Bangladesh Plane Crash: রাজধানী ঢাকার উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে সোমবারের ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনায় আহত দগ্ধ রোগীদের জরুরি চিকিৎসা সেবা দিতে ভারত থেকে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার ও নার্স পাঠানো হচ্ছে। বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধে ভারতীয় হাইকমিশনের মাধ্যমে দুজন বার্ন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও একটি নার্স টিম আজ মঙ্গলবার ঢাকায় পৌঁছেছেন। এর পাশাপাশি দগ্ধ চিকিৎসার জন্য বিশেষায়িত সরঞ্জাম ও ওষুধপত্রও প্রেরণ করা হয়েছে।
দুর্ঘটনার পরপরই বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব আসাদ আলম সিয়ামকে ফোন করেন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি। আলোচনায় জরুরি চিকিৎসা সহায়তার বিষয়ে আশ্বাস দেন তিনি। পরবর্তীতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও সামাজিক মাধ্যমে এই দুর্ঘটনায় শোক প্রকাশ করে বাংলাদেশের পাশে থাকার আশ্বাস প্রদান করেন।
বাংলাদেশ সরকার ভারতীয় দূতাবাসের মাধ্যমে জানিয়েছে যে, আহতদের বেশিরভাগের শরীর মারাত্মক পুড়ে গেছে। এই কারণে বার্ন ইউনিটে অভিজ্ঞ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসা দল, উন্নত মেডিকেল সরঞ্জাম ও অত্যাধুনিক ওষুধপত্রের জরুরি প্রয়োজন রয়েছে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বিবিসিকে জানিয়েছেন, “আমরা আশা করছি দুজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক – যাদের বার্ন ইউনিটে কাজ করার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা আছে, তারা নার্সদের একটি ছোট টিম নিয়ে আজই (মঙ্গলবার) ঢাকায় পৌঁছে যাবেন।”
হতাহতের সংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে এই ঘটনায়। আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৩১ জনে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে ২৫ জনই ১২ বছরের কম বয়সী শিশু। নিহতদের মধ্যে রয়েছেন বিমানের পাইলট ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির ইসলাম এবং ওই স্কুলের একজন শিক্ষিকা। আহতের সংখ্যা ১৭০ জনের বেশি, যাদের মধ্যে ৭৮ জন বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের বিশেষ সহকারী চিকিৎসক মহম্মদ সায়েদুর রহমান মঙ্গলবার সাংবাদিক সম্মেলনে জানান, ছয়জনের দেহ এতটাই ঝলসে গেছে যে তাদের শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। তাদের পরিচয় নিশ্চিত করতে ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। এ পর্যন্ত ২০ জনের দেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
বার্ন ইনস্টিটিউটে ৪২ জন রোগী ভর্তি রয়েছেন, যাদের অধিকাংশেরই অবস্থা আশঙ্কাজনক। সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) ২৮ জন চিকিৎসাধীন রয়েছেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তিনজন এবং উত্তরা আধুনিক হাসপাতালেও কয়েকজন আহত চিকিৎসা নিচ্ছেন।
দুর্ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ অনুযায়ী, সোমবার দুপুর ১টা ৬ মিনিটে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর এফ-৭ বিজেআই প্রশিক্ষণ বিমানটি উড্ডয়ন করেছিল। মাত্র ১২ মিনিট পর ১টা ১৮ মিনিটে বিমানটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ক্যান্টিনের ছাদে বিধ্বস্ত হয়। বিমানটি আছড়ে পড়ার সাথে সাথে বিকট বিস্ফোরণ ঘটে এবং দাউদাউ করে আগুন ধরে যায়।
দুর্ঘটনার সময় স্কুলের ক্লাস শেষ হয়ে গেলেও বহু শিক্ষার্থী এবং কয়েকজন শিক্ষক স্কুল প্রাঙ্গণে অবস্থান করছিলেন। বিমানের জ্বালানি ও বিস্ফোরণের কারণে সৃষ্ট আগুনে তৎক্ষণাৎ শতাধিক শিক্ষার্থী দগ্ধ হয়। দমকল বিভাগের আটটি ইঞ্জিন ঘটনাস্থলে পৌঁছে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। উদ্ধারকারী দলের পাশাপাশি সেনাবাহিনী, পুলিশ ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) জরুরি ভিত্তিতে উদ্ধার কার্যক্রমে অংশ নেয়।
ভারত ছাড়াও চীন এবং জাপান বাংলাদেশে জরুরি চিকিৎসা সহায়তা প্রদানের আগ্রহ প্রকাশ করেছে। তবে ভারতের সাথে ভৌগোলিক নৈকট্য এবং চিকিৎসা ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতার কারণে প্রথমেই ভারত থেকে চিকিৎসা সহায়তা এসে পৌঁছেছে। এর পাশাপাশি প্রয়োজন অনুযায়ী আরও চিকিৎসক ও নার্স পাঠানোর প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে বলে জানা গেছে।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে এটি অন্যতম ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। গত ৩৪ বছরে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর ৩২টি বিমান দুর্ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে বেশিরভাগই প্রশিক্ষণ বিমানের দুর্ঘটনা ছিল। ২০০৫ সালেও উত্তরায় একটি এফ-৭এমবি যুদ্ধবিমান বহুতল ভবনের সাথে সংঘর্ষে পড়েছিল। তবে এবারের ঘটনা হতাহতের সংখ্যার বিচারে সবচেয়ে মর্মান্তিক।
বিমান দুর্ঘটনার কারণ উদঘাটনে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। প্রাথমিক অনুমান অনুযায়ী, প্রযুক্তিগত ত্রুটি অথবা পাইলটিং সমস্যা দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে। তবে চূড়ান্ত রিপোর্ট প্রকাশের আগ পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট কারণ জানা যায়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চীনা তৈরি এই এফ-৭ বিমানগুলো বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহৃত হচ্ছে এবং এগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ ও আধুনিকায়ন নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এই ঘটনায় গভীর শোক প্রকাশ করে মঙ্গলবারকে রাষ্ট্রীয় শোক দিবস ঘোষণা করেছেন। তিনি আহতদের সর্বোচ্চ চিকিৎসা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছেন। একইসাথে বিমান দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ তদন্তের আশ্বাস প্রদান করেছেন।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন যে, গুরুতর পোড়া রোগীদের চিকিৎসার জন্য বিশেষায়িত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা প্রয়োজন। ভারত থেকে আগত চিকিৎসা দল এই ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে আশা করা হচ্ছে। বিশেষত শিশুদের পোড়া চিকিৎসায় যে বিশেষ যত্ন ও দক্ষতা প্রয়োজন, সে বিষয়ে এই বিশেষজ্ঞ দল সহায়তা করতে পারবেন।
ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রীর এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে এই জরুরি চিকিৎসা সহায়তা প্রদান। দুই দেশের মধ্যকার কূটনৈতিক সম্পর্ক ও মানবিক বন্ধন যে কত গভীর, তা এই সংকটকালীন সহযোগিতার মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে। ঢাকা বিমান দুর্ঘটনায় আহতদের পূর্ণ আরোগ্য ও এই ধরনের দুর্ঘটনা ভবিষ্যতে প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের প্রত্যাশা সকলের।