বাংলাদেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নতুন মোড় নিয়েছে। শনিবার (৩ আগস্ট) দেশব্যাপী বৃহৎ বিক্ষোভ সমাবেশের পর রোববার (৪ আগস্ট) থেকে সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন আন্দোলনকারীরা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আলোচনার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে তাঁর পদত্যাগের দাবি জানিয়েছেন ছাত্র নেতারা।
গত মাসে সরকারি চাকরিতে কোটা সংরক্ষণের বিরুদ্ধে শুরু হওয়া আন্দোলনে ২০০ জনেরও বেশি মানুষের মৃত্যুর পর এখন বিক্ষোভকারীরা ন্যায়বিচার ও সরকারের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন করছেন। শনিবার দেশের বিভিন্ন শহরে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করেছেন।
আল জাজিরার প্রতিবেদক তানভীর চৌধুরীর মতে, “ছাত্র আন্দোলন এখন একটি বৃহত্তর জনবিক্ষোভে পরিণত হয়েছে। শনিবার বিভিন্ন পেশার মানুষ প্রতিবাদে যোগ দিয়েছেন এবং সরকারের পদত্যাগ দাবি করছেন।”
কোটা আন্দোলনে ছাত্র মৃত্যুর পিছনে লুকানো সত্য যা জানলে আপনিও স্তম্ভিত হবেন!
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ জানিয়েছেন, রোববার থেকে সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন শুরু হবে।
– কর ও ইউটিলিটি বিল না দেওয়া
– সরকারি কর্মচারীদের ধর্মঘট
– ব্যাংকের মাধ্যমে বৈদেশিক রেমিট্যান্স লেনদেন বন্ধ করা
আন্দোলনকারীরা প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে গত মাসের সহিংসতার জন্য জনসম্মুখে ক্ষমা প্রার্থনা এবং কয়েকজন মন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করছেন। পাশাপাশি দেশব্যাপী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার দাবিও জানিয়েছেন তারা।
তবে রাস্তায় নামা অনেকেই এখন প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করছেন। ২০ বছর বয়সী নিজহুম ইয়াসমিন বলেন, “তিনি অবশ্যই পদত্যাগ করবেন কারণ আমাদের এই স্বৈরাচারী সরকার দরকার নেই। আমরা কি দেশকে মুক্ত করেছিলাম এই শাসনের অধীনে আমাদের ভাই-বোনদের গুলি করে হত্যা করার জন্য?”
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শনিবার আন্দোলনকারী ছাত্রদের সাথে আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “আমি প্রতিবাদকারী ছাত্রদের সাথে বসতে এবং তাদের কথা শুনতে চাই, আমি সংঘর্ষ চাই না।”
কিন্তু আন্দোলনকারীরা এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন। ছাত্র নেতা নাহিদ ইসলাম ফেসবুকে লিখেছেন, “এই হত্যাকারী সরকারের” প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে, “ক্ষমা চাওয়ার সময় ইতিমধ্যে শেষ হয়ে গেছে”।
Modi 3.0 এর প্রথম বাজেট, ভারতের অর্থনীতির নতুন দিগন্ত!
আন্দোলনের শুরু হয় জুলাইয়ের প্রথম দিকে, যখন হাইকোর্ট মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের জন্য ৩০% সরকারি চাকরি কোটা পুনর্বহাল করার নির্দেশ দেয়। প্রতিবাদকারীরা যুক্তি দিয়েছিলেন যে এই কোটা ব্যবস্থা বৈষম্যমূলক এবং শাসক আওয়ামী লীগের সমর্থকদের সুবিধা দেয়।
১৫ জুলাই থেকে বিক্ষোভ হিংসাত্মক রূপ নেয়। সরকার ১৯ জুলাই মধ্যরাত থেকে দেশব্যাপী কারফিউ জারি করে এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনী মোতায়েন করে। এছাড়া ১১ দিন মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ রাখা হয়।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান সাংবাদিকদের বলেছেন, নিরাপত্তা বাহিনী সংযম প্রদর্শন করেছে কিন্তু সরকারি সম্পত্তি রক্ষার জন্য তাদের “গুলি চালাতে বাধ্য হতে হয়েছে”।
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিশেষজ্ঞরা বিক্ষোভ দমনের হিংসাত্মক কার্যক্রম অবিলম্বে বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছেন। জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান ফলকার তুর্ক সরকারকে বিক্ষোভের সময় তাদের কার্যক্রম সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করতে এবং নিহত, আহত ও আটক ব্যক্তিদের পরিবারকে তথ্য দিতে বলেছেন।
১ লা জুলাই: ভারতের ইতিহাসে মাইলফলক অন্যতম
ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতি প্রধান জোসেপ বরেল “বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত ও মারাত্মক বল প্রয়োগের” বিষয়ে আন্তর্জাতিক তদন্তের আহ্বান জানিয়েছেন।
সরকার বিক্ষোভের জন্য বিরোধী দলগুলোকে দায়ী করেছে। এই সপ্তাহে বাংলাদেশের প্রধান ইসলামপন্থী দল জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
গত সপ্তাহে ৯,০০০ এরও বেশি লোককে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে পুলিশ ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো জানিয়েছে।
বর্তমানে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও নরসিংদী জেলায় রাত ৮টা থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত কারফিউ চলছে। চট্টগ্রামে রাত ১০টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত কারফিউ জারি রয়েছে। অন্যান্য জেলায়ও অনুরূপ কারফিউ থাকতে পারে।
সরকার ৪ আগস্ট থেকে বেশিরভাগ প্রাথমিক বিদ্যালয় খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে বরিশাল, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, ঢাকা উত্তর, ঢাকা দক্ষিণ, গাজীপুর, খুলনা, ময়মনসিংহ, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, রাজশাহী, রংপুর ও সিলেট জেলার স্কুলগুলো এখনও বন্ধ থাকবে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই আন্দোলন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনকালে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি বিষয়ক অধ্যাপক আলী রিয়াজ বলেছেন, “শাসনের ভিত্তি নড়ে গেছে, অজেয়তার ভাবমূর্তি অদৃশ্য হয়ে গেছে। প্রশ্ন হল, হাসিনা কি বের হওয়ার পথ খুঁজছেন নাকি শেষ পর্যন্ত লড়াই করবেন।”
বর্তমান পরিস্থিতিতে আগামী দিনগুলোতে আরও উত্তেজনা ও সংঘাত বাড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। সরকার ও আন্দোলনকারীদের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান না হলে পরিস্থিতি আরও জটিল হতে পারে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপও বাড়ছে সরকারের উপর। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা হুমকির মুখে পড়তে পারে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।