প্রার্থী না পাওয়া গেলে মেধা তালিকা থেকে পদ পূরণ করা হবে
২০২০ সালের ২০ জানুয়ারি সরকার আরও একধাপ এগিয়ে অষ্টম গ্রেড বা তার উপরের পদেও সরাসরি নিয়োগে কোটা বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয়।
২০২৪ সালের নতুন আন্দোলন
গত কয়েকবছর শান্ত থাকার পর ২০২৪ সালের জুলাই মাসে আবার মাথাচাড়া দিয়েছে কোটা সংস্কার আন্দোলন। এবারের আন্দোলনের মূল দাবি:
- সকল সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা সম্পূর্ণ বাতিল
- শুধুমাত্র মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ প্রক্রিয়া
- কোটার সুবিধাভোগীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির তদন্ত
আন্দোলনকারীরা অভিযোগ করছেন, সরকার আগের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি। তাদের মতে, নিম্ন পর্যায়ের চাকরিতে এখনও কোটা বহাল রয়েছে, যা মেধাবী প্রার্থীদের জন্য অন্যায়।
আন্দোলনের প্রভাব
বর্তমান আন্দোলন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে সারা দেশে। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্রদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া পড়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় #ReformQuotaSystem হ্যাশট্যাগ ট্রেন্ডিং-এ রয়েছে।কিন্তু এই আন্দোলন কেবল ছাত্রদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। বেকার যুবক-যুবতী, চাকরিপ্রার্থী এবং সাধারণ মানুষও সমর্থন জানাচ্ছেন। তাদের যুক্তি, কোটা ব্যবস্থা মেধাবীদের অধিকার হরণ করছে।অন্যদিকে, মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠনগুলো এই আন্দোলনের বিরোধিতা করছে। তারা বলছেন, মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের জন্য বিশেষ সুযোগ থাকা উচিত।
সরকারের অবস্থান
সরকার এখনও পর্যন্ত কোনো সুনির্দিষ্ট প্রতিক্রিয়া জানায়নি। তবে সরকারি দলের নেতারা বলছেন, আন্দোলনের পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে। তাদের অভিযোগ, বিরোধী দল এই আন্দোলনকে ব্যবহার করে সরকার বিরোধী আন্দোলন গড়ে তুলতে চাইছে।প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে জানানো হয়েছে, সরকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। প্রয়োজনে আন্দোলনকারীদের সাথে আলোচনা করা হবে।
ষড়যন্ত্রের অভিযোগ
সরকার দাবি করছে, কোটা সংস্কার আন্দোলনের আড়ালে দেশে গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি সৃষ্টির ষড়যন্ত্র চলছে। তাদের মতে, বিদেশি শক্তি এই আন্দোলনকে ব্যবহার করে দেশে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে চাইছে।কিন্তু আন্দোলনকারীরা এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তারা বলছেন, তাদের দাবি ন্যায্য এবং সাংবিধানিক। তাদের মতে, সরকার মিথ্যা অভিযোগ এনে আন্দোলন দমন করতে চাইছে।
কোটা সংস্কার আন্দোলনে গৃহযুদ্ধের ষড়যন্ত্র কথা কোথা থেকে উঠেছে
কোটা সংস্কার আন্দোলনে গৃহযুদ্ধের ষড়যন্ত্রের কথা প্রথম উঠে আসে ২০২৪ সালের জুলাই মাসে। এই সময়ে বাংলাদেশে কোটা সংস্কার আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে এবং সরকার ও আন্দোলনকারীদের মধ্যে সংঘর্ষ বাড়তে থাকে। আন্দোলনকারীরা দাবি করেন যে, তারা সরকারের হামলার শিকার হচ্ছেন এবং তাদের আন্দোলন দমন করার জন্য সরকার বিভিন্ন ষড়যন্ত্র করছে।
ছাত্রদের হুঙ্কারে কেঁপে উঠল রাজপথ: কোটা আন্দোলনের অজানা কাহিনী!
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ১৪ জুলাই ২০২৪ সালে এক বিবৃতিতে উল্লেখ করেন যে, বিএনপি এবং তাদের সহযোগীরা কোটা আন্দোলনকে ব্যবহার করে সরকার বিরোধী আন্দোলনে পরিণত করার চেষ্টা করছে। তিনি বলেন, “বিএনপি এবং তাদের সহযোগীরা আন্দোলনকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করছে এবং বিভিন্ন বিবৃতি ও মন্তব্য করে আন্দোলনকে উস্কে দিচ্ছে” ।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৬ জুলাই ২০২৪ সালে এক সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকার’ বলে অভিহিত করেন, যা পরিস্থিতিকে আরও উত্তপ্ত করে তোলে। তিনি বলেন, “মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানরা মেধাবী নয়, শুধুমাত্র রাজাকারদের সন্তানরাই মেধাবী?”।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে যে তিনি লন্ডন থেকে আন্দোলনকারীদের সাথে ষড়যন্ত্র করছেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, “তারেক রহমান আন্দোলনের নেতৃত্ব নিচ্ছেন এবং এটি একটি রাজনৈতিক আন্দোলনে পরিণত করার চেষ্টা করছেন” ।
এই সমস্ত বিবৃতির প্রেক্ষিতে সরকার দাবি করে যে, আন্দোলনের পেছনে একটি গভীর ষড়যন্ত্র রয়েছে যা দেশের স্থিতিশীলতা নষ্ট করতে পারে। সরকারের মতে, বিদেশি শক্তি এবং দেশের অভ্যন্তরীণ কিছু গোষ্ঠী এই আন্দোলনকে ব্যবহার করে দেশে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে চাইছে।
এই ষড়যন্ত্রের অভিযোগের প্রেক্ষিতে আন্দোলনকারীরা দাবি করেন যে, তাদের আন্দোলন সম্পূর্ণ ন্যায্য এবং সাংবিধানিক। তারা বলেন, “সরকার মিথ্যা অভিযোগ এনে আন্দোলন দমন করতে চাইছে এবং আমাদের ন্যায্য দাবিকে উপেক্ষা করছে” ।
এই প্রেক্ষাপটে, আন্দোলনের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে সরকার ও আন্দোলনকারীদের মধ্যে আলোচনার উপর। সরকারের পক্ষ থেকে আলোচনার প্রস্তাব দেওয়া হলেও আন্দোলনকারীরা এখনও পর্যন্ত তা প্রত্যাখ্যান করেছেন। পরিস্থিতি যদি আরও উত্তপ্ত হয়, তবে দেশের স্থিতিশীলতা ও গণতন্ত্রের উপর এর প্রভাব পড়তে পারে।
ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি
বর্তমান পরিস্থিতি থেকে মনে হচ্ছে, আগামী দিনগুলোতে আন্দোলন আরও তীব্র হতে পারে। আন্দোলনকারীরা জানিয়েছেন, সরকার তাদের দাবি না মানলে তারা কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করবেন।অন্যদিকে, সরকারও কঠোর অবস্থান নিতে পারে। ইতিমধ্যেই কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, পরিস্থিতি অবনতি হলে সরকার কঠোর পদক্ষেপ নিতে পারে।রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ হল সংলাপ। সরকার ও আন্দোলনকারীদের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান বের করতে হবে। অন্যথায় পরিস্থিতি আরও জটিল হতে পারে।